রাজধানীর বছিলায় জুতার কারখানায় আগুন

আগের সংবাদ

সংসদে প্রধানমন্ত্রী : দেড় বিলিয়ন ডলার সহায়তা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে

পরের সংবাদ

কতজন নিখোঁজ কেউ জানে না, উৎকণ্ঠায় স্বজনরা

প্রকাশিত: জুন ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, চট্টগ্রাম অফিস : কাভার্ড ভ্যান চালক মো. আকতার হোসেন (২২)। সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন তিনিও। আগুনের ভয়াবহতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। ১১ মিনিট লাইভ ভিডিও করার পর আর দেখা যায়নি তাকে। ঘটনার পর থেকে মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে এ তরুণের। ৩ দিনেও খোঁজ না মেলায় দিশাহারা তার পরিবার। ঢাকা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও ছেলেকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন আকতারের ৭৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা নুরুল আমিন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ছেলের খোঁজে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি। সঙ্গে ছিলেন আকতারের বড় বোন মুন্নি আক্তার রোকসানা। এ সময় তারা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দেন নির্দিষ্ট বুথে। ছেলের শোকে হতবিহ্বল বাবা কথা বলতে পারছিলেন না। আকতার হোসেনের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলায়, তিনি বিএম কন্টেইনার ডিপোর গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আকতাররা ৩ ভাই, ১ বোন। মুন্নি আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, আগুন লাগার দৃশ্যটি আমার ভাই ফেসবুকে লাইভ করছিল। লাইভটি ছিল ২০ মিনিটের। লাইভের ১১ মিনিটের মাথায় বিকট শব্দ এবং চারদিকে অন্ধকার। আর কোনো কিছু দেখা যায়নি। আমার ভাইয়ের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত কয়েকদিন ধরে তাকে অনেক খুঁজেছি। আমরা ঢাকায় গিয়েছি,

চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি, কিন্তু ভাইয়ের দেখা পাইনি। তাই মরদেহ শনাক্তে ডিএনএ নমুনা দিলাম। মুন্নি বলেন, আমরা তিন ভাই হলেও আকতারই মা-বাবাকে দেখত। বাবার ওষুধের খরচ হতে শুরু করে সবকিছু সে-ই করত। তাকে ছাড়া আমাদের পরিবার কীভাবে চলবে? আমাদের কে দেখবে?
শুধু আকতার হোসেন নন, সীতাকুণ্ডের এই কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও খোঁজ নেই অনেকের। প্রিয় মানুষটি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে- তাও জানেন না স্বজনরা। প্রিয়জনের মরদেহ পেতে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভিড় করেন স্বজনরা। এত ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর এই ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে কতজন নিহত হয়েছেন, কতজন নিখোঁজ রয়েছেন- সেই হিসেব কারো কাছেই নেই। ব্যাপক বিস্ফোরণে ছিন্ন-ভিন্ন হওয়া মানুষের দেহের অংশবিশেষ পাওয়া যাচ্ছে এখনো। সেই ডিপোতে কতজন লোক ছিলেন এবং এই ঘটনায় কতজন নিখোঁজ রয়েছেন তার হিসেব ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, পুলিশসহ কোনো সংস্থাই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছে না। বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। শনাক্তবিহীন মরদেহে নিজের স্বজন আছেন কিনা জানতে বা নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ পেতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দিতে ভিড় করছেন অনেকে। নমুনা সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত বুথে গত দুদিনে ৪০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ২২ জনের খোঁজে তারা নমুনা দিয়েছেন। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজটি করছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।
গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে আরো দুটি লাশের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়। পরে লাশ দুটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৪৩। বিস্ফোরণে হতাহতের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান জানান, নিহতদের ২৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এসব মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি মরদেহগুলো বর্তমানে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা আছে। তাদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। নমুনার ফলাফল পেতে অন্তত এক মাস সময় লাগতে পারে।
নিখোঁজদের আরেকজন মো. আব্দুল মনির হোসেন (২৮)। বাড়ি সীতাকুণ্ডের উত্তর ফকিরপাড়ায়। কাজ করতেন বিএম ডিপোর এফএলটি অপারেটর (ক্রেন চালক) হিসেবে। গত শনিবার সন্ধ্যায় রাত্রিকালীন ডিউটিতে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের আগে বাড়িতে জানিয়েছিলেন বেঁচে থাকলে পরে কথা হবে। সেটিই মনিরের শেষ কথা। এরপর থেকে পরিবার জানে না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ও নিহতদের মধ্যে তাকে শনাক্ত করতে পারেনি স্বজনরা। তবে শেষবারের মতো এক নজর মনিরকে দেখতে চান তার পরিবারের সদস্যরা। মনিরের খোঁজ পেতে তার বড় ভাই মোহাম্মদ আলমগীর ব্যানার হাতে সকাল থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন চমেক হাসপাতালের সামনে। তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর রাতেই বাড়িতে জানিয়েছিল মনির। কথা বলার একপর্যায়ে বেঁচে থাকলে পরে কথা হবে বলে ফোন কেটে দেয়। এটাই তার সঙ্গে শেষ কথা। এরপর থেকে ফোন বন্ধ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে আলমগীর জানান, মনির হোসেন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে কাজ করতেন। শনিবার ঘটনার দিন ডিউটি ছিল মনিরের। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্ত্রী ও মায়ের কাছ থেকে প্রতিদিনের মতো বিদায় নিয়ে কর্মস্থলে যান তিনি। পরে রাতে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ডিপোতে আগুন লাগার খবর জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চান। এরপর থেকে বন্ধ মনিরের মোবাইল ফোন। আলমগীর বলেন, ‘আমি চমেকসহ বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করেও মনিরের সন্ধান পাইনি। বেঁচে আছে কিনা জানি না। মর্গে রাখা লাশগুলো দেখেছি। সবার চেহেরা বিকৃত। পুড়ে অঙ্গার শরীরগুলোও চেনা যাচ্ছে না। সোমবার ডিএনএ নমুনা দিয়েছি। অন্তত আমার ভাইয়ের লাশটা এনে দেন। কিছুটা শান্তি লাগবে।’
ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলামের (২৬) খোঁজ নেই বিস্ফোরণের পর থেকে। সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে লাগা আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন শফিউল। ঘটনার ৩ দিন পরও খোঁজ মেলেনি তার। এমনকি শনাক্তবিহীন লাশগুলোর সঙ্গেও মেলেনি তার ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল। তার খোঁজে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে এসেছেন তার স্বজনরা। শফিউলের বৃদ্ধ বাবা আব্দুল মান্নান হোসেনও ছোটাছুটি করছেন ঢাকায়। কুমিরা ফায়ার স্টেশনে কাজ করতেন শফিউল, বাড়িতে তার ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রয়েছেন। গত বছরেই বিয়ে করেছিলেন শফিউল। তার স্ত্রী আঁখি খাতুন কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার স্বজনরা জানান, পরিবারের দুই সন্তানের মধ্যে শফিউল ইসলাম বড়। তিনিই একমাত্র সংসারের হাল ধরেছিলেন। নিখোঁজ শফিউলকে অক্ষত পাওয়ার আশা একেবারেই ক্ষীণ জেনেও খোঁজ চালাচ্ছেন তার স্বজনরা। তাদের আশা শফিউলকে মৃত পেলেও মনকে প্রবোধ দিতে পারবেন।
শফিউলের ছোট ভাই মামুন চট্টগ্রামে এসে ভাইয়ের লাশ শনাক্তে ডিএনএ টেস্ট করান। কিন্তু টেস্টের প্রাথমিক ফলাফল শনাক্তবিহীন লাশগুলোর সঙ্গে মেলেনি। এ কারণে শফিউলের পরিবার এখন চরম হতাশার অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে। শফিউলের বাবা আব্দুল মান্নান জানান, তার ছোট ছেলে মামুনের ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের ওপর তাদের অনেকটাই প্রত্যাশা ছিল ছেলের লাশ খুঁজে পাওয়ার। কিন্তু সেটাও হলো না। এখন ছেলেটি কোথায় কী অবস্থায় আছে এটা তারা বুঝতে পারছেন না। দুদিন ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করে ছেলের খোঁজ না পাওয়ায় গত সোমবার রাতে বাড়ি ফিরেছি। ছোট ছেলে মামুন এখনো চট্টগ্রামে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালগুলো খুঁজে ফিরছেন।
অপরদিকে স্বামীর খোঁজে তিন মাস বয়সি সন্তানকে নিয়ে চমেক হাসপাতালে এসেছিলেন রেশমা বেগম। বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর থেকে রেশমার স্বামী মো. শাহজাহানের খোঁজ মিলছে না। মো. শাহজাহান পেশায় কাভার্ড ভ্যান চালক। আট বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। স্বামীর খোঁজে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের বুথে গিয়ে নমুনা দেন রেশমা। মেয়ে জামাইয়ের খোঁজে আসা অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ লিটন চমেক হাসপাতালে আসেন। তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি জামাইকে ফোন দেই। সে প্রথমে নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি রেখে আসে। পরে আবার ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে আগুনের ছবি তুলতে থাকে। আমি তাকে অনেক অনুরোধ করেছি বের হয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে বের হয়নি। একটু পরেই বিকট শব্দ হয়। এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তিনি বলেন, ‘শাহজাহানের এক মাস বয়সে তার মা মারা যায়। তার বাবা অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন সংসার শুরু করে। এই জগতে আমরা ছাড়া তার আর কেউ নেই। নিজের সংসার নিয়ে আমার হিমশিম খেতে হয়। এখন মেয়ে আর দুই নাতিকে নিয়ে কীভাবে থাকব, কই যাব ভেবে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। ’
বিএম কন্টেইনার ডিপোতে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করে আসছিলেন আতিকুল ইসলাম (৪০)। গত শনিবার রাতে ডিপোতে আগুন-বিস্ফোরণের পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি পরিবারের। আতিকুলের স্ত্রী শাহানাজ বেগম (৩৭) গতকাল চমেক হাসপাতালে এসে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। সঙ্গে আসে ১২ বছরের মেয়ে রাহেল আক্তার। শাহানাজ বলেন, তাদের বাসা নগরের হালিশহরের বি-ব্লকে। এক মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। বাসায় কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন তিনি। তাতে অল্প কিছু আয় হয়। মূলত স্বামীর আয়েই সংসার চলে। এখন স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছি না। এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়