প্রধানমন্ত্রী : অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি করব না > শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাল সংসদ

আগের সংবাদ

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী : পাচারের টাকা ফেরত আনব

পরের সংবাদ

পদ্মা সেতু হবে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান : বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিমত

প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাবুল আকতার, খুলনা থেকে : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোনে রূপান্তরিত করবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতু জাগাবে পিছিয়ে পড়া ২১ জেলাকে। এ অঞ্চলের ৫ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এই সেতু। আশার আলো দেখছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করবেন- সেই প্রতিক্ষার প্রহর গুনছেন তারা। সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন এখন পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের মানুষ।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়। এরপর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য। মোংলা বন্দরসহ এই অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে ছোট-বড় নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী নানা ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা; বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার সাধারণ মানুষ এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর খুলনা বিভাগে বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে জুট এন্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইসমিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড এন্ড এলাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, পোল্ট্রি এন্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং, উড এন্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডক ইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টস এন্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টস, নির্মাণশিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প।
খুলনা ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন এ দেশের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ হবে। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রমাণ করলেন এই দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সব কাজ করা সম্ভম। নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিন। চ্যালেঞ্জের মুখে এই পদ্মা সেতু নির্মাণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ বাড়বে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন হবে। বেনাপোল এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বাড়বে। বাড়বে জিডিপি, হবে দারিদ্র্য বিমোচন। তিনি বলেন, দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্প থেকে এক সময় রপ্তানির মাধ্যমে আয় অধিকাংশ খুলনা থেকে হতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সেই শিল্প আবারো তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে, আয় আরো বাড়বে। পাশাপাশি কমে যাবে পণ্য পরিবহনেরও খরচ। একইভাবে পদ্মা সেতুতে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন, সাধারণ মানুষের যাতায়াতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচিত হবে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেবে। তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে জ্বালানির চাহিদা নিশ্চিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুগান্তকারী উন্নয়ন হবে। এ অঞ্চলের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি আসবে, আয় বৈষম্যও কমে যাবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে দেশে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ভবিষ্যতে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারবে বলেও জানান আলহাজ মিজান।
বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, চট্টগ্রামে আমার একটি কারখানা ছিল। পদ্মা

সেতু হওয়ায় চট্টগ্রামের ওই সম্পত্তি বিক্রি করে বাগেরহাটে শিল্প গড়েছি। আমার মতো অনেকেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাতেই নতুন নতুন শিল্প গড়ে তুলছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৯০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হলেও মোংলা থেকে হয় মাত্র ১০ শতাংশ। আর পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা থেকে রপ্তানি হবে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পণ্য। সেই সঙ্গে মোংলা বন্দর থেকে গার্মেন্টস পণ্যও রপ্তানি হবে। যা এখন চট্টগ্রাম থেকে শতভাগ রপ্তানি হয়। এর ফলে মোংলা বন্দরে জাহাজের সংখ্যা বাড়বে। এতদিন বন্দরকে কেন্দ্র করেই চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে আসছিল। যেটি এখন মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে খুলনাঞ্চলে হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সুফল পেতে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এই সময়ে ভ্যাট, ট্যাক্স আরোপের নামে অহেতুক হয়রানি করা না হলে ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলকে বেছে নেবে। ইতোমধ্যে ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং খুলনার খালিশপুরের অর্থনৈতিক জোনের সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চল হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী।
খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের মানুষের আন্দোলনের ফসল। এই পদ্মা সেতুর জন্য খুলনাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, মিছিল করেছে এমনকি রাতেও অবস্থান করেছে। খুলনার মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছিল প্রধানমন্ত্রী সেটি বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছেন তিনি এ দেশের মানুষের সঙ্গে আছেন। যদিও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ করার বিষয়ে অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং সেনাবাহিনীর সঠিক তদারকির মধ্য দিয়ে এ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়। যেটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতুর নামের ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অনেকটা উদার। ২৫ জুন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ উচ্চ আদালতের সুফল ভোগ করবে। পদ্মা নদীর বাঁধার কারণে আগে এ অঞ্চলের বিচারপ্রত্যাশীদের এমনকি অনেক সময় আইনজীবীদেরও বিচারপ্রত্যাশীদের সহযোগিতা দিতে ঢাকায় গিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। সেটির আর এখন প্রয়োজন হবে না। এখন দিনে দিনেই ঢাকায় গিয়ে আদালতের কাজ সেরে খুলনায় ফিরে আসা যাবে। অর্থাৎ শুধু যে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীরা সুবিধা পাবেন তা নয়, আইনজীবী ও বিচারপ্রত্যাশীরাও পাবেন পদ্মা সেতুর সুফল।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি একটি বড় অর্জন। এই সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আঞ্চলিক বৈষম্য কমে যাবে। নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপিত হলে এখানকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। তিনি আরো বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। এ বনকে ঘিরে রয়েছে অপার রহস্য। সুন্দরবন দেখার জন্য প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে হাজারো পর্যটক। নানা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে তাদের এখানে আসতে হয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আর কোনো সমস্যা থাকবে না। ফলে পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে দেশের রাজস্ব। আশরাফ বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য খুলনা থেকে ঢাকা যাওয়া-আসার সময় সাশ্রয় হবে। এখন ঢাকায় যেতে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগে। ফেরি পারাপারের ওপর নির্ভর করেতে হতো, কত সময় লাগবে। ফেরিতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেতু চালু হওয়ার পর টোল দিয়ে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে পদ্মা নদী পার হওয়া যাবে। তিনি বলেন, এই পদ্মা সেতু মাওয়াতে নির্মাণের জন্য বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি ২১ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নানা কর্মসূচি পালন করেছিল। সর্বশেষ ২০০৪ সালের মার্চ মাসে মাওয়া ঘাটে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে এ অঞ্চলের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন বলেও জানান বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়