মামলায় জিতে টাকা ‘ইনকাম’

আগের সংবাদ

ভোক্তার সুফল কোন পথে : বাজেটে কর বাড়লে দাম বাড়ে, কর কমলে দাম কমে না, সরকারি সিদ্ধান্তের সুফল পান না ভোক্তারা

পরের সংবাদ

বাজেট ২০২২-২৩ : কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হতে হবে

প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মিডিয়াকে জাতির তরফ থেকে ধন্যবাদ এ জন্য যে, নির্বাহী বিভাগ প্রণীত বাজেটের ওপর আইন বিভাগের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণে দৃশ্যমান অবর্তমানে আমজনতা যখন মর্মাহত তখন মিডিয়াই মেলবন্ধনের দায়িত্বটি পালন করছে। বাজেট বক্তৃতা বা প্রস্তাব এখন স্বকণ্ঠে পঠিত বা উচ্চারিত হয় না, তার আকার এত বড় যে দৈনিক পত্রিকায় পেস্ট করার অবকাশ এখন আর নেই। সাধারণ মানুষ যখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পোর্টালে গিয়ে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষমেশ তথ্যচিত্রের ঢাউস ভিডিও ডাউনলোড করে দেখা বা শোনার হিম্মত রাখে না ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উত্তর দক্ষিণে দিগন্ত বিস্তৃত কূট তর্ক-বিতর্ক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন ও কলাম লেখকদের পর্যালোচনা পাঠে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বলাবাহুল্য উন্মুক্ত পরিবেশেই বাজেট শোনা দেখা পাঠ পর্যালোচনার প্রথা বা রীতি ‘সীমিত’ হয়ে যাচ্ছে, মিডিয়ার যথাসম্ভব প্রয়াস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও।
বাজেটে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া কথিত কালো টাকা দেশে ফেরানোর জন্য যে বিশেষ সুযোগ (এমনেস্টি বা দায়মুক্তি) প্রস্তাবিত হয়েছে সে সম্পর্কে অনেক কিছুই স্পষ্টিকরণের অবকাশ থাকলেও তা তথ্যচিত্রের ভাষার সঙ্গে মুদ্রিত এবং সীমিত পরিসরে বিলিকৃত/ওয়েব পোর্টালের পিডিএফের মধ্যে শব্দগত পার্থক্য পরিলক্ষিত এমনকি বাজেট প্রস্তাব পরবর্তী ট্রেজারি বেঞ্চের সংবাদ সম্মেলনে দায়িত্বশীলদের ব্যাখ্যার মধ্যে গরমিলের মধ্যেই বাজেটের পাঠোন্মোচনকে সীমিতকরণ ও ধোঁয়াশে হওয়ার বা করার ইঙ্গিত মিলছে। বিদেশে পাচারকৃত টাকার মধ্যে দেশের মানুষের হক আছে এবং পাচারকৃত টাকার সংজ্ঞা দিতে যখন বলা হচ্ছে ‘বিদেশে উপার্জিত টাকা’ তাহলে বুঝতে কষ্ট হবে বিদেশে প্রবাসী শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীরা যে আয় (পারিশ্রমিক) উপার্জন (ব্যবসার মাধ্যমে) তাদেরও এই এমনেস্টির আওতায় এনে প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের ওপর করারোপের এবং তাদের জনসমক্ষে হেয় করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কারণ কিছুদিন আগে ৫ হাজার ডলার প্রত্যাসনের লিমিট তুলে দেয়া হয়েছে এবং কোনো কাগজপত্র দেখাতে হবে না। কাগজপত্র যদি দেখাতে না হয় তাহলে কীভাবে প্রবাসী শ্রমিক ও ব্যবসায়ী শনাক্ত হবেন। তাই যদি না হয় তাহলে তো তাদেরও কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না, কাগজপত্র দেখাতে হবে না কিংবা ‘প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে না’ বলে কি সবাইকে এক পাল্লায় মাপার আয়োজন উদ্যোগ নেয়া হবে এবং এমনকি যারা এই সুযোগ এখন দিচ্ছেন তাদেরও (যদি কেউ থাকেন) ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষার আগাম জামিনের পথ করে রাখা হচ্ছে এ সংশয় সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। টিআইবির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সে আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে। এ সবই নিরসনের জন্য এই স্কিমটি আইন আকারে জনমত/সংসদে পরীক্ষা পর্যালোচনার জন্য দেয়া জরুরি। তড়িঘড়ি করে ধারণার আইন পাস করে, মাস দুই সময় নিয়ে কর পরিপত্র ১-এর মধ্যে নীতিমালা ও বিধিবিধান জারি করে তা বাস্তবায়নে গেলে ‘দুনীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার ওপর দেশের মানুষের হক আছে’, সে হক আদায় হবে না কিংবা ‘ঘুষ গ্রহণ ও প্রদানকারী দুজনেই দোজখে যাবে’ তা নিশ্চিত করা যাবে না। বাজেটে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার ঘোষণাকে, আইন কানুন তৈরি না করে ‘সর্বজনীন পেনশন চালু’ করার ঘোষণাকে রাজনৈতিক উৎকোচ হিসেবে যাতে ধারণার চৌহদ্দিভুক্ত না হয় তা সবাইকেই খেয়াল রাখতে হবে।
রিজার্ভে কেন টান পড়বে সে কারণ ও কার্যকারণ থেকে দৃষ্টি সরাবার জন্য, চড়াই উৎরাই পেরোবার জন্য পাচারকৃত টাকা (যা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ) অন্যায় ও অনৈতিকভাবে ‘ডলারে’ আনার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে কিনা এ ধরনের ধারণার উদ্ভব যাতে না হয় সেদিকে ভূত-ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই অগ্রসর হওয়া প্রযোজন। জনগণের দেয়া করের টাকা আত্মসাৎ ওরফে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করা টাকাকে বিশেষ হ্রাসকৃত কর দিয়ে আনার সুযোগ দিলে দেশের নিরপরাধ করদাতা ও পরিশ্রমী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে করারোহণ, করদাতা হওয়ার জন্য আহ্বান কিংবা বাধ্যকরণে কর্তৃপক্ষের নৈতিক ও আইনগত অধিকার প্রশ্নের সম্মুখীন হবে কিনা সেটাও বিবেচনা করা সমীচীন হবে। যে কোনো দেশের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্গতিকে আমলে নেয়া হয় এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতির পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্নও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো কোথায় এবং কেন আয় বা ব্যয় করব, কী পরিমাণ এবং কীভাবে আয় বা ব্যয় করব? তার মানে হলো, অর্থ আয় ব্যয়ের উদ্দেশ্যটা যদি রাজনৈতিক হয় তাহলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাúনায় রীতিনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, ফলে গোটা কাঠামোটা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা পরিব্যাপ্ত হবে। জনগণের টাকায় পরিচালিত বাজেট যদি মাত্র ১ শতাংশের একটি ক্ষুদ্র (ধনিক) শ্রেণির স্বার্থে প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বাজেট হবে জনমুখীর পরিবর্তে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণিমুখী বাজেট। বাজেট প্রস্তাবিত হতে হবে ‘বৈষম্যহীন আলোকিত মানুষসমৃদ্ধ সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে’, বাজেটের সবকিছুই নব্য উদারবাদী মতাদর্শের মুক্তবাজার আর করপোরেট-স্বার্থীয় সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রকদের বিশ্বায়নের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে কিনা সে সিদ্ধান্তে জনমত যাচাই করে নেয়াটা বাজেটকে গণমুখী পদবাচ্যকরণ অর্থবহ হবে না। গতানুগতিকতার মধ্যে থাকার অবকাশ ফুরিয়ে আসছে। নমিনাল টার্মে জিডিপি বাড়লেও বাড়তে পারে; মাথাপিছু আয় বাড়লেও বাড়তে পারে; কিন্তু তাতে বৈষম্য-অসমতা না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অভীষ্ট বাস্তবায়ন হবে সুদূরপরাহত। দেশে বৈষম্য-দারিদ্র্যের বিপজ্জনক প্রবণতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, শোভন কর্মবাজারের সংকোচন, একইসঙ্গে এই প্রবণতায় করোনাকালীন এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাত, অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বাজেটসহ সব উন্নয়ন দলিলে এসব ভাবনা ও বিবেচনাদের ঠাঁই পেতে হবে।
করোনা অতিমারি এবং পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে, পড়ছে। তাই বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে সরকারকে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আমলে নিতেই হয়েছে- প্রথমত, ডলার সংকট। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি। তৃতীয়ত, জ্বালানি সংকট। চতুর্থত, কর-জিডিপি অনুপাত। এ চারটি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে একটি সুযোগ বাংলাদেশের হাতে এখনো আছে। কর্মক্ষম জনগেষ্ঠীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো ১৫-৬৪ বছর বয়সি জনসংখ্যা। এটাকে বলে জনমিতি ডিভিডেন্ট বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট। আশার কথা, এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বাংলাদেশের অনুকূলে আছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ এই স্তরে অবস্থান করছে। যদি প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তোলা যায়, তাহলে উৎপাদনশীলতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। অদক্ষ শ্রমিকের পরিবর্তে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাজেটে মোটাদাগে তেমন পরিকল্পনার আভাস মেলেনি।
সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা থাকলেও তা সর্বাংশে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যবসা বৃদ্ধি না হলে মানুষের আয় না বাড়লে সরকার রাজস্ব বাড়াবে কীভাবে? কঠিন প্রশ্ন। ব্যবসায়ীরা করের হার কমাতে চান। মধ্যবিত্তের কর দেয়ার ক্ষমতা সীমিত। অতএব টাকা ধারের ব্যবস্থা করতে হবে- হয় বিদেশ থেকে, নয়তো দেশের ভেতরে। বিদেশি ঋণের মাত্রা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। ঋণের টাকা পরিশোধের ক্ষমতা সম্পর্কে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছে। আবার দেশের ভেতরে আমানতের ওপর সুদের হার বাড়ছে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেপো’র হার বাড়িয়েছে। ‘রেপো’ বাড়ানো মানে ব্যাংকগুলো এখন বেশি সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে। তাহলে তাদের ঋণের ওপর সুদের হার বাড়াতে হবে।
রয়েছে খরচ কমানোর প্রশ্ন। কী আর করা? আয় না বাড়াতে পারলে খরচ তো কমাতেই হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? বেতন-ভাতা ব্যয় তো কমানোর পরিবর্তে উপায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো। আরেকটি হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে খরচ কমানো। অথবা মেগাপ্রকল্পে ধীরগতি আনা। এটি হলে ইট, বালু, সিমেন্ট, রড ও ইস্পাত শিল্পের প্রভূত ক্ষতি হবে। পরিণামে ভুগবে ব্যাংকগুলো। এসব শিল্প ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারবে না।
মোট কথা, কঠিন এক সময়ের মুখোমুখি সবাই। খরচ কমানো, রাজস্ব বৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, ভর্তুকি বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, চালের সরবরাহ ঠিক রাখা, ডলারের দাম ঠিক রাখা, ব্যাংকগুলোর তারল্য ঠিক রাখা, রেমিট্যান্সের প্রবাহ ঠিক রাখা, সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় এবার বাজেট প্রণয়নকে জটিল করেছে সন্দেহ নেই।
বিলাসী পণ্যের ওপর নতুন করে করারোপ করা হলেও আমদানি বন্ধ করা হয়নি। এর ফলে হয়তো এসব পণ্যের আমদানি কিছুটা কমবে। সাধারণ মানুষের জীবনে এর কী প্রভাব নিয়ে বিবেচনায় থাকবে বিলাসী পণ্যের ভোক্তা সীমিত আয়ের মানুষ নন। এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই বলাই চলে পক্ষান্তরে, এসব পণ্যের ভোক্তাদের কাছে মূল্যবৃদ্ধি আর্থিক ক্ষতি ছাড়া কিছু নয়। কারণ তাদের আর্থিক সক্ষমতা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি এবং তাদের আয়ের অনেক উৎস থাকে। ফলে তাদের বিলাসিতা হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু বন্ধ হবে না। যখন দেশের বেশিরভাগ মানুষ জীবন ধারণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন কিছু মানুষের বিলাসিতা অব্যাহত রাখার প্রয়োজন কতটা তা ভাবার বিষয়। যখন ডলারের অতিমূল্য ও সংকট, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশের সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখন দেশে বিলাসী পণ্য কিছুদিন আমদানি না করলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিলাসী পণ্য ভোগবাদী সমাজের জন্য, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য জরুরি কিছু নয়। এটা কি সামাজিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? সমাজে যদি ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়, তাহলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যে ব্যবধান কমানোর কোনো বিকল্প নেই।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, উন্নয়ননীতির বিশ্লেষক; সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়