মামলায় জিতে টাকা ‘ইনকাম’

আগের সংবাদ

ভোক্তার সুফল কোন পথে : বাজেটে কর বাড়লে দাম বাড়ে, কর কমলে দাম কমে না, সরকারি সিদ্ধান্তের সুফল পান না ভোক্তারা

পরের সংবাদ

৫ বছর ধরে শিকলবন্দি জয়ার নিঃসঙ্গ জীবন

প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সালেহ এলাহী কুটি, মৌলভীবাজার থেকে : মৌলভীবাজারে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শিকলবন্দি জীবন পার করছে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী। টাকার অভাবে হয়নি পর্যাপ্ত কোনো চিকিৎসা। বড় ভাইও মানসিক রোগী।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর ইউনিয়নের শ্রীমঙ্গল গ্রামের ঘোষ বাড়ির মৃত হরি ঘোষের মেয়ে জয়া ঘোষ (২৫) ও অনন্ত ঘোষ। শৈশব পার করে কৈশোরে পা রাখতেই জয়ার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তার চিকিৎসা দরিদ্র বাবার জন্য বিরাট পাহাড়ের মতো ছিল। তারপরও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। চিকিৎসা করালে সুস্থ অবস্থায় সদর উপজেলার ঘড়–য়া গ্রামের এক বোবা লোকের সঙ্গে জয়ার বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর আবারো সমস্যা দেখা দিলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিছু দিন পর জয়ার বাবা হরি ঘোষ মারা যান। এরপর টাকার অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ের হয়নি কোনো চিকিৎসা।

ভারসাম্যহীন অবস্থায় বাড়ি থেকে হারিয়ে যেত সে।
প্রতিবেশীদের গাছপালা ভাঙচুরসহ বিভিন্ন রকমের ক্ষতি করার কারণে প্রতিবেশীরা অভিযোগ করলে নিরুপায় হয়ে জয়া ঘোষকে পায়ে লোহার শিকল ও তালা দিয়ে বেঁধে রাখেন অসহায় মা। অভাব-অনটনের পরিবারে ৬৫ বছর বয়সি বিধবা মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো মতে মেয়ের নুন-ভাতের খাবার জোটান।
গিয়াসনগর ইউনিয়ন অফিস থেকে পায়ে হেঁটে ৩ থেকে ৪ মিনিটের দূরত্বে জয়াদের বাড়ি। মা-মেয়ের জন্য জোটেনি প্রতিবন্ধী কিংবা বয়স্ক ভাতা। প্রতিবন্ধী দুই সন্তানের চিকিৎসার চিন্তা মা রেবা ঘোষের কাছে বিলাসিতার সমান। এরপর আর টাকার অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ের হয়নি কোনো চিকিৎসা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে বড় ভাই অনুকূল ঘোষ (৪০) মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, স্যাঁৎসেঁতে একটি ঘরের দরজাবিহীন অন্ধকার রুমে জয়া ঘোষকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে শিকলে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। মাটির উপর চট আর পুরনো একটি কাঁথা এবং মশারি টাঙানো। তার জন্য যে খাবার দেয়া হয়েছে তা বিড়ালের বাচ্চা খাচ্ছে। আমাদের দেখে জয়া দাঁড়িয়ে যায়। স্পষ্ট ভাষায় জয়া জানায়, বাইরে যেতে তার খুব ইচ্ছা করে। বাইরে যাতে যাইতাম না পারি সে জন্য পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জয়া আরো জানায়, বোবা বেটার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। এক মাস পর স্বামী ছেড়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আমার ভাইয়ের বৌ আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে যাতে বাইরে যেতে না পারি। জয়া পায়ের শিকল দেখিযে বলে, এত বড় তালা দেয়া হয়েছে এতে আমার পায়ে ব্যথা পাই। কান্নাকাটি করলেও তারা আমার পায়ের তালা খুলে দেয় না। মা আমারে কোনো ওষুধ দেয় না। ওষুধ খাইলে আমি ভালো হয়ে যাব। আমি আর কারো গাছপালা ভাঙব না।
জয়ার মা রেবা ঘোষ (৬৫) বলেন, আমার বয়স হয়েছে, এখন নিজের চলতেই কষ্ট হয়। তারপরও নিজের দুটি ভারসাম্যহীন সন্তানের জন্য মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ করছি। ইউনিয়নের মেম্বারের কাছে বয়স্ক ভাতার কার্ডের জন্য যোগাযোগ করেছি। তবে এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকেই কোনো সাহায্য পাইনি। তিনি আরো বলেন, জয়া এলাকার মানুষের বিভিন্ন ক্ষতি করাতে তাদের অভিযোগের কারণে নিরুপায় হয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে কাজে যাই।
অনুকূল ঘোষের স্ত্রী শুকতা ঘোষ (৩০) বলেন, আমাদের দুটি সন্তান রয়েছে। বাবা মানসিক অসুস্থ থাকায় ছেলেটা পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে আর মেয়েটা এখনো স্কুলে যাচ্ছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে। পরিবারে দুজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ থাকায় ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা চিন্তাভাবনা করে কোনো কিছু পাই না।
জয়া ঘোষের চাচা গৌরা ঘোষ (৬৫) বলেন, আমারও অভাব-অনটনের সংসার। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপন ভাইয়ের মেয়ের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করতে পারছি না। ভারসাম্যহীন ভাতিজি গ্রামের মানুষের ক্ষতি করে। মানুষজন নালিশ করেন। এই অবস্থায় মা অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করতে পারেন না। তাই ওকে বেঁধে রেখে কাজ করে পরিবারের খাবার জোটান।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর অপুষ্টিতে চোখ দুটি দেবে গেছে। জয়া বছরের পর বছর ধরে শিকলে বন্দি হয়ে আলো বাতাসহীন বদ্ধ ঘরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে। এ বিষয়ে সদর উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সুমন দেবনাথ বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। এখন যেহেতু জেনেছি, তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সদর হাসপাতাল বা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সেটারও ব্যবস্থা করব।
গিয়াসনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোশাররফ টিটু ভোরের কাগজকে বলেন, মৃত হরি ঘোষের মেয়ে ও ছেলে দুজনই মানসিক রোগী। এ অবস্থায় মেয়েকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় সব সময়। শিকল খুলে দিলে গ্রামের মানুষকে জ¦ালাতন করে। অসচ্ছল পরিবারকে ভিজিএফের চাল দেয়া হচ্ছে। জয়ার মায়ের বয়স্ক ভাতা কার্ড না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আগে কেনো কার্ড দেয়া হয়নি তা আমার জানা নেই। জয়ার মায়ের জন্য বিধবা ভাতা কিংবা বয়স্ক ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা করা হবে। সেই সঙ্গে জয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ করেন।
সরকারি সহযোগিতায় উন্নত চিকিৎসা পেলে জয়া শিকল বন্দি জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়