প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু থেকেই হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অপ্রতুল শিক্ষক, অবকাঠামো, অবৈধ ক্যাম্পাস, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও সার্টিফিকেট বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। সরকার ও ইউজিসির তরফ থেকেও অনিয়মে জড়িত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। মাঝে মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিতে শোনা গেলেও কিন্তু পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির নির্দেশনা বা নীতিমালাকে দুর্নীতিতে জড়িত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর উদ্যোক্তারা তেমন গ্রাহ্য করেন না বলে প্রতীয়মান হয়। সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন স্বল্পতার কারণে নব্বইয়ের দশকে দেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। অধিকাংশ নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ও নিজস্ব একাডেমিক ক্যাম্পাস তৈরি না করেই আবাসিক ভবন অথবা ভাড়া করা ফ্লোরে অপর্যাপ্ত স্থানে মিথ্যা, লোভনীয় অফার ও বিজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা টিউশন ফি আদায় করে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই তারা উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট দেয়ার গ্যারান্টি দিয়ে বাণিজ্যতে জড়িয়ে পড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, বিদ্যমান শিক্ষা নীতিমালা আইন বাস্তবায়ন না করে শুধু ভ্যাট আদায় করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দিতে চায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর ধরে নানাভাবে অনৈতিক সার্টিফিকেট জালিয়াতি ও বাণিজ্য চালিয়ে গেলেও ইউজিসি ও মন্ত্রণালয় কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। অধিকন্তু অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা ও ভিসি নিয়োগ নিয়ে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বার্থদ্ব›দ্ব, মামলাবাজি ও দখলবাজি চলছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না হওয়ায় এবং বিদেশমুখী প্রবণতা রোধকল্পে ১৯৯২ সালে দেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল শিক্ষার নতুন এক ধারা, যার নাম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে, ব্যবসা ভালো হবে এ বিবেচনায় আরো ১২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন জমা পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মাত্র ১০টির ‘মান ভালো’। ১৬টির মান ‘মোটামুটি’, আর অনেকগুলোর মান ‘খুব খারাপ’ এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক জরিপের তথ্যে। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছর সঠিক পথেই হাঁটছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যায় থেকে অল্প ও ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগে প্রচুর মুনাফা করার মানসিকতা নিয়ে ‘ব্যাঙের ছাতার মতো’ গজিয়ে উঠতে শুরু করে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা না ব্যবসা- এ সমস্যার শুরুও তখন থেকেই। এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে কিন্তু গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করা হচ্ছে না। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সেবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাদানের পরিবর্তে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, যা আধুনিক ও সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। এটি জাতির জন্য অশনি সংকেত। বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে বলেই ছাত্রসহ ক্যাম্পাস বিক্রি করতে পেরেছে তিনটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমি না কিনে মালিক বা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নামে জমি কিনছে। শিক্ষার সঙ্গে ব্যবসা যুক্ত হওয়ার কারণেই ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থ আদায় করছে ঠিকই, কিন্তু গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করছে না।
উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই পরিকল্পিত ও আধুনিক মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক নতুন বিভাগ চালু করছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি অনুমোদন ছাড়াই কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি বিভাগ খোলার চেষ্টা করার অভিযোগ পাওয়ার পর ইউজিসি তা নাকচ করে দিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে দুই, তিন এমনকি চারটি বিভাগও খোলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু শিক্ষকের দ্রুত চেয়ারম্যান হওয়ার আকাক্সক্ষা পূরণ এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টির মতো বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে এসব বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে। কাউকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার জন্য কিংবা কয়েকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো করা হচ্ছে। এসব বিভাগের সিলেবাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটি বিভাগই যথেষ্ট। যেসব বিষয়ে পাঠদানের জন্য একটি কোর্সই যথেষ্ট, সে বিষয়েও বিভাগ খোলা হয়েছে। চাকরির বাজারে চাহিদা নেই এমন বিভাগও খোলা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খোলায় শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগে উচ্চ গতিসম্পন্ন ডাটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। এ সরকারের আমলেই ইউজিসি ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের মধ্যে কোম্পানিটির দেশব্যাপী বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক ২০ বছরব্যাপী ব্যবহারের বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কার্যক্রমে অনলাইন পদ্ধতির ব্যবহার যুক্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে ভর্তির আবেদনপত্র ও ফি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশিত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান সরকার ৭ বছরে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অশান্ত পরিস্থিতিকে দ্রুত স্বাভাবিক করে তুলেছে। শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশের কল্যাণে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের সৃজনশীলতা ও মেধা মননকে বিকশিত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা প্রয়োজন।
পরিশেষে এ কথা বলতে পারি যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে এগোচ্ছে তাতে জাতির আলোকিত ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে- সেটিই মনে হচ্ছে। আর এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বা পরিত্রাণের কোনো শুভ লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সরকারিভাবে কোনো ভালো পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এক জোট হয়ে সে সমস্যা সমাধানের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকেন। এক্ষেত্রে ইউজিসিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কোথায় যেন আটকে যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন বিবেক বিবর্জিত কর্মের অবসান ঘটিয়ে উচ্চশিক্ষার মানকে সমস্ত বাধা পেরিয়ে আন্তর্জাতিকীকরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে জাতি মুখ থুবড়ে পড়বে এবং দিকভ্রষ্ট হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জেনে শুনে এবং সচেতনভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ফলাফল ও সার্টিফিকেট জালিয়াতি ও বাণিজ্য শিক্ষার প্রগতিমুখী ধারাকে কলুষিত করে চলেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ফলাফল হচ্ছে তাতে ফলাফল লাভকারী ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বপ্রতিযোগিতার ধারা থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে। এমনকি কর্মমুখী ও সৃজনশীল শিক্ষার ঘাটতিতে সমাজে ক্রমশ শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে। আর বেকারত্বের এ চাপে দেশে ক্রমেই দারিদ্র্য প্রকট হয়ে উঠছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়গুলোতে বিশেষ নজর দিয়ে তার প্রতিকারার্থে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এবং অসহায় অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের অসহায়ত্ব ও দুরবস্থা দূরীকরণে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপে জাতিকে অভিশাপ মুক্ত করবে- সচেতন মানুষ এ সময়ে তাই কামনা করছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।