ওমর সানীকে গুলি করার হুমকি জায়েদ খানের

আগের সংবাদ

সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ : পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার প্রস্তাবে সমর্থন

পরের সংবাদ

দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বাজেটের কী প্রভাব পড়তে পারে?

প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট মহান জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন। আগামী অর্থবছরের বাজেট অনেক গুরুত্ব বহন করে জাতির জন্য, কারণ এখনো দেশ পুরোপুরি করোনা আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারপর আবার শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবে অনেক দেশের অর্থনীতিতে ঘটে গেছে মারাত্মক বিপর্যয়। সেই দিক থেকে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আর্থিক অবস্থা অনেকটা ভালো। প্রস্তাবিত বাজেটের ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তা এখন দেখার বিষয়।
এবারের বাজেটটি হলো একটি ঘাটতি বাজেট। ঘাটতি বাজেট দেশের অর্থনীতির জন্য অমঙ্গলজনক নয়। যদি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বা নতুন কিছু ক্ষেত্র সৃষ্টি করে ওই ঘাটতির অর্থসংস্থান করা হয়। তাহলে ঘাটতি বাজেটেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এই বাজেটের আয়-ব্যয়টা হলো, ব্যয় ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, আয় ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, তাই বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এই বাজেটটির অর্থ সংগ্রহের দিকগুলো দেখানো হয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আহরণ করবে মোট বাজেটের ৫৪.৬ শতাংশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর সংগ্রহ করা হবে ২.৬ শতাংশ, করের বাইরে অর্থ পাওয়া যাবে ৬.৬ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ ঋণ ২১.৬ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ ১৪.১ শতাংশ, বৈদেশিক অনুদান ০.৫ শতাংশ। ফলে দেখা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থ যা আসবে বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য তা ব্যাংক ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির খাত থেকে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির বিষয়টাও এক ধরনের ঋণ। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার যদি বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণ নেয়, তাহলে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাংক ঋণ কমে যাবে।
ব্যাংকগুলোর আমানত ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী, তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে বোঝা যায়। প্রায় ব্যাংকগুলোর আমানত ঘাটতি অবস্থায় রয়েছে। তারপর আছে প্রতিটি ব্যাংকের বিশাল আকারের ঋণখেলাপির পরিমাণ। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি কোনো ব্যাংকেরই অবস্থা ভালো নয়। সরকার যদি বাজেট ঘাটতির জন্য ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, তাহলে ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যবসা ও শিল্পে উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণটা কমে যাবে। ব্যবসা ও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হলে বাড়বে বেকারত্ব। করোনার প্রভাবে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসাগুলো বড় আকারের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির কারণে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সরকার করোনার জন্য যে প্রণোদনা দিয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার হয়নি। গুটিকয়েক মানুষ এই প্রণোদনার সুফল পেয়েছে। যার জন্য দেখা গেছে, করোনাকালে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষ কাজ হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। তাদের অনেকেই এখনো কোনো কাজ পাননি। কারণ ক্ষুদ্র এবং মাঝারি পর্যায়ে ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাকালের ঘাটতিটা পূরণ করতে পারেনি এখনো। কিন্তু সরকার যদি ঘাটতি পূরণের জন্য জাতীয়ভাবে পড়ে থাকা সম্পদগুলো কাজে লাগিয়ে অর্থ আহরণ করত তাহলে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। যেমন দেশের পাট, বস্ত্র, চিনিসহ সরকারি কারখানাগুলো বন্ধ অবস্থায় আছে। অপরদিকে বেসরকারিভাবে স্থাপিত পাট, বস্ত্র ও চিনি কলগুলো প্রতি বছরই করছে লাভ।
সরকার যদি এই পড়ে থাকা কলকারখানাগুলো চালু করে ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং বাজেটের ঘাটতিও পূরণ হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি বেড়ে যাওয়ার কারণে কমবে বেকারত্ব। এর ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা যেত কমে। বেকারত্ব কমে গেলে চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ অনেক অসামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যেত। তাই মনে হয়, এই বাজেটের ফলে সামাজিক আর্থিক ব্যবস্থায় বিশেষ কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বাজেট হলো রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা, যার মাঝে অন্তর্নিহিত আছে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, চিকিৎসা ও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানাবিধ দিক। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। মাত্র পাঁচ বছরের বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনতে পারলে বাজেটের ঘাটতি পূরণের অন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল না। অপরদিকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার জন্য বাজেটে যে প্রভিশনের কথা বলা হয়েছে তা আরো বিপদ ডেকে আনবে। বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ৭ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে পারবে পাচারকারীরা এবং তাদের পরিচয়ও গোপন রাখা হবে। বিদেশে যারা টাকা পাচার করেন, তাদের আয়টা কি বৈধ? তারা চুরি করেই এই আয়টা করে দেশের অভ্যন্তরে, তাই তারা দেশে অর্থটা দেখায় না। কারণ দেশে অর্থ প্রদর্শিত হলে সাধারণ মানুষ জেনে যাবে। বিষয়টি গোপন রাখার জন্যই এরা বিদেশে টাকা পাচার করে দেয়।
সরকার যদি ৭ শতাংশ করের বিনিময়ে এই অবৈধ পন্থার আয়কে বৈধ করে তাহলে লাভ কী হলো? ১০০ টাকা চুরি করে পাচারকারীরা ৭ টাকা ফেরত দেবে। পাচারকারীর নিট থাকবে ৯৩ টাকা। এর ফলে পাচারের প্রবণতাটা বেড়ে যাবে। কারণ পাচারকারী ৭ শতাংশ কর দিয়ে তার অবৈধ টাকাগুলো বৈধ করবে। এর ফলে দুর্নীতি কমবে না বরং দুর্নীতিকে উৎসাহিতই করা হবে। পাচারকারীরা আদৌ কতটা ফেরত আনবে তা এখন দেখার বিষয়। ঘাটতি পূরণের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টিও বাজেটে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী ২০২১ সালের ৩০ জুন বলেছেন, রাষ্ট্রের বর্তমানে বিদেশি ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ। এই হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৩০ টাকা। এই ঋণ বাড়ানোর ক্রমবিকাশমান ধারাটা জাতির জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে? খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে, এই খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারে শৈথিল্যই চোখে পড়ে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেই। উপরন্তু বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিবারই বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নিতে হয় সরকারকে। অথচ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী অবস্থায় পড়ে আছে। এই খেলাপি ঋণ আদৌ আদায় হবে কতটুকু তার সম্ভাবনাটাও বোঝা যায় না দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের চিত্র দেখে। ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা, ২০২১ সালে তিন কোয়ার্টারে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিমাণ ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ ২ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপি টাকার পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষের দিকে। যা এক বছর আগে ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। খেলাপি বাড়ছে কিন্তু আদায় কমছে অস্বাভাবিক হারে। ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এই বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১০ শতাংশ এখন খেলাপি ঋণ। তারপর অবলোপন সংস্কৃতির কারণে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণও জানা যায় না। ২০০৩ সালে ঋণ শ্রেণিকৃত করার নতুন নিয়ম চালু করা হয়, তিন বছর ধরে থাকা খেলাপি ঋণকে অবলোপন দেখানো নিয়ম চালু হওয়ায়। ফলে এই মোট খেলাপি ঋণের টাকার পরিমাণটা ব্যাংকের প্রতিবেদনে আসে না। এই নিয়মটা বাতিল করা জরুরি। কারণ এর ফলে মোট অনাদায়ী ঋণের সঠিক চিত্রটা সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতির জন্য কতটা মঙ্গলকর হবে তা অন্য খাতগুলোও বিবেচনায় নিলে বোঝা যাবে। তবে বৈদেশিক ঋণ এবং পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়