প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
নিমতলী, চকবাজার, তাজরীন এবং এফ আর টাওয়ার ট্র্যাজেডির অধ্যায় পার হয়ে ২০২২ সালের জুনে সীতাকুণ্ডে জন্ম হয় আরেক ট্র্যাজেডি। সেই ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজেডিতে পুড়ে যায় ১১৭ জন, ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিদগ্ধ হয় ৭১ জীবন্ত মানুষ। আর একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ার ট্র্যাজেডি এই বার্তা দেয় যে, কী ধনী কী গরিব কেউ আর নিরাপদ নন। এই বছরের ৫ জুন রাতে আরেক ট্র্যাজেডির জন্ম হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ডিপোতে আগুন ধরার পরে বিস্ফোরিত হয় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের কন্টেইনার। ডিপোর এই মৃত্যুকূপে অর্ধশত জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় দুই শতাধিক।
সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপো কীভাবে অগ্নিকুণ্ডে রূপ নিল? কেমন করে এত মানুষকে লাশ হতে হলো? আমাদের দায় দায়িত্ব কতটা বেসামাল হলে এমনটি হতে পারে? বিএম ডিপো তো দেশি-বিদেশি সমন্বয়ে যৌথ মালিকানাধীন রপ্তানি প্রতিষ্ঠান। তবু এ অবস্থা কেন? চকবাজার ট্র্যাজেডির কারণ ছিল এখানে লাইসেন্স ছাড়াই কেমিক্যালের ব্যবসা হতো, যা ছিল কর্তৃপক্ষের নজরদারির বাইরে। অথচ বিএম তার রপ্তানি বাণিজ্য করছে প্রকাশ্যে, নজরদারির সম্মুখে। সেই বিএম ডিপোতে কী করে ঘটল এমন হত্যাকাণ্ড? এটি শুধু দুর্ঘটনা নয়, বরং অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত প্রকাশ। তা না হলে ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীকে এমন মৃত্যুকূপে আত্মাহুতি দিতে হতো না। যেই ডিপোতে বহু ধরনের দাহ্য ও অদাহ্য রাসায়নিক পদার্থ আছে সেই ডিপোতে দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা থাকবে।
আমার প্রশ্ন হলো, সেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশকে নিরাপদ রাখার প্রস্তুতি কতটুকু ছিল? নাকি দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঝুঁকি স্রেফ ভাগ্য বা নিয়তি নামে চালিয়ে দেবো? সড়ক দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এই ঘটনাকে কি প্রাকৃতিক মনে করব? মূলত বর্তমান সময়ে ঝুঁকির মাঝে বসবাস শুধু মানসিক প্রকৃতি নয়, অতি বাস্তব। কেননা, জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনও এখন আর প্রাকৃতিক নয়, অনেক বেশি মাত্রায় অতি শিল্পায়নের ফল। ঠিক তেমনি, ডিপোর এই বিপর্যয়কে ভাগ্য বা প্রাকৃতিক বলার কোনো কারণ নেই। সামগ্রিক দিক বিবেচনায়, এ ধরনের এক একটা বিপর্যয়কে মানুষের কর্মের ফল হিসেবেই দেখতে পারি।
সেই দিক বিবেচনায়, সমাজবিজ্ঞানী উলরিচ বেক বর্তমান বিশ্বের সমাজব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ সমাজ নামে অভিহিত করেন। বেক তার রিস্ক সোসাইটি (১৯৯২) নামের বইয়ে উল্লেখ করেন, শিল্পায়িত সমাজের বিকাশের ধারা থেকে রিস্ক বা ঝুঁকিপূর্ণ সমাজের আবির্ভাব। ঝুঁকির মাত্রা ও প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, ঝুঁকি কোনো সময়, হিসাব ও প্রত্যাশার ছক মেনে চলে না। ঝুঁকি ও তার ক্ষয়ক্ষতি এতই বহুমাত্রিক ও ধারণাতীত যে, বেক এর মতে ঝুঁকি থেকে রক্ষার দায়দায়িত্ব এখন আর বিজ্ঞানের সীমা পরিসীমা দ্বারা নিরূপিত হয় না; বরং অনেক বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা দ্বারা পরিচালিত। এ কারণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাই এই সময়ের অন্যতম প্রজেক্ট হিসেবে সমাদৃত। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য লন্ডনে ইনস্টিটিউট অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বা আইআরএম (ওজগ) নামক প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর ধরে কাজ করে চলছে। এই প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের বা মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট মডেলের আলোকে কাজ করে চলছে। এর অংশ হিসেবে আইআরএম ৩ ধরনের এথিক বা নীতির চর্চাকে গুরুত্ব প্রদান করে : ১) বাধ্যবাধকতার নীতি (বঃযরপ ড়ভ ড়নবফরবহপব) ২) পরিচর্যার নীতি (বঃযরপ ড়ভ পধৎব) ৩) বিচারবুদ্ধির নীতি (বঃযরপ ড়ভ ৎবধংড়হ)। এসব নীতির বাস্তবায়নে সহায়ক হিসেবে আইআরএম তত্ত্বাবধানের দুটি ফ্যাক্টর উল্লেখ করে : ১) জবাবদিহিতা (ধপপড়ঁহঃধনরষরঃু), ২) স্বচ্ছতা (ঃৎধহংঢ়ধৎবহপু)।
বাধ্যবাধকতার নীতিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের আইন কানুন মানতে বাধ্য। বাংলাদেশের শ্রমবিধিতে বলা আছে, কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের ১৮ শতাংশ কর্মী এমনভাবে প্রশিক্ষিত থাকবেন যাতে করে অগ্নিকাণ্ড হলে সহজেই মোকাবিলা করা যায়। অথচ ডিপোতে আগুন ধরার পরে তাৎক্ষণিকভাবে এখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো কাজ করা হয়নি। যদি সঙ্গে সঙ্গে আগুন নেভানোর কাজ হতো, তাহলে আগুনের তাপ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের কন্টেইনার পর্যন্ত যেত না। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড তাপীয় বিয়োজনে বিস্ফোরক হয়ে যায়। সেই হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ২৬টি কন্টেইনারকে আলাদাভাবে নিরাপদ দূরত্বে না রাখার দায়ও বিএমকে নিতে হবে। আসলে সরকারের কাছে জবাবদিহিতার কালচার না থাকার প্রেক্ষিতে আইনের লঙ্ঘন এদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার।
পরিচর্যার নীতিও কি মানা হয়েছে? সীতাকুণ্ড ও কুমিল্লার ফায়ার সার্ভিসকে অগ্নিকাণ্ডের খবর জানিয়েছে সাধারণ মানুষ, বিএম কর্তৃপক্ষ থেকে তারা কোনো ফোনকল পায়নি। এ কারণে ফায়ার সার্ভিস যথারীতি আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে নেমে পড়ে। তথ্য উপাত্ত ছাড়া ভুল পদ্ধতিতে আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জীবন দিতে হলো। এ ধরনের ডিপোতে অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্রেট রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। তদন্তে দেখা গেছে এখানে কোনো ফায়ার হাইড্রেট ছিল না। বিএম ডিপোর চেয়ারম্যান নেদারল্যান্ডসের বারট ফ্রঙ্ক হলেও পরিচর্যা নীতি ছিল উপেক্ষিত। তাছাড়া পরিবেশ দপ্তরের পক্ষ থেকে তদারকির ঘাটতি থাকায় বা দপ্তরকে ম্যানেজ করার রীতিতে সংকট ঘনীভূত হয়।
বিচারবুদ্ধি নীতির প্রায়োগিক দিকও ছিল দুর্বল। এ ধরনের রপ্তানি প্রতিষ্ঠান সাময়িক মুনাফাকে গুরুত্ব দিলে ব্যবসায় স্থায়িত্ব হারানোর সুযোগ রয়েছে। বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ থাকলে বিএম এতটা উদাসীন হতে পারত না; আর স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফার নীতিতেও চলত না। শুধু মুনাফাই যার উদ্দেশ্য তার কাছে নিরাপত্তার গুরুত্ব কম। আমাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান শুধু মুনাফা খোঁজে। মুনাফার এই তাড়না এতই প্রকট যে, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো রাসায়নিকের কন্টেইনার থাকা সত্ত্বেও এখানে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। দেখা গেছে, ডিপোর মধ্যে ১০-১২টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র অব্যবহৃত পড়ে আছে। মূলত অগ্নিনির্বাপণের জন্য টাকা খরচ করতে মালিকরা রাজি নয়। নিমতলী, চকবাজার, তাজরীন আর বনানীর এফ আর টাওয়ার ট্র্যাজেডি থেকে কোনো শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা তারা নেয়নি।
শুধু তাই নয়, ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সক্ষমতা আর সামর্থ্য। আইআরএম সেজন্য সক্ষমতার দুটি দিক তুলে ধরে- ১) ঝুঁকি মোকাবিলার পর্যাপ্ত সম্পদ (ৎরংশ-ৎবংড়ঁৎপব) ২) ঝুঁকি মোকাবিলার দক্ষতা (ৎরংশ-ংশরষষ)। ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন তা যদি উক্ত প্রতিষ্ঠানের না থাকে, সেই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। অগ্নিনির্বাপণের জন্য বহুমাত্রিক উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতেই হবে। সময়মতো সব তথ্য সরবরাহের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে তার মান ও মাত্রা অনুযায়ী পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তিগত জোগান নিশ্চিত না করলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান বা কারখানা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ আছে তার তালিকা বা ডাটাবেস তৈরি করে ঝুঁকি মোকাবিলার সামর্থ্য অর্জন করতে সময় বেঁধে দিতে হবে। ন্যায্যতার নীতিতে যেসব প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করেছে তাদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সনদ দিয়ে পুরস্কৃত করতে হবে। ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতার মান অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গ্রেডিং করে তদনুযায়ী প্রতি বছর পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা আর ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা নিশ্চিত না করলে আইনগত ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। অব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে তার জন্য শাস্তির বিধান কার্যকর করতে হবে। আমরা চাই, ন্যায়ানুগ তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা হোক। দেশের সব কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের ন্যায্যতা যাচাই ও তদানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ অত্যাবশ্যক। এর জন্য আমূল সংস্কার জরুরি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।