ডিএমপি কমিশনার : জীবনে সফলতার শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই

আগের সংবাদ

বিপজ্জনক জেনেও সংরক্ষণে ত্রæটি

পরের সংবাদ

সর্বনাশা ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার কার : নিহত অর্ধশত, দগ্ধ-আহত আড়াইশর বেশি, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মজুতের অনুমতি ছিল না, ২৫ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৬, ২০২২ , ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

সমরেশ বৈদ্য : আগুন ও বিস্ফোরণে একসঙ্গে এত হতাহতের ঘটনা আগে কখনো দেখেনি চট্টগ্রামের মানুষ। গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিএম কন্টেইনার ডিপোয় আগুন ও বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ৯ জনসহ কমপক্ষে অর্ধশত মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে আরো আড়াই শতাধিক।
শনিবার রাত ৯টায় আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রায় ২৫ ঘণ্টা পর গতকাল রাত ১০টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
গতকাল রবিবার রাত ১১টায় এ তথ্য নিশ্চিত করে বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, এখনো ডিপোর বিভিন্ন স্থান থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এছাড়া নিভু নিভু আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার আগে গতকাল দুপুর থেকে ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর একটি দল বিএম কন্টেইনার ডিপোতে গিয়ে কাজ শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ উদ্ধার কাজে সহায়তার জন্য পুলিশ ও র‌্যাবও রয়েছে সেখানে। ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিটের প্রায় ২০০ সদস্য আগুন নেভানোর কাজ করছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মীদের সহায়তায় নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ¥ীপুর ও কুমিল্লাসহ আশপাশের জেলা থেকেও ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এসে আগুন নেভানোসহ উদ্ধার কাজ করে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাসহ অন্যরা বলছেনÑ কন্টেইনার ডিপোতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ থাকায় এই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা নেভাতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছেÑ এত বড় ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার কার? কারণ যে কোনো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ মজুত করে রাখতে হলে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। তাছাড়া এটি যেহেতু অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো; তাই এটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষেরও নজরদারিতে থাকার কথা। এতসব কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে এই ডিপোতে কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ মজুত ও সরবরাহ করা হতো তার জবাব মিলছে না।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন, আশপাশের বাসিন্দা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পরই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এর কারণ ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বোঝাই কন্টেইনার। সব প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র নিয়েই এই বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ মজুত করা হয়েছিল বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মজুত করতে হলে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে যথাযথ অনুমতি নিতে হয়। পাশাপাশি বিপজ্জনক এসব রাসায়নিক পদার্থ হ্যান্ডলিংয়ের সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যাতে কোনোভাবে আগুন লাগতে না পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কিন্তু তা হয়নি বলেই এতবড় মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটল। তিনি বলেন, আমার জানা মতে বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে কোনো ধরনের ছাড়পত্র নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
ফায়ার সার্ভিস ও ডিপো সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্মার্ট গ্রুপের বিএম কন্টেইনার ডিপোসহ অন্য সব ডিপোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে ত্রুটি। দাহ্য পদার্থ মজুত, ব্যবহার ও পরিবহনের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কড়াকড়ি নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
গত শনিবার রাত ৯টা থেকে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে মারা গেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ কমপক্ষে ৫০ জন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে শুধু ফায়ার সার্ভিসেরই ৯ কর্মীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। অগ্নিদগ্ধদের অনেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। আহতদের সংখ্যাও ছাড়িয়েছে আড়াইশত। প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কেমিক্যাল বহন করা প্লাস্টিকের ড্রামের কথা বলা হলেও বিএম কন্টেইনার ডিপোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটির কথা জানা গেছে ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোতে কর্মরত লোকজনের কাছ থেকে।
চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, প্লাস্টিকের কন্টেইনারে (ড্রাম) হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল। ফলে দ্রুত বিস্ফোরণ হয়েছে। যদিও গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত ডিপোর মালিক বা কোনো কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যাননি। মালিকপক্ষের কেউ না থাকায় কন্টেইনার ডিপোতে কী ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে তা জানতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এ কারণে তারা উদ্ধার তৎপরতায় বেকায়দায় পড়ে। সঠিক তথ্য না দেয়া অর্থাৎ তথ্য গোপন করার কারণে ফায়ার সার্ভিস ছিল অন্ধকারে এবং আগুন আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বিকট-ভয়াবহ শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগেÑ বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ কেন এত লুকোচুরি করেছেন তাদের ডিপোতে কী কী পণ্য রয়েছে তা জানাতে। যেখানে তার প্রতিষ্ঠানটিতে এতবড় ধ্বংসযজ্ঞ হলো, এত মানুষের প্রাণ গেল, এত মানুষ আহত হলোÑ সেখানে প্রতিষ্ঠানটির মালিক একটিবারও গেলেন না কী কারণে।
সরজমিন দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, কন্টেইনার ডিপোটির মালিকপক্ষের কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। এখানে কী ধরনের কেমিক্যাল আছে, তা বলা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত জানতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার অভিযান শুরু করেছেন।
বিএম কন্টেইনার ডিপো (বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো-আইসিডি) স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালে নেদারল্যান্ডস-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে চালু করা হয়েছিল বেসরকারি এ কন্টেইনার ডিপো।
আইসিডিতে কী পরিমাণ যন্ত্রপাতি থাকতে হবে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে; প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরে শর্তাবলি নির্ধারণ করা রয়েছে। এসব শর্ত না মানলে লাইসেন্স স্থগিত রাখারও সুপারিশ করেছিল নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি। আইসিডি নীতিমালা অনুযায়ী, আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার শর্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তার অনেকটা মানেনি বলে জানা গেছে।
বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত নই। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কন্টেইনার এক্সপোর্ট বা ইমপোর্ট করতে হলে বন্দর, কাস্টমস ও বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। আমাদের সবই আছে। কিন্তু বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জেল হোসেন জানিয়েছেন, এমন কোনো অনুমতির বিষয় তাদের জানা নেই। তাদের তালিকায় বিএম কন্টেইনার ডিপোর কোনো নাম নেই। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি নিয়েছে কিনা, সেটা তারা বলতে পারবে।
বিএম কন্টেইনার ডিপোর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গতকাল অসংখ্য প্লাস্টিকের ড্রাম ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যার গায়ে ‘হাউড্রোজেন পারক্সাইড’ লেখা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ এই হাউড্রোজেন পারঅক্সাইড ভর্তি প্লাস্টিকের কন্টেইনার রয়েছে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে। ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন সীতাকুণ্ডের শীতলপুর এলাকায় প্রায় ২৮ একর জায়গার ওপর কন্টেইনার ডিপোটি অবস্থিত। আমদানি-রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্য এ ডিপোতে রাখা হয়।
ডিপোর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিপোর ভেতরে ৫০০ মিটারের একটি টিনের শেড রয়েছে। এই শেডের ভেতরে হাইড্রোজেন পারক্সাইড নামে একধরনের কেমিক্যাল রয়েছে। সেই শেডটি উড়ে গেছে বিস্ফোরণে। রপ্তানির জন্য হাটহাজারীর ঠাণ্ডাছড়ির আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড প্লাস্টিকের ড্রামে করে এ ডিপোতে রাখা হয়। যেখানে ওই আর-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সটি অবস্থিত সেটিও পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটিকে ইতিপূর্বে জরিমানাও করেছিল বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।
এদিকে ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ পৃথক চারটি কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আলমগীর জানান, কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে হতাহতদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়