ডিএমপি কমিশনার : জীবনে সফলতার শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই

আগের সংবাদ

বিপজ্জনক জেনেও সংরক্ষণে ত্রæটি

পরের সংবাদ

বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চার কিমি এলাকা

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ ইউসুফ খান, সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম থেকে : নির্জন যে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর কথা, সেই রাতেই বিকট শব্দের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি উপজেলার কদমরসুল এলাকার বিএম কন্টেইনার নামে একটি বেসরকারি ডিপো। কেউ কেউ জেগে ওঠে আতঙ্কে চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকেন প্রাণ বাঁচাতে, কেউ-বা সেই বিস্ফোরণস্থলেই দগ্ধ হয়ে দেন জীবনের শেষ ঘুম।
নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কদমরসুল এলাকায় গত শনিবার রাত ৯টায় বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শুধু ঘটনাস্থলই নয়, কেঁপে ওঠে চার কিলোমিটার দূরের এলাকাও। এ সময় ওই এলাকার বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙে যায়। পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তারা মনে করেছিলেন ভূমিকম্প হয়েছে। বিস্ফোরণের সময়ের চার কিলোমিটার দূরের এলাকার এক বাসিন্দার ঘরের সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়, হঠাৎ করে একটি শব্দে বাসার বাইরে রাখা গাড়ি ও বাসা কেঁপে ওঠে।
সীতাকুণ্ড এলাকার বাসিন্দা কাইয়ূম চৌধুরী ও আবুল বাশার জানান, বিস্ফোরণে কন্টেইনার ডিপোর আশপাশের ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার এলাকায় ব্যাপক কম্পনের সৃষ্টি হয়। মসজিদ ও আশপাশের শতাধিক ঘরবাড়ির জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড স্থলের আশপাশেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (ইউপি) মোহাম্মদ ইয়াকুব বলেন, রাতে বিকট শব্দের আওয়াজ শুনতে পাই। এতে বিএম কন্টেইনার ডিপোর আশপাশের পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সব ইউনিট চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় রাত সাড়ে ৩টার দিকে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করা হয়।
জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে প্রায় ৫০ হাজার কন্টেইনার ছিল। এর মধ্যে কিছুতে বিভিন্ন রাসায়নিক ছিল। আর রাসায়নিক থাকায় সেখানে বারবার বিস্ফোরণ ঘটেছে, ছড়িয়েছে বিষাক্ত ধোঁয়া। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাসায়নিকের কন্টেইনারে বিস্ফোরণের কারণে দুর্ঘটনাস্থলে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না।
ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল সীতাকুণ্ড। বিস্ফোরণের পর স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে ডিপো এলাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বর। এ রকম ভয়াবহ একটি মুহূর্ত দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না সীতাকুণ্ড এলাকার মানুষ। রাত থেকেই প্রিয়জন হারানো মানুষের দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। কখনো ডিপো এলাকা, কখনো-বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছোটাছুটি করে রাত কেটেছে স্বজনদের। নিখোঁজদের অপেক্ষায় ঘটনাস্থলে রাত পার করেছেন অনেক স্বজন। আদৌ তারা বেঁচে আছেন কিনা, মৃত্যুর তালিকায় তাদের নাম যুক্ত হয়েছে কিনা, এ নিয়ে ছিলেন শঙ্কায়। তারপরও প্রিয়জনকে এক নজর দেখার তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে রাত পার করেছেন স্বজনরা। গতকালও তারা ছুটে বেরিয়েছেন হাসপাতালগুলোতে। বিস্ফোরণের পর ডিপোতে জ¦লছিল আগুনের লেলিহান শিখা। দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়ায় ভারি হয়েছিল আকাশ ও চারপাশের পরিবেশ। ডিপো থেকে যে সব মরদেহ বের করে আনা হয় তার অধিকাংশই পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। সেনাবাহিনী, র?্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে স্থানীয়রা মরদেহ উদ্ধার ও আগুন নেভাতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন।
কন্টেইনার ডিপো লাগোয়া দক্ষিণ পাশের বাসিন্দা কামরুন নাহার (৫০) ও তার ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র আজম বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। তাদের বসতঘরের টিনের ছাউনির একাংশ উপড়ে গেছে। এর দক্ষিণ পাশে বাড়ি সওদাগর সেলিম মাঝির। তিনিও আহত হয়েছেন। ভেঙে গেছে তার দোকানের জানালার কাচ। ডিপোর পেছনে সালাউদ্দিনের বসতঘরের ৯টি জানালার কাচ ভেঙে গেছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, কন্টেইনার বিস্ফোরণে ওই এলাকার ৫ শতাধিক বাড়িঘর, দোকান ও মসজিদের কাচের জানালা এবং ঘরের কাচের শোকেস ভেঙে গেছে। ছিঁড়ে গেছে বৈদ্যুতিক তার। শনিবার রাতে বিস্ফোরণের পর উদ্বেগ-আতঙ্কে এলাকার হাজার হাজার মানুষকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। নারী-শিশু-বয়স্কদের আত্মীয়দের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন স্থানীয়রা।
কন্টেইনার ডিপোর আশপাশের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোনাইছড়ির কেশবপুর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার আগে রেললাইনের পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে এ ডিপোর অবস্থান। শনিবারও আসা ৫ শতাধিক কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনার লোড-আনলোডিং করা হয়েছে বলে জানা যায়। শনিবার রাত ৮টার দিকে একটি কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনার থেকে একটু একটু আগুনের ধোঁয়া বের হতে থাকে। এ সময় কর্তব্যরত দারোয়ানরা বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দেননি। দেয়া হয়নি কোনো গুরুত্ব। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর যখন আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকে তখন তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা চালান কিন্তু মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখায় দাউদাউ করে রাসায়নিক দ্রব্যবাহী কন্টেইনার একটার পর একটা জ¦লতে শুরু করে। ফায়ার সার্ভিস দল যখন আগুন নেভানোর চেষ্টা করে তখন রাত ১১টার দিকে কন্টেইনার বিস্ফোরণ ঘটে তখন পুরো সোনাইছড়ি এলাকা বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে। তখনই আগুন নেভানোর কাজ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একসঙ্গে রাসায়নিক পণ্যবাহী কয়টি কন্টেইনার বিস্ফোরিত হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, এখানে কর্মরত শ্রমিক ও শতাধিক মালবাহী গাড়ির অন্তত ৫০০-৬০০ মানুষ ডিপোর ভেতরেই ছিলেন। বিস্ফোরণের যে ভয়াবহতা, তাতে মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, কেমিক্যালের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে। ডিপো এলাকায় পানি স্বল্পতার কথাও জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। এছাড়া সেখানে থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। শনিবার রাত ২টার পরও সেখানে প্রায় ২০০ কন্টেইনারে আগুন জ¦লছিল বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে। সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, কন্টেইনার ডিপোটিতে রপ্তানি পণ্য মজুত রাখা হতো। আগুনের খবর পেয়ে মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। দুর্ঘটনা এড়াতে ডিপোর প্রবেশদ্বারে লোকজন চলাচল বন্ধের পাশাপাশি এলাকাবাসীকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে এলাকার মসজিদে মাইকিং করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন ওসি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়