ওমর সানীকে গুলি করার হুমকি জায়েদ খানের

আগের সংবাদ

সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ : পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার প্রস্তাবে সমর্থন

পরের সংবাদ

অন্তিম ইচ্ছে

প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সামনে কচি গ্রাম। তার ডানে দুশো গজ এগোলে ছোট্ট একটা বাজার। তার নাম মগের বাজার। এখানে আগে মগেরা অধিকাংশ দোকান করত। এখন তেমন নেই বললেই চলে, তবুও নাম যায়নি। সে বাজারে সদাইপাতি করে মোমেন শেখ। আলু, পটল, পেঁয়াজ, আদা হরেক রকমের জিনিসপাতি বেচাকেনা করে।
প্রতি শুক্র আর সোমবার হাটবার। আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসে, বাজার সদাই করে। তখন দোকানে বেশ ভিড় হয়। মোমেন শেখের বয়স হয়েছে। তাই আগের মতন একা হাটবারের দোকানদারি সামলাতে পারে না। এ দোকান তার দাদার আমলের। দাদার পর তার পিতা রহমত শেখ দোকানদারি করত। বংশ পরম্পরায় এখন মালিক মোমেন শেখ। ভাগ্য দোষে চারটে বিয়ে করেও তার কোনো সন্তানাদি নেই।
তার ওপর বিধাতার একি রসিকতা! তিন-তিনটে বউ মারা গেছে চোখের সামনে। প্রথমটা পানিতে ডুবে। মাঝেরটা পেটের পীড়ায়। তৃতীয় স্ত্রী সাপে কাটায়। চতুর্থ বারের মতন তাই সদ্য বিয়ে করেছে মোমেন শেখ। তার চতুর্থ স্ত্রী বেশ পটু। বয়স অল্প বলে চঞ্চল। বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে ভালো একটু খেতে পেত না। তাই এই ছিয়াত্তর বয়সের বুড়োর সঙ্গে তাকে ঘর বাঁধতে হয়েছে। বাপ-মাও চালাক। যেহেতু কেউ নেই, বুড়ো মরলে এসব খাবে কে! সবই তো মেয়ের নামে করে ফেলা যাবে। এ দিয়ে মেয়েও চলবে তারাও চলবে। বাহ! হয়ে গেল দুয়ে-দুয়ে চার। তাহলে বুড়োরও বৃদ্ধ বয়সে একটু মরার পথ হলো। মাবিয়ার মাধ্যমে তার বাবা-মারও একটু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হলো। মাবিয়ার বয়স খুব কম। কত কম? সে এখনো নিজে নিজে শাড়ি পরতে জানে না। হাঁটার সময় পা নাচায়। দুলে দুলে হাঁটে।
বুড়ো ভারি রসিক। বউকে শাড়ি পরিয়ে দেয়া, তেল-সাবান খুশবু লাগিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বউয়ের সঙ্গে মহুয়ার পালা, লাউয়া ডালিমনের গল্প- সবই করে। বউ তার একেবারে হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নেয়। আগের তিনটে বউ হারানোয় চতুর্থ বউ তার হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছে। তবে গ্রামের ছেলেরা এ নিয়ে কটূক্তি করে। বউ-ঝিরা নদীর ঘাটে কলসি ভরতে গিয়ে হাসাহাসি করে। বুড়ো বয়সে নাতিন বিয়ে করলেন নাকি শেখ সাব! বেয়াই সাহেব বলে তাকে রসিকতার ছলে খোঁচা মারে। বুড়োর তাতে কষ্ট যে লাগে না একেবারে তা নয়।
তবুও হাসির ছলে উড়িয়ে দেয়। কী আর করা? ভাগ্য দোষে সে দুষ্ট। বিশাল এক তলা বাড়ি তার। গোয়ালে দুধের গরু আছে। পাশেই পুকুর। পুকুরে হরেক রকমের মাছের চাষ করে মোমেন শেখ। বেলা বারোটা পর্যন্ত দোকান করে বাড়ি চলে আসে। গোসল করে। মাছকে খাবার দেয়। পুকুরের পাড়ে লাগানো সবজির আগাছা সাফ করে। বউ তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। বিকাল বেলা আবার দোকানে বসে। রাত দশটা পর্যন্ত দোকানদারি করে। রাজসিক দোকানি সে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় চা-নাশতা বানিয়ে ঘরের কপাট লাগিয়ে তার কাছে চলে যায় বউ। তার সঙ্গে দোকানদারি করে। দু’জনে মিলে খোশ-গল্প করে। খুব সুখে বাস করতে থাকে। কিন্তু অসুখে ভুগে মাবিয়ার লোভি বাবা। সে শুধু মেয়েকে বারবার চাপ প্রয়োগ করে। সম্পত্তি কবে তার নামে লিখে নিবে।
মাবিয়া বাবার কথা মতন কাজ করতে পারে না। তার বিবেকে বাধে। যে মানুষটিকে সে ভালোবাসে, যার কাছ থেকে দু-মুঠো অন্ন নিজে খায়, বাপ-মার জন্য পাঠায়; সে মানুষটিকে ছল-চাতুরি করে পরাস্ত করতে তার বিবেকে বাধে।
সে বয়সে কচি হলেও জ্ঞানে-গুণে পরিপক্ব। তাই বাবা বারবার বললেও সে কিছু বলে না। মাবিয়ার বাবা রানিং মেম্বার। মাবিয়ার মা জানে না তার আরেকটি বউ আছে। সে ঘরে বড়বড় ছেলে-মেয়ে আছে। ওই মহিলা মাবিয়ার বাবার প্রথম স্ত্রী। সহায় সম্পত্তি সবকিছুর মালিক তার প্রথম পক্ষের ছেলে-মেয়েরা। মাবিয়াদের কিছু নেই। তাই মাবিয়ার বাবা চায় কিছু সম্পদ মাবিয়া তাকে এনে দিলে দ্বিতীয় পক্ষকে কিছুটা সম্পদ দেয়ার গৌরবে সে গৌরবান্বিত হবে। এ ছাড়া কামাল মেম্বার একজন নামকরা বাজিকর। জুয়ার নেশায় সে উন্মত্ত। আইপিএল, বিপিএল তার টাকা ইনকামের মৌসুম। দশ মাস বেকার থাকে। ইউনিয়ন বোর্ডে আসা গরিবের সম্পদ সে কুক্ষিগত করে। যা পায় টেনেটুনে চলে আর আইপিএল এলে জুয়া খেলায় উড়ায়। মাবিয়া হাটবারে তার স্বামীর সঙ্গে ব্যবসা করে। এখন সে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে মোমেন শেখ বেশ রসিকতা করে।
গত তিন দিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত হলো। হাটে লোকজন নেই। জোয়ারের পানিতে পথ-ঘাট তলিয়ে গেছে। তাই বেশিরভাগ সময় দোকান বন্ধ রাখে মোমেন। স্ত্রীর সঙ্গে ঘরে শুয়ে-বসে কাটায়।
মৃত্যু চিন্তা মোমেনকে গ্রাস করে। একরাতে সে তার একান্ত আলিঙ্গনে বউকে কাছে নেয়। কানে কানে বলে, আমি চলে গেলে একা একা এ ভিটেয় তোমার ভয় হবে না বউ! বউ এর চোখে জল টলমল করে। কোথায় যাবে? তোমায় কোথাও যেতে দেব না আমি। তাই বুঝি! হুম! আসো শক্ত করে জড়িয়ে ধরো আমাকে। মোমেন শেখ বউকে ভীষণ ভালোবাসে। তার স্ত্রীও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিছুদিন পর রোজা এলো। মোমেন শেখ আর তার স্ত্রী সাহরিতে উঠে। মোমেন পাশে বসে থাকে। তার স্ত্রী তাকে অজুর পানি এগিয়ে দেয়।
একসঙ্গে নামাজ পড়ে। তাহাজ্জুদের নামাজে কান্নাকাটি করে তার জন্য না হলেও স্ত্রীর জন্য যেন একজন সন্তান প্রভু দান করেন। রোজার মাঝখানে হঠাৎ কাজ করতে করতে মাবিয়া ঘুরে পড়ে যায়। মোমেন পুকুরঘাট থেকে এসে দেখে ভয়ে কাতর। এই বউটাও বুঝি তাকে রেখে চলে গেল। সে তাড়াতাড়ি সিএনজি ডেকে আনে। ছোট্ট শিশুর মতন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
বউকে নিয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালে ভর্তি করে। ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে। তাড়াতাড়ি দেখার জন্য। ডাক্তার বাবু ঘণ্টাখানেক পর ভেতর থেকে বেরিয়ে বললেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। রোগীর সেন্স ফিরেছে। সঙ্গে আর কেউ আসেনি? মোমেন বললেন, না। রোগীর স্বামী কোথায় মিষ্টি নিয়ে আসতে বলেন তাড়াতাড়ি। রোগী মা হতে চলেছে। মোমেন শেখ খুশিতে সেখানেই স্ট্রোক করে ফেলেন।
সাত-আট দিনের অনেক চেষ্টার পরও তাকে বাঁচানো যায়নি। শুধু জ্ঞান ফেরার পর মাবিয়াকে বলেছিল, মাবিয়া আমার চিন্তা দূর হলো। আমার এ বিশাল বাড়ি মাতানোর জন্য আমার ছেলে আসছে। আমি হয়তো তাকে দেখে যেতে পারব না। তবু তোমাকে তো সে দেখে রাখতে পারবে। আমার জীবন যৌবন কেটেছে যে দোকানে সে দোকান তো সে সামলাতে পারবে। সেটাই বা কম কিসের, তাই না! কাঁদতে কাঁদতে একসময় বুড়ো নিদ্রা যায়। আর সে নিদ্রা ভাঙে না।
:: চট্টগ্রাম

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়