উদ্ধার করা হয়েছে সুনামগঞ্জে আটকা পড়া ঢাবির ২১ শিক্ষার্থীকে

আগের সংবাদ

আশ্রয়-খাবার নেই, ত্রাণ নামমাত্র : সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়ংকর নির্মমতা > দুই জেলায় তিনজনের মৃত্যু > সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ চালু

পরের সংবাদ

চট্টগ্রামে নিহত ৪, আহত ১১ : প্রতি বছর পাহাড়ধসে হতাহতের দায় কার?

প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, চট্টগ্রাম অফিস : চট্টগ্রামে ১৪ বছরের বেশি সময়ের চেষ্টায়ও বসতিমুক্ত করা যায়নি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো। পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের সরাতে সারাবছর প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ থাকে না। বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় উচ্ছেদের তোড়জোড়। পাহাড় ধসে প্রাণহানি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধে বিভিন্ন সময় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নানা সুপারিশ করলেও এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ না থাকায় প্রতি বছর পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন সংস্থা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চান। কিন্তু প্রাণ যায় মানবসন্তানের। কিন্তু প্রতি বছর হতাহতের দায় কে নেবে- এমন প্রশ্নের উত্তর মেলে না কখনো।
গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে টানা বর্ষণ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে পাহাড় ধসের শঙ্কার কথা বলা হলেও এ নিয়ে আগে থেকে কোনো উদ্যোগ ছিল না জেলা প্রশাসনের। এর মধ্যে গত ১৭ জুন বিকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করা হয়, আর সেদিন গভীর রাতেই নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকায় পৃথক পাহাড় ধসে ৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১১ জন। নগরের আকবর শাহ থানার বরিশাল ঘোনা ও ফয়স লেকের বিজয়নগর এলাকায় পাহাড় ধসের এই ঘটনা ঘটে।
আকবর শাহ থানার ওসি ওয়ালি উদ্দিন আকবর বলেন, শুক্রবার রাত ২টার দিকে ১ নম্বর ঝিলের বরিশাল ঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় পাঁচজনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক দুইজনকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতরা হলেন আপন দুই বোন শাহিনুর আকতার (৩২) ও মাহিনুর আকতার (২০)। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, রাত তিনটার দিকে আকবর শাহ থানার ফয়স লেকের লেকসিটি বিজয়নগর এলাকায় পাহাড় ধসের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে

৬ জনকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে লিটন (২৩) ও ইমন (১৪) নামে দুই সহোদর ঘটনাস্থলে মারা যায়। অন্যদের চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে ৬৫ পাহাড়ের মধ্যে ৩৪ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর মধ্যে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে কিংবা পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে ঝুঁপড়ি থেকে শুরু করে চার-পাঁচ তলার দালান। পাহাড়ে বসবাস করা বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। তাদের অভিযোগ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘর নির্মাণের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারাই পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করে নি¤œ আয়ের লোকজনকে কম ভাড়ার কথা বলে বসবাসের প্ররোচনা দেন। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। শুধু বর্ষা মৌসুম এলেই বসতি উচ্ছেদ করে। কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় ততই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানোর উদ্যোগে স্থবিরতা চলে আসে। নজরদারি থাকে না আর। এই সুযোগে উচ্ছেদকৃত পরিবারগুলো আবারো ফিরে আসে পাহাড়ের পাদদেশে। যার কারণে ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা।
তবে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ও এ সম্পর্কে নানা সমস্যার বিষয়গুলো উল্লেখ করে বলেন, এসব পাহাড় মালিকদের প্রতি অনুুরোধ- আপনারা অবৈধ-ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করুন। বসবাসকারীদের সরানোর জন্য যত ধরনের প্রশাসনিক সহযোগিতা লাগে, সব করা হবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তিনি আরো বলেন, শনিবার যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটি রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পাহাড়। যারা নিহত হয়েছেন তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড় ধসের ঘটনায় আহত ৬ জনকে ১৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেবেন, তাদের জন্য ৫ লাখ টাকা আর ১০ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। যারা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রয়েছেন তাদের স্থানান্তর করছি। এজন্য স্বেচ্ছাসেবী, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ভারি বর্ষণ আগামী দু-তিনদিন চলবে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছেন, তারা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসুন। আমাদের ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা আছে। যতদিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকবেন সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হবে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বিজলি চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। ভারি বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না, তার কারণ হচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহলের লোভাতুর তৎপরতা। সেই তৎপরতা থামানোর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। তিনি বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপর কিছু উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। ভারি বৃষ্টি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে রাখেন তারা। বর্ষা চলে গেলে আর কোনো খবর থাকে না। তিনি আরো বলেন, পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতে হবে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত ১৪ বছরে পাহাড় ধসে আড়াই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এরপরও জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বসবাস করছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। প্রশাসন বলছে, বিভিন্ন পাহাড়ের মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটসহ নানা জটিলতায় বসবাসরতদের সরানো যাচ্ছে না। পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর টেকনিক্যাল কমিটি যে ৩৭ দফা সুপারিশ করেছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ নতুন করে ১৬টি পাহাড় কেটে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণ করে। সেখানকার আটটি পাহাড়ে নতুন করে অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়