ডিএমপি কমিশনার : জীবনে সফলতার শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই

আগের সংবাদ

বিপজ্জনক জেনেও সংরক্ষণে ত্রæটি

পরের সংবাদ

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি : উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আহতদের পরিবার

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজিজুর রহমান জিদনী : প্রতিদিনের মতোই গত শনিবারও কাজে গিয়েছিল ভাই আমার। এর মধ্যেই ভয়াবহ এমন ঘটনাটি ঘটল। আগুনের লেলিহান শিখায় শরীরের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও শরীরের পেছনের অংশ ঝলসে গেছে। ভাই বলছিল, চোখে ঠিকমতো দেখতে পারছে না। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। দুই বছরের মেয়ে রুজদানিয়ার কাছে তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারব তো? জানি না কী হতে চলেছে। সবই এখন উপরওয়ালার ওপর।
গতকাল রবিবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা হলে এভাবেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা জানান চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৬ শতাংশ দগ্ধ শেখ মঈনুল হক চৌধুরীর বড় ভাই আবু নুর মোহাম্মদ মোস্তফা। শুধু মঈনুলের বড় ভাই নন, বিস্ফোরণের ঘটনায় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা দগ্ধ সব রোগীর পরিবার ও স্বজনদের অবস্থাও একই। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন তারা- কখন কী হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত পুলিশের এক এসআইসহ ও দমকল বাহিনীর দুই সদস্যসহ ১৪ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। তারা হলেন- মাগফারুল ইসলাম (৬৫), খালেদুর রহমান (৬০), এসআই

কামরুল হাসান (৩৭), শেখ মঈনুল হক চৌধুরী (৪৩), মো. আমির হোসেন (২২), মো ফারুক (৪৫), রাসেল (৩৯), দমকল কর্মী মো. রবিন মিয়া (২২), কুমিল্লা ফায়ার স্টেশনের সদস্য গাউছুল আজম (২২), মাসুম মিয়া (৩২), ফারুক হোসেন (১৬), মহিবুল্লাহ (৩০), ফরমানুল ইসলাম (৩২) ও রুবেল মিয়া (৩৪)। চিকিৎসকরা বলছেন, সবাইকে এখনই শঙ্কামুক্ত বলা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পা হারানো পুলিশ সদস্য তুহিন হোসেনের (২৭) পায়ের সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করার পর গতকাল এ অস্ত্রোপচার হয়। অন্যদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী। তার নির্দেশনায় আজ সোমবার বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে একটি চিকিৎসক দল চট্টগ্রাম মেডিকেলে যাওয়ার কথা রয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের দেখতে গিয়ে গতকাল দুপুরে এসব কথা জানান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।
মাগফারুল ইসলাম ও খালেদুর রহমান নামে দুজনকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয় গতকাল সকাল ৮টার দিকে। মাগফারুলের ভাই আসাদুল হক জানান, সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে চাকরি করেন তার ভাই। থাকেন ডিপোর ভেতরেই কোয়ার্টারে। গত রাতে বিস্ফোরণে দগ্ধ হওয়ার পর স্থানীয়রা তাকে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। এরপর সকালে তাকে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তার হাত-পাসহ শরীরের বেশ কিছু অংশ দগ্ধ হয়েছে। খালেদুর রহমানের মেয়ের জামাই মিনহাজুর রহমান জানান, বিএম ডিপোতে প্রশাসন বিভাগে চাকরি করেন খালেদুর। পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রামের মোজাফফর নগরে। দুজনেরই শরীরের ১২ শতাংশ করে দগ্ধ হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা। এর কিছু পরেই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শিল্পাঞ্চল থানার এসআই কামরুল হাসানকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। তার খালাতো ভাই নেয়ামত উল্লাহ জিসান জানান, দুর্ঘটনার খবর শুনে ফোর্স নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তখন বিস্ফোরণে তিনিও দগ্ধ হন। দুপর আড়াইটার দিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে শিফট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত শেখ মঈনুল হক চৌধুরীকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। ওইদিনই বিকালে দগ্ধ আরো ৩ জনকে চট্টগ্রাম থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। তারা হলেন- মো. আমির হোসেন, মো. ফারুক ও রাসেল। আমির হোসেনের সহকর্মী সেলিম রেজা জানান, আমিরের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায়। কন্টেইনার ডিপোতে শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। শনিবার রাত ১১টায় তাদের ডিউটি করার কথা ছিল। এর আগে তিনি মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে যাচ্ছিলেন। তখনই বিস্ফোরণে দগ্ধ হন তিনি।
রাসেলের ভাই মো রবিউল জানান, রাসেল ও ফারুক নারায়ণগঞ্জ প্রাইম কালচার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কন্টেইনারবাহী গাড়ির চালক। শনিবার তারা ৫টি কন্টেইনার গাড়িতে গার্মেন্টসের মালামাল নিয়ে ওই ডিপোতে গিয়েছিল। আগুন লাগার পর তারা সেখান থেকে আনুমানিক আধা কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিল। তখন আবার বিস্ফোরণ হলে তারা ছিটকে পড়েন। সেখান থেকে বের হতেও পারছিলন না তারা। তখন ডিপোর বাউন্ডারি ওয়াল ভেঙে তাদের বের করা হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্লিনিকে।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে দগ্ধ আরো ৭ জনকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনার পর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে ভর্তি করা হয়। বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সন্ধ্যায় হেলিকপ্টারযোগে ৭ জনকে চট্টগ্রাম থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়েছে। এদের মধ্য দুজনের শরীরে ৫০-৮০ শতাংশ দগ্ধ আছে। তাদের আইসিইউতে নেয়া হবে। বাকিদের ১৫-২০ শতাংশ করে দগ্ধ হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধদের আমরা শঙ্কামুক্ত বলতে পারি না। তিনি আরো বলেন, ঘটনার পর থেকে চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমিও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। চট্টগ্রামের একজন সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিকের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি। আমার নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ একটি দল চট্টগ্রাম যাচ্ছে আজ। চট্টগ্রামে চিকিৎসা দেয়ার মতো সক্ষমতা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দেয়ার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা তাদের আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আরো চিকিৎসক হতাহতদের চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, তিনি আমাকে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন।
দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের দেখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দুর্ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের নিঃস্বার্থ কর্মীরা জীবন দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শনিবার মধ্য রাত থেকেই হতাহতদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন। আহতদের চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই আমরা রোগীদের খোঁজখবর নিতে এসেছি। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে আরো রোগী হেলিকপ্টারে করে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হবে। এদের রক্তের প্রয়োজন হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, ঢাবির হলের নেতাকর্মীরাও প্রস্তুত রয়েছে রক্ত দিতে। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন- আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ডা. সামন্ত লাল সেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।
বিএম কন্টেইনার জিএম স্মার্ট গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনার বিষয়ে স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী (অব.) ভোরের কাগজকে বলেন, ভয়াবহ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারের সর্বোচ্চ ও আহতদের সম্পূর্ণ চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দিচ্ছি। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারের গঠিত কমিটিকেও সর্বাত্মক সহায়তার জন্য আমরা তৈরি আছি। এছাড়াও ভয়াবহ বিস্ফোরণটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি কোনো প্রতিপক্ষ দ্বারা ‘স্যাবোটাইজ’ করা হয়েছে, তা উদ্ঘাটনে সরকারের সব সংস্থাগুলোকে আমরা অনুরোধ করছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়