ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যশুরু

আগের সংবাদ

অর্থ পাচার উৎসাহিত হবে! পাচার হওয়া টাকা অর্থনীতির মূল¯্রােতে আনতে চান অর্থমন্ত্রী > বৈষম্যের শিকার হবেন সৎ করদাতারা : বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অপেক্ষায় দক্ষিণাঞ্চলবাসী

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এম. কে. রানা, বরিশাল : দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার খুলছে আগামী ২৫ জুন। জীবনযাত্রা, অর্থনীতি আর যোগাযোগের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ক্ষণগণনা শুরু করেছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এ সেতু চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার খুলবে এমনটাই আশা করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের কারণে সময়ের পাশাপাশি কমবে পণ্য পরিবহনের খরচ। স্থানীয়রা বলেছেন, যাতায়াতে নদীপথের সহজলভ্যতা, আকাশপথ আর এখন পদ্মা সেতুর কারণে ফেরিবিহীন সড়ক বরিশালের ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল
পরিবর্তন : পদ্মা সেতু চালু হলে যাতায়াতের দুর্ভোগ কমিয়ে বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থার ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুুষের যাতায়াতের দূরত্ব কমবে, বাড়বে অর্থনৈতিক যোগাযোগ। এছাড়া পদ্মা সেতুর বুক চিরে ট্রেন চালুরও প্রস্তুতি চলছে। সেজন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। জানা গেছে, সেতুটি চালু হলে দেশের জিডিপির পরিমাণ বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এককথায় বদলে যাবে গোটা দেশ।
যানবাহনের চাপে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কা : পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের সড়কগুলোতে বাড়বে

যানবাহনের চাপ। এটি বিবেচনায় রেখেই ২০১৬ সালে ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ফোর লেন করার প্রাথমিক কাজ শুরু করে সড়ক ও সেতু বিভাগ। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর ওই প্রকল্পে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ছয় লেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণের অনুমোদন দেয় সরকার। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা ও পায়রাবন্দর পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার। এই সড়কের প্রস্থ মাত্র ২৪ ফুট। বর্তমানে এ সড়কে চলাচল করতে হিমশিম খাচ্ছে যানবাহন। মোটকথা বরিশালসহ বিভাগের অন্যান্য সড়ক তেমন প্রশস্ত না হওয়ায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কাও রয়েছে।
বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের আগেই বরিশাল শহরের ১২ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় শহর বরিশালকে যানজটমুক্ত রাখতে নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিতে সিটি করপোরেশনকে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বিভাগীয় প্রশাসনের এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস টার্মিনালকে কাশিপুরে নির্মিত ট্রাকস্ট্যান্ডে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কৃষি খাতে বিপ্লব : দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে ধান চাষের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কৃষিপণ্য চাষাবাদের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। সেতু চালু হলে বরিশাল অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা সহজ হবে। এমনটাই মনে করছেন এসব অঞ্চলের কৃষকরা। বরিশালের কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল আলম জানান, বরিশালে ধান, নারিকেল, সুপারি, আমড়া, তেজপাতা, পেয়ারার পাশাপাশি এখন তরমুজের চাষও হয়। এতদিন এসব পণ্য রাজধানীতে পাঠানো ছিল দুঃসাধ্য। সেতু চালু হলে তা সহজ হয়ে যাবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়বে, অবদান রাখবে জাতীয় অর্থনীতিতে : পদ্মা সেতুর সঙ্গে এই অঞ্চলের অনেক অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে। এই সেতুর কারণে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়ে যাবে। পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, ফোর লেনের পায়রা সেতু, শেরেবাংলা নৌঘাঁটি ও ইপিজেড স্থাপিত হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। একই সঙ্গে মোংলা ও পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বাড়বে। আধুনিকায়ন হলে পায়রাবন্দর ভবিষ্যতে এক বৃহত্তম বন্দরে পরিণত হবে। এমনকি ভুটান, পূর্ব নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্যগুলো পায়রার মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে উপকৃত হবে।
পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পড়বে প্রভাব : পদ্মা সেতু চালু হলে সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী জেলার পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের দূরত্ব কমবে। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সৈকতবিশিষ্ট কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। এছাড়া দুর্গাসাগার, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, নেছারাবাদের আটঘর-কুড়িয়ানায় ভাসমান পেয়ারা বাজার, গৈলা মনসা মন্দির, গুঠিয়া মসজিদ, বার্থি তারা মায়ের মন্দিরসহ বরিশালে আরো অনেক সম্ভাবনাময় পর্যটন স্থান আছে।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা থেকে কুয়াকাটার বিস্তৃত এলাকা ঘিরে পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান করতে যাচ্ছে সরকার, যার মনিটরিং করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মাস্টারপ্ল্যানে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটন স্থাপনা, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ণ, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতে উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ ঝুঁঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাভিত্তিক কার্যক্রম।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে উন্মুক্ত হবে বরিশালের সবকটি বাণিজ্যিক দ্বার। এই অঞ্চলের সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতে, পটুয়াখালীর পায়রা বা লেবুখালী সেতু চালুতে বরিশাল তথা এ বিভাগের ছয় জেলার ভাগ্যোন্নয়নের বাণিজ্যিক দ্বার উন্মুুক্ত হয়েছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ফলে শুরু হওয়া বাণিজ্যিক যাত্রার সফলতা পেতে হলে ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আসা নিশ্চিত করতে হবে। এটা হলেই সুফল পাবে বিভাগের ছয় জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে আনন্দ-উচ্ছ¡াস ততটাই বাড়ছে। ইতোমধ্যে সর্বস্তরে শুরু হয়েছে ক্ষণগণনা। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশালে যানবাহনের চাপ বাড়বে এবং এতে বাড়বে মানুষের দুর্ভোগও। বিশেষ করে সরু সড়ক সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশিমাত্রায় ভাবিয়ে তুলছে।
শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু একটি আত্মমর্যাদার নাম, একটি সাহসের নাম, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার নাম। এই সেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে অহংকার ও মর্যাদার জায়গায় নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব?্যাংকে চ?্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন এ জন্য আমরা গর্বিত। পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ হবে, তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থান। তবে এর পাশাপাশি সেতু চালু হওয়ার পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত সরু সড়কপথের কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এজন্য খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফোর লেন সড়ক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) প্রলয় চিসিম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে, সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজ যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো যাবে। ফলে কৃষকরা লাভবান হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পেলে ট্রাফিক বিভাগে জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাফিকের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়া হবে, যাতে করে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে না হয়।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন-উল আহসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে পায়রা সেতু চালু হওয়ায় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশের ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হবে। দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়