মাদকবিরোধী অভিযানে রাজধানীতে গ্রেপ্তার ৪৪

আগের সংবাদ

উদ্ধারের অপেক্ষা আর ত্রাণের আকুতি : পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ > ভেসে উঠছে বানভাসি মানুষের লাশ > এখনই সচল হচ্ছে না ওসমানী বিমানবন্দর

পরের সংবাদ

বন্দরনগরীর জলাবদ্ধতা : সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও মেগা প্রকল্পে ধীরগতিই কারণ

প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, চট্টগ্রাম অফিস : মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতেই ডুবে যায় বন্দরনগরীর অধিকাংশ নি¤œাঞ্চল। জলাবদ্ধতায় স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। বছরের পর বছর সেই একই চিত্র বন্দরনগরীর। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান। কয়েক বছর ধরে এসব প্রকল্প চলমান। প্রতি বছরই বলা হয় আগামীবার জলাবদ্ধতা সহনীয় মাত্রায় থাকবে। র্দীঘ সময় ধরে প্রকল্পগুলো চলমান থাকলেও কাজের অগ্রগতি তেমন না থাকায় নগরবাসীর ভোগান্তি ক্রমাগতই বাড়ছে।
অন্যদিকে অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্ট জলাবদ্ধতার এ দুর্ভোগের জন্য নগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবা সংস্থাগুলো বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন বিশিষ্ট নাগরিক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ঢাকতে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পে ধীরগতি ও নানা অসঙ্গতির কারণে নগরবাসীকে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মেগা প্রকল্পের আওতায় খালে দেয়া বাঁধ অপসারণ না করা এবং বিভিন্ন নালা-নর্দমা ময়লা-আবর্জনা ভর্তি থাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাই অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর নি¤œাঞ্চল ডুবে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
গতকাল রবিবার নগরের নিচু এলাকা মরাদপুর, বহদ্দারহাট, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর, বাদুরতলা, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরের বহদ্দারহাটে চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিমের বাসায়ও পানি ঢুকেছে। এরপর গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে মেয়রের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। এ সময় তিনি প্রতি বছরের মতো এবারও একই কথা বলেছেন। জলাবদ্ধতার জন্য মেগা প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের ওপর দোষ চাপালেন। তবে মেগা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো বাঁধ দেয়া হয়নি। পানি নিষ্কাশনের পথ নগরীর নালা-নর্দমাগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হয়ে পড়েছে। আবর্জনাভর্তি নালা দিয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাই অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর নি¤œাঞ্চল ডুবে যাচ্ছে। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা সেবা সংস্থাগুলোকে পরস্পরবিরোধী

বক্তব্য না দিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন।
২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, স¤প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। পাঁচ বছর ধরে চউক স্লুইসগেট নির্মাণ শুরু করলেও তার একটিও পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের কোনো সুফলই পাচ্ছে না নগরবাসী। তার ওপর খালে বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে দাবি করে গত মে মাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিটি করপোরেশনের মেয়রও। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান নির্মাণ প্রকল্পের জন্য খালের মুখে যেসব বাঁধ দেয়া হয়েছে, সেগুলো খুলে দেয়ার দাবি জানান তিনি।
তবে এই প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, শহরের কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে, সেই বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি। এসব জায়গার পানি বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না। তবে বাঁধের কারণে পানি উঠে এসে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে, এমন কোনো বাঁধ আমরা দিইনি। দুয়েকটা খালে বাঁধ থাকলেও জলাবদ্ধতা হচ্ছে না। খালের পুরো কাজটা আমরা এখনো শেষ করে উঠতে পারিনি। এখন পর্যন্ত ১২টি খালের কাজ শেষ করা হয়েছে। আরো ছয়টি খালের কাজ শেষ মুহূর্তে রয়েছে। আশা করছি খালের কাজ শেষ হয়ে এলে জলাবদ্ধতা আগের চেয়ে কমে আসবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সেবা সংস্থাগুলোকে সমন্বিত উপায়ে নগরীর কোথায় কোথায় পানি জমছে এসব জায়গা চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। খাল ও নালা পরিষ্কার করে পানি নিষ্কাশনের পথ নিশ্চিত করতে হবে।
চসিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছিল। তবে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর পানিও নেমে গেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের আওতায় কয়েকটি খাল ও ড্রেনে বাঁধের কারণে পানি নামতে পারছিল না। এ রকম পাঁচটি স্পট থেকে আমরা বাঁধ কেটে দিয়েছি। নাসির খাল, টেক্সটাইল, মাইজপাড়া, এক কিলোমিটার, বিজয়নগর এলাকায় ড্রেন থেকে বাঁধ সরিয়ে আমরা পানি চলাচল স্বাভাবিক করেছি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের জন্য খালগুলোয় বাঁধ দেয়া হয়েছে। এই বাঁধ সরানো হয়নি। জোয়ারের পানি প্রবেশরোধে রেগুলেটর বসানোর কথা ছিল। কিন্তু এখনো তা হয়নি। এছাড়া নালা-নর্দমা আবর্জনামুক্ত না হওয়ায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণেই চট্টগ্রামে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প। বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। তাড়াহুড়া করে করা সম্ভাব্যতা যাচাই, নিরীক্ষণ ও দুর্বল কর্মপরিকল্পনাই এর জন্য দায়ী। ত্রæটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষণ, তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রে ধীরগতি, কর্মীর অভাব এবং বাস্তবায়নকারী, ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৩৬টি খাল খনন ও সংস্কার করে সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে কী ধরনের জনবল কাঠামো লাগবে, কী ধরনের ইকুপমেন্ট লাগবে- প্রকল্পে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। খাল পরিষ্কার করা হচ্ছে, খালগুলো আবার ভরে যাবে। খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনকে তহবিল দিতে হবে, লোকবল নিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য অপারেশন ম্যানুয়েল তৈরি করতে হবে। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে করণীয় নিয়ে এখনই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ শেষ করা জরুরি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, মেগা প্রকল্পের আওতায় খালে দেয়া বাঁধ অপসারণ না করা এবং বিভিন্ন নালা-নর্দমা ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি থাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই অল্প বৃষ্টিতেই পুরো নগরী তলিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ও বিপুল পরিমাণ বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, এ অবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনে জনগণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত, কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে নাগরিক পরিবীক্ষণ ও দীর্ঘসূত্রতা বন্ধ করে প্রকল্পের সুফল নগরবাসী যেন পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প ছাড়াও ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে চউক ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণ’ প্রকল্পের অনুমোদন পায়। পরের বছর থেকে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু করে সংস্থাটি। এছাড়া নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আরেকটি প্রকল্পের অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণ করা হবে। সেটির কাজও চলমান রেখেছে পাউবো। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) বিভিন্ন সময় খাল-নালা পরিষ্কারে প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়