মির্জা ফখরুল : খালেদার কিছু হলে দায় নিতে হবে সরকারকেই

আগের সংবাদ

কুমিল্লায় ইসির ‘এসিড টেস্ট’

পরের সংবাদ

বাজেট বাস্তবায়নে চাই সর্বোচ্চ আন্তরিকতা

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশ্ব মন্দা এবং মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য একটি সতর্ক বাজেট গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন। করোনাকাল পেরিয়ে অর্থনীতিতে যখন সবেমাত্র গতি সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে শুরু হওয়া রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই আসন্ন অর্থবছরের আগে আগে বাজেট প্রণেতাদের একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করার কথা ভেবে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর কথা ভাবতে হয়েছে, অন্যদিকে করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের তৎপরতা বেগবান করার কথাও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় কিছুটা সংকোচনমুখী বাজেট কাম্য হলেও এমন কাটছাঁটের ছাপ যেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতগুলোর ওপর না পড়ে- এ কথা আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। তবে বরাদ্দ খুব বেশি বাড়েওনি। আমরা মনে করি এ দুটি খাতে বরাদ্দে আরেকটু সাহসী বা উদার হওয়া যেত। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশের মতো বেড়ে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো হয়েছে। বাজেটের শতাংশ হিসাবে এটি ১৯ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চাপে থাকা মানুষের সুরক্ষার চাহিদার প্রেক্ষাপটে এই বরাদ্দ অবাক করেছে। বিশেষ করে ওএমএসে বরাদ্দ ২২৩ কোটি টাকা কমে যাওয়া এবং অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির বরাদ্দ ৯৫ কোটি টাকা কমে যাওয়াটা এ সময়ের প্রেক্ষাপটে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। অতিদরিদ্রদের কাছে ১০ টাকা কেজি দরে মাসে যে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রি করা হচ্ছিল তার দাম বাড়িয়ে কেজিতে ১৫ টাকা করা হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটেই হয়তো এমনটি করা হয়েছে। তবে এই সমন্বয়টি এখনই না করাটা কাম্য ছিল। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার কথা ভাবা যায়।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। আমাদের বাজেট ঘাটতি আরো ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.৪ শতাংশ করা যেত বলে মনে হয়। তাতে বাড়তি বরাদ্দ দেয়া যেত সামাজিক খাতগুলোতে। এছাড়া আসন্ন অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলো মাথায় রেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয়। যেমন- অনুন্নয়ন বা পরিচালন ব্যয় প্রস্তাবিত বাজেটে ৪ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি জিডিপির ৯ শতাংশ। একইভাবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মোট বাজেটের ১২ শতাংশ যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেখানেও এখনই জরুরি নয় এমন প্রকল্পগুলোতে অর্থ কম দিয়ে বা একেবারেই না দিয়ে চাপ কমানো যেত। এছাড়া আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত চলতি এবং আসন্ন দুই অর্থবছরেই ১০ শতাংশের কম। বাংলাদেশের মতো বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশে এই অনুপাত অন্তত ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। এজন্য এনবিআরের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সহজে কর দেয়ার সুযোগ করে দেয়া চাই। অর্থমন্ত্রী নিজেই তার বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন দেশে ৪ কোটি মধ্যবিত্ত ও তদূর্ধ্ব আয়-শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশেরও কমের এখন টিআইএন আছে। আসছে অর্থবছরে এই সংখ্যা অন্তত ২ কোটি করে, এমন নাগরিকদের কর জালের আওতায় আনা খুবই সময়োচিত হবে।
কর প্রস্তাবের মধ্যে কয়েকটি অবশ্যই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে বলে আমাদের মনে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আছে পাচার করা অর্থ জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ করে দেয়ার প্রস্তাবটি। এভাবে খুব বেশি টাকা দেশে ফেরত আনা যাবে বলে মনে হয় না। এটি বরং যথাযথভাবে যারা কর দেন তাদের নিরুৎসাহিত করবে। কোম্পানির টাকা ব্যাংকে রেখে পাওয়া সুদের ওপর ঢালাওভাবে উৎস করহার ১০-২০ শতাংশ করাও মনে হয় ঠিক হবে না। এছাড়া আমদানি করা ল্যাপটপের ওপর ১৫ শতাংশ, মুঠোফোনের খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে যে ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে- সেগুলোও ‘ডিজিটাল ডিভাইড’কে আরো তীব্র করে তুলতে পারে।
সার্বিক বিবেচনায় কর প্রস্তাবনাকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সহায়কই বলতে হবে। করপোরেট কর হার কমানো হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে আমাদের জিএসপি সুবিধা শেষ হয়ে গেলে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানি বাড়তি সুবিধা না পেলে চলে যেতে পারে। তাদের ধরে রাখার জন্যও এই কর ছাড় নতুন প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। ব্যাংকে যাদের ৫ কোটি টাকার বেশি আছে তাদের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবটিও সরকারের ‘রিডিস্ট্রিবিউটিভ’ কর নীতিরই প্রতিফলন বলতে হয়। এছাড়া আমদানি বিকল্প শিল্পে কর ছাড় যেমন দেশীয় শিল্পের জন্য সহায়ক হবে, তেমনি বিলাসপণ্যে শুল্ক বৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় নিশ্চিত করবে। আগামী অর্থবছর থেকে পোশাক খাতের মতোই অন্য রপ্তানিকারকরাও করপোরেট করে ছাড় পাবেন। তারাও দেবেন ১২ শতাংশ। পরিবেশবান্ধব কারখানা হলে আরো কমে এ হার হবে ১০ শতাংশ। এতে রপ্তানিকারকরা উৎসাহিত হবেন, বিনিয়োগ আসবে, আর বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও বাড়বে। স্টার্টআপ কোম্পানির টার্নওভার কর ০.৬ থেকে কমিয়ে ০.১ শতাংশ করা হয়েছে। আইসিটি উদ্যোক্তাদের জন্য এটি বিশেষ উৎসাহ জোগাবে।
বাজেটে কৃষি খাতকে যথাযথ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। চলতি বছরে কৃষি ভর্তুকি ১০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাবিত হলেও সংশোধিত বাজেটে দেখা গেছে এটি বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছরে আরো বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে জ¦ালানি, সার ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধি এবং আমদানি করা খাদ্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর যে লক্ষ্য রয়েছে সে বিবেচনায় ভর্তুকি আরেকটু বাড়ানো যেত। তবে ২০ হাজার কোটি টাকা কৃষি ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ দেয়া গেলে তা কৃষির বিকাশ, খাদ্য আমদানি হ্রাস এবং সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আম নিয়ে আসার জন্য যে ‘ম্যাঙ্গো ট্রেইন’ রয়েছে তার আদলে অন্যান্য কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণেও সহায়তার নতুন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে অনলাইনে কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণের বিদ্যমান প্ল্যাটফর্ম এবং নতুন স্টার্টআপগুলোর জন্য প্রণোদনার কথা ভাবা দরকার।
বাজেটে নতুন কিছু সময়োচিত উদ্যোগও নজরে পড়ছে। ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিপ্টো-কারেন্সির বিকল্প কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ঘোষণা অনেককেই আশাবাদী করছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জন্য কয়েক বছর ধরেই সবাই অপেক্ষা করছিলেন। এবারে জানানো হয়েছে যে আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে এবং আসন্ন অর্থবছরেই এর বাস্তবায়ন শুরু হবে। কর্মসংস্থান অধিদপ্তর গঠনের প্রস্তাবনাটিকেও স্বাগত জানাতে হয়।
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের মধ্যে ইন্টার-অপরেবিলিটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। এই এমএফএস এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সল্যুশনগুলো ব্যবহার করে কী করে আরো সহজে দেশে রেমিট্যান্স নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে নতুন উদ্যোগের কথা বাজেট প্রস্তাবে যুক্ত করা যায়। আমদানি ব্যয় কমাতে পারলে বহিঃঅর্থনীতিতে সৃষ্ট চাপ মোকাবিলা করা সহজ হয়। দেশীয় কোম্পানি জাহাজ তৈরি করলে বা কিনে এনে তা দিয়ে আমদানি-রপ্তানির কাজ করা গেলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা কমবে। এতে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। তবে বছরে বেঁচে যাবে ৪০-৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পদ্মা সেতু চালু হলে গোটা অর্থনীতিই নতুন গতি পাবে। এজন্য ওই অঞ্চলে বিনিয়োগে বাড়তি প্রণোদনা দেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ যে বিভিন্ন রকম সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা হয়েছি তা মোকাবিলা করার জন্য একটি সময়োপযোগী বাজেটই আমরা পেয়েছি বলে মনে হয়। মনে রাখতে হবে যে, মূল্যস্ফীতি কিংবা ডলার লেনদেন হারের যে সংকট- এগুলোর উৎস কিন্তু আমাদের অর্থনীতির ভেতরে নয়। এসব বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু পুরোপুরি আমাদের হাতে নেই, তাই অর্থবছরের মাঝপথেও নীতিতে পরিবর্তন আনতে হতে পারে। সব অংশীজনকে যেমন এমন পরিবর্তনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, তেমনি সরকারকেও এমন পরিবর্তনের মধ্যে জনগণের বিশেষত কম আয়ের পরিবারগুলোর জীবন-যাপন যেন যতটা সম্ভব মসৃণ করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে তাই সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখাতে হবে এবং যারা বিপন্ন হবেন সরকার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে তাদের পাশে থাকবে- এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেয়া চাই।

ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়