আরো ৩১ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি

আগের সংবাদ

জলে ভাসা সিলেট এক বিচ্ছিন্ন জনপদ : ১২২ বছরের ইতিহাসে ভয়াবহ বন্যা > আশ্রয়ের খোঁজে অসহায় মানুষ > বন্যার্তদের উদ্ধারে নৌবাহিনী, যুক্ত হচ্ছে হেলিকপ্টার-ক্রুজ

পরের সংবাদ

চলচ্চিত্রশিল্প : কী দেখার কথা, কী দেখছি!

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একসময় ঢাকাই সিনেমা ছিল এদেশের মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। পরিবারসহ দলবেঁধে হলে গিয়ে সিনেমা দেখবার প্রবণতা ছিল বরাবরই। সিনেমা নিয়ে অধীর আগ্রহ ও উন্মাদনার কমতি ছিল না একদমই। সিনেমার পাশাপাশি ছিল সিনেমার গানের কদর। এছাড়া অপ্রচলিত স্যাটেলাইটের যুগে ঘরোয়াভাবে বিনোদনের একক উৎস ছিল বিটিভি। ছায়াছবি আর ছায়াছন্দের অপেক্ষায় শুক্রবারের বৈকালিক পারিবারিক জমায়েত ছিল টেলিভিশন সম্মুখে। কম-বেশি প্রত্যেক নায়ক-নায়িকার আলাদা আলাদা ভক্ত শ্রেণির উদ্ভব ছিল। তখন প্রযুক্তিগত উন্নতি না থাকলেও মানসম্মত গল্প ও দুর্দান্ত অভিনয়ে দর্শক মনে নাড়া দিত সিনেমাগুলো। অথচ বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নতি এলেও আসছে না আন্তর্জাতি কমানের ভালো সিনেমা। ভালো গল্প আর শিক্ষিত নির্মাতার অভাবে সিনেমাশিল্প আজ পঙ্গুপ্রায়। সিনেমাশিল্পকে বাঁচাতে সরকারিভাবে শত শত কোটি টাকার অনুদান দেয়া হলেও দৈন্যদশা যেন কাটছেই না। ভালো সিনেমা নিয়ে আলোচনা কম থাকলেও সিনেমাপাড়ার শিল্পী-তারকাদের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অসাধুপনা, পারস্পরিক কোন্দল, রেষারেষি, কাদা ছোড়াছুড়ি ও বিতর্কিত জীবন নিয়ে আলোচনা থাকে তুঙ্গে।
ভালো সিনেমার প্রধান উপাদান অবশ্যই গল্প। এখন যেসব সিনেমাকে ভালো তকমা দেয়া তা কেবল আম ফুরালে আমড়ার কদরের মতো। অতি সাধারণ বিষয়কে জবরদস্তি করে অসাধারণ করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা। সিনেমার আকর্ষণ হলো গল্পের গতিময়তা, অভিনয়, সুন্দর মনে রাখবার মতো সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা। কয়েকজন যে চেষ্টা করছেন না এমন নয় তবু পেরে উঠছেন না নানান সংকটে। অধিকাংশই দুর্বল গল্প, দুর্বোধ্য চিত্রনাট্যে দর্শক মনে জায়গা করে নিতে পারছেন না। যার ফলে সিনেমা হলগুলোতে নাটকীয় নির্জনতা, দর্শক শূন্যতা। হল মালিকদের বাণিজ্যিক স্বাদ মেটাতে পরিচালক-প্রযোজকদের চিন্তাভাবনা ঘুরিয়ে আনা। ফলে সিনেমায় অসহনীয় অশ্লীলতার তীব্র মাথাচাড়া। ’৯৮-৯৯-এর পর থেকে ২০০৫-২০০৬ পর্যন্ত মোটামুটি বলেই দেয়া যায় বাংলা সিনেমার কলঙ্ক কাল। দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির নায়ক-নায়িকাদের রগরগে অভিনয়, কাহিনী বিন্যাসের নিম্নগামী মান- সব মিলে যাচ্ছেতাই পরিস্থিতি। এরই মাঝে স্যাটেলাইটের দুর্দান্ত আবির্ভাব, হলগুলোতে অযতেœর ছাপ বাংলা সিনেমার সার্বিক দুর্দশা বাড়িয়ে দিল আরো এক ধাপ। তৎকালীন বিশ্বব্যাপী গ্রাফিক্স, সাউন্ড সিস্টেমের হালনাগাদ উৎকর্ষ বাংলা সিনেমাকে ছুঁতে পারেনি, তাই তো দর্শকদের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে ৩৫ মি.মি. আকৃতির ছায়াছবি। সিনেমার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা যেহেতু বাণিজ্য তথা হলব্যবসার ওপর মূল্যায়িত হয় সুতরাং ঘরে বসে ভালো-খারাপের মূল্যায়নের সুযোগ কম।
দর্শক অভাবে সিনেমা হল বন্ধ হতে হতে এখন দেশের অনেক জেলাতেই একটি সিনেমা হলও অবশিষ্ট নেই। সাদাকালো যুগ পরবর্তী নব্বই দশকে দেশে হলের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩৫টির মতো। বর্তমানে সিনেমা হল কমতে কমতে হলের সংখ্যা ৬২টিতে দাঁড়িয়েছে! দেশে ২৫টি জেলায় এখন আর কোনো সিনেমা হল নেই। হল কমায় সিনেমা নির্মাণের সংখ্যাও কমে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন বাদে শত শত শিল্পী, কলাকুশলী অভাব আর কষ্টের মধ্যেই দিনাতিপাত করছেন। অনেকেই এর মধ্যে পেশা বদল করেছেন। আবার সিনেমা হল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে সিনেমার গল্প, নির্মাতা ও শিল্পী সংকটসহ চলচ্চিত্রের বিভাজনের ফলে সিনেমা নির্মাণ কম হওয়াকে দায়ী করেছেন। নতুন নতুন সিনেমা মুক্তি দিতে না পারায় হল মালিকরা ক্রমেই হল বন্ধ করে দিয়ে মার্কেট নির্মাণ করেছেন।
এত এত সমস্যা সমাধানে যাদের মূল ভূমিকা রাখার কথা সে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন এখন হয়ে গেছে চলচ্চিত্র বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এফডিসির বাইরে শুটিং করতে যে খরচ হয়, এফডিসিকেন্দ্রিক তার দ্বিগুণ খরচ পোহাতে হয় প্রযোজকদের। কয়েকটি সংগঠনের অনুমতি নিতে হয়, চাঁদা দিতে হয়। বছরে ২৭টি সিনেমা নির্মাণ নিয়ে না ভাবলেও সারা বছর ধরে ২৭টি সংগঠনের নির্বাচন, বনভোজন নিয়ে এফডিসি থাকে আলোচনায়। এখানে সারা বছরই রয়েছে একে অন্যের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি। সিনেমা বানিয়ে আবার সেন্সরশিপ নিতেও গুনতে হয় আলাদা করে চাঁদা। তাই নির্মাতা প্রযোজকদের এফডিসিবিমুখতা বাড়ছে। সে কারণে এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র এখন প্রায় মৃত। অথচ এ এফডিসি থেকেই একসময় তৈরি হয়েছে স্বপ্নের ঠিকানা, সত্যের মৃত্যু নাই, আম্মাজান, সূর্য দীঘল বাড়ী, জীবন থেকে নেয়া, সারেং বউ, গোলাপী এখন ট্রেনে, ভাত দে, নয়নমনি, অনন্ত প্রেমের মতো অসংখ্য মানসম্মত বাণিজ্যিক সিনেমা। ১৯৮৯ সালে মাত্র ২০ লাখ টাকায় নির্মিত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এখন পর্যন্ত আয় করেছে ২০ কোটি টাকা। যার রেকর্ড এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। এখন শিল্পী সমিতিতে কে চেয়ারে বসবে, কে ক্ষমতা দেখাবে, এই নিয়ে মারামারি হয়। কিন্তু শিল্পী সমিতি টিকবে কী দিয়ে, সিনেমা না থাকলে শিল্পী সমিতির অফিসে বসে থেকে কী লাভ সে হুঁশ নেই কারো!
সিনেমা দিয়ে কখনো আলোচনায় না এলেও সিনেমাপাড়ার দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত বিতর্কিত নাম জায়েদ খান। বিগত কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে প্রযোজক সমিতির সঙ্গে দ্ব›দ্ব, প্রযোজক সমিতি থেকে তার সদস্যপদ বাতিল, শিল্পী সমিতির ১৮৪ জনের সদস্যপদ বাতিল, ১৮ সংগঠনের সঙ্গে দ্ব›দ্ব, পারস্পরিক বয়কট সব এই জায়েদ খানকে ঘিরেই। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে অনেকেই তাকে বলেন ভক্তবিহীন নায়ক। এ বছরের শুরু থেকেই চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন-সমালোচনা। নির্বাচনের আগে একধরনের উত্তেজনা, নির্বাচন শেষে নতুন করে উত্তেজনা। নির্বাচনে ভোট কেনা, জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত সেই জায়েদ খান। এখন অবধি নিপুন-জায়েদের সাধারণ সম্পাদক পদের সমাধান মেলেনি আদালতেও। এবার ডিপজলের ছেলের বিয়েতে ওমর সানীর থাপ্পড়, জায়েদ খানের বন্দুক তাক করা ও মৌসুমীর স্বামী ছেড়ে জায়েদের পক্ষ নেয়া নিয়ে গরম তুমুল আলোচনা সিনেমাপাড়ায়। অন্যদিকে সম্প্রতি মুক্তির পূর্বে ‘তালাশ’ সিনেমা নিয়ে টকশোতে থাপ্পড়কাণ্ডকে নোংরা প্রচারণার অংশ বলে মনে করছেন দর্শকরা। এরূপ নানান অস্থিরতা, নোংরামি ও অসঙ্গতির মধ্যেও সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা নিজ ভাষার ভালো সিনেমার অপেক্ষাতেই থাকেন।
তবে কিছুটা স্বস্তির বিষয় দেশি নির্মাতাদের হাতে সম্প্রতি ওটিটিনির্ভর বেশকিছু ভালো ওয়েবফিল্ম, সিরিজ হচ্ছে। কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে মূল ধারার সিনেমার সঙ্গে তুলনার সুযোগ নেই। সিনেমার সত্যিকারের স্বাদ পেতে প্রেক্ষাগৃহের বিকল্প নেই। চলার পথে হাতে মোবাইল নিয়ে সিনেমা দেখা, গল্প করতে করতে সিনেমা দেখা আর প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক।
ভালো সিনেমা যে একদম হয়নি, তা নয়। অশ্লীলতার রাজত্বের মাঝেও আমরা পেয়েছি হুমায়ূন আহমেদ, তারেক মাসুদের ভিন্ন ধারার মুষ্টিমেয় কিছু সিনেমা। বর্তমানেও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা, গিয়াস উদ্দীন সেলিমসহ কিছু ভালো নির্মাতা আলোর মুখ দেখাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবছর মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যার তুলনায় তা একবারেই নগণ্য। আশি-নব্বইয়ের মতো হয়তো শুধু এক নায়কী উন্মাদনায় দর্শক টানা যাচ্ছে না, তবে কাহিনী বৈচিত্র্য এবং আনুষঙ্গিক উন্নত পরিবর্তন দর্শকদের হলমুখো করবে আবার এই প্রত্যাশা।
:: তৌফিক আহমেদ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়