মামলায় জিতে টাকা ‘ইনকাম’

আগের সংবাদ

ভোক্তার সুফল কোন পথে : বাজেটে কর বাড়লে দাম বাড়ে, কর কমলে দাম কমে না, সরকারি সিদ্ধান্তের সুফল পান না ভোক্তারা

পরের সংবাদ

মুখপাত্রের মন্তব্যে দেশ-বিদেশে বিক্ষোভের ঝড়

প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে এক টিভি বিতর্কে করা নূপুর শর্মার মন্তব্য বিশ্বব্যাপী এক কূটনৈতিক ঝড়ের সৃষ্টি করেছে এবং দেশব্যাপী বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নামেন মুসলিমরা। নূপুর শর্মা ও আর এক বিজেপি নেতা জিন্দালকে ইতোমধ্যেই একজনকে বরখাস্ত ও অন্যজনকে পদ থেকে সরিয়ে শাস্তি দিয়েছে বিজেপি। নূপুর শর্মা তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা নূপুর শর্মাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন, অনেক জায়গাতে বিক্ষোভ থেকে নূপুর শর্মার ফাঁসির দাবিও করা হচ্ছে। আজ পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে।
কিন্তু যে মন্তব্য থেকে এই ঝড় তা এক কথায় কুরুচিকর। নবীজি বা রসুলের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মন্তব্য। কিন্তু নূপুর শর্মা মনে রাখেননি তার পিতামহ বা মাতামহ কত বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। কত বছর বয়েসের স্ত্রীকে তারা ঘরে এনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন মৃণালিনী দেবীকে যখন তার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। এটা বাস্তব ছিল এমনকি ১০০ বছর আগেও। তাহলে নূপুর শর্মা কেন এই মন্তব্য করেছিলেন? সাসপেন্ড হওয়া বিজেপি নেত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘আমি কয়েক দিন ধরেই টিভির বিতর্কে অংশ নিচ্ছিলাম। সেখানে প্রতিদিনই আমার আরাধ্য শিবকে অপমান করা হচ্ছিল। আমার সামনেই বলা হচ্ছিল, ওটা শিবলিঙ্গ নয়, আসলে ফোয়ারা। দিল্লির প্রতিটি ফুটপাতে অসংখ্য শিবলিঙ্গ পাওয়া যায়। যা-ও, গিয়ে পূজা কর। আমার সামনেই বারবার এভাবে মহাদেবের অপমান আমি সহ্য করতে পারিনি। আমি তাই রাগের মাথায় কিছু কথা বলেছি। যদি আমার কথায় কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তো আমি আমার কথা প্রত্যাখ্যান করলাম। কাউকে কষ্ট দেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না।’ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এমনকি হিন্দুদের মধ্যেও যে নূপুর শর্মা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে না জানতে পারেন কিন্তু হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল যে এমন কুরুচিকর মন্তব্য করলেন।
আক্ষরিক বিশ্লেষণে দেখা যায়- ‘শিব’ শব্দের অর্থ ‘মঙ্গল’ আর ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। শাস্ত্র ‘শিব’ বলতে নিরাকার সর্বব্যাপী পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মকে বোঝায়। তাই ‘শিবলিঙ্গ’ হচ্ছে মঙ্গলময় পরমাত্মার প্রতীক। অনেকেই ‘শিবলিঙ্গ’ বলতে পুরুষাঙ্গ বিশেষ মনে করেন- কিন্তু এটা ভ্রান্ত ধারণা। এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, নিরাকার পরমাত্মার পুরুষাঙ্গ থাকতে পারে না। তাছাড়া পুরুষাঙ্গের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘শিশ্ন’। আর ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ ‘প্রতীক’ বা ‘চিহ্ন’। শিবপুরাণ ও অন্য সব শাস্ত্রেই ‘শিবলিঙ্গ’ বলতে ‘পরমব্রহ্মের প্রতীক’ই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু তার পূজা নিয়ে কখনই বাড়াবাড়ি ছিল না। ইংরেজরা মনে করত, শিবলিঙ্গ পুরুষ যৌনাঙ্গের আদলে নির্মিত এবং শিবলিঙ্গের পূজা ভক্তদের মধ্যে কামুকতা বৃদ্ধি করে। নৃতাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার জন ফুলারের মতে, হিন্দু দেবতাদের মূর্তি সাধারণত মানুষ বা পশুর অনুষঙ্গে নির্মিত হয়। সেক্ষেত্রে প্রতীকরূপী শিবলিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। কেউ কেউ মনে করেন, লিঙ্গপূজা ভারতীয় আদিবাসী ধর্মগুলো থেকে হিন্দুধর্মে গৃহীত হয়েছে। এহেন অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে তার সঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা যদি বলেন যে বেনারসের জ্ঞানবাপী-শ্রীনগর এলাকায় অবস্থিত মসজিদের ফোয়ারাকে হিন্দুত্ববাদীরা শিবলিঙ্গ দাবি করলেও ওটা ছিল আদতে ফোয়ারা, তাতে শিব ঠাকুরের অবমাননা হয় কীভাবে?
ঝামেলাটা শুরু হয় যখন কাশি বিশ্বনাথ মন্দির-জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে সমীক্ষা করার অনুমতি দেয় আদালত। মসজিদকে ঘিরে বিতর্ক বাড়তে থাকায় এই অনুমতি প্রদান। তিন দিনব্যাপী চলা সার্ভের শেষ দিনে মসজিদে একটি কুয়োর মধ্যে শিবলিঙ্গ থাকার দাবি করা হয়। মসজিদ কমিটি জানায় যে এটি কোনো শিবলিঙ্গ নয়, একটি ফোয়ারা, সব মসজিদেই দেখা যায়। কিন্তু কোর্ট কমিশনার সেই কথায় কর্ণপাত না করে আদালত সরাসরি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে আদেশ দেন স্থানটিকে তৎক্ষণাৎ ‘সিল’ করার জন্য এবং সাধারণ মানুষকে ‘শিবলিঙ্গ’ থেকে দূরেই রাখার নির্দেশ দেয়া হয়, এতে ক্ষুব্ধ হন হিন্দুত্ববাদীরা। ব্যাস, হাতে টাটকা টপিক পেয়ে যায় সংবাদ মাধ্যম। শুরু হয় খাস্তা বিতর্কের আসর। সেখানেই করা নূপুর শর্মার এই অসতর্ক মন্তব্য তুলেছে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড়।
বিজেপি নূপুর শর্মা ও সমর্থনকারী অন্য পদাধিকারীকে বহিষ্কার করেছে। প্রকাশ্যে দল হিসেবে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু তাতে চিড়ে ভেজেনি। শুরু করেছিল ওমান। তারপর কাতার, কুয়েত, ইরান ও সৌদি আরবও সোচ্চার হয়। মহানবীকে (সা.) নিয়ে যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এই দেশগুলো। তারা চায় যে ভারত সরকার অবিলম্বে ওই মন্তব্যের নিন্দা করুক এবং সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে ক্ষমা চাক। আরেকটা দাবি উঠেছে যে নূপুর শর্মাকে গ্রেপ্তার করা হোক। এই দুটি ক্ষেত্রেই ফেঁসে গেছে ভারত। কোনো দলের একজন মুখপাত্রের (যতই সে ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র হোন না কেন) কুরুচিকর মন্তব্যের জন্য সরকার ক্ষমা চাইলে ভবিষ্যতে যে কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের অর্বাচীন মন্তব্যের জন্যও তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। ব্যক্তিগত মন্তব্যের দায় সরকার নেবে কীভাবে? দ্বিতীয় দাবি যে নূপুর শর্মাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এই মহিলার নামে দেশব্যাপী প্রচুর মামলা হয়েছে এবং একই ইস্যুতে। ভারতের সংবিধানের বাকস্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগ। কাজেই ব্যাপারটা এখন আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। সরকারকে আদালতের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এটা ঠিক যে ভারতীয় আইন এই হঠকারিতাকে আজ অবধি প্রশ্রয় দেয়নি। কাজেই সময় ও ধৈর্য রাখতে হবে। ভারতীয় পণ্য বর্জন বা বিক্ষোভ যতই দেখানো হোক ভারত সরকার চাইলেও সংবিধান লঙ্ঘন করে কিছু করতে পারবে না। মাঝখান থেকে আইনভঙ্গকারী হিসেবে কিছু সাধারণ বিক্ষোভকারী কেস খাবে। সেটা কাম্য নয়। এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে নূপুর শর্মা যে মন্তব্য করেছেন তা চূড়ান্ত নিন্দার্হ এবং ভারতীয় পরম্পরা বিরোধী। ভারতে ২৩ কোটি মুসলমান বাস করেন এবং তাদের নিয়েই দেশ। এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ আদালত নেবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা উচিত। একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্ব ও বিক্ষুব্ধ ভারতীয় মুসলমানদের উচিত সরকার ও আদালতকে সময় দেয়া।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়