পদ্মা সেতুর উদ্বোধন : সারাদেশে উৎসব হাতিরঝিলে হবে লেজার শো

আগের সংবাদ

সর্বনাশা ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার কার : নিহত অর্ধশত, দগ্ধ-আহত আড়াইশর বেশি, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মজুতের অনুমতি ছিল না, ২৫ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে

পরের সংবাদ

ইসি : আস্থার দৌড়ে আগ-পিছ

প্রকাশিত: জুন ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশের প্রাচীন জেলা কুমিল্লায় সমবায়, পল্লী উন্নয়ন, স্থানীয় সরকারসহ কিছু বিষয়ের মডেল রয়েছে। কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিত-আলোচিত এগুলো। সর্বশেষ আপডেট হচ্ছে নির্বাচনের কুমিল্লা মডেল। অভিপ্রায়টি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের। ‘কুমিল্লায় একটি মডেল নির্বাচন করতে চাই’- আকাক্সক্ষা জানিয়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচনটি হবে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার মতো আনন্দঘন।
কেবল কথার কথা নয়, এ লক্ষ্যে তিনি এবং তার কমিশনের চেষ্টাও স্পষ্ট। সহিংসতা করতে দেয়া হবে না, পেশিশক্তি ব্যবহার করে লাভ হবে না, কোনো হেলমেট বাহিনী থাকতে পারবে না, যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে- ধরনের হুঁশিয়ারি বাতকে বাত মনে করা যায় না এখনই। একে ‘আমার কথা আমি কই, তোরে শুধু জিগাইয়া লই’ বলার সময় এখনো আসেনি। গোটা কমিশন না হোক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের অন্তত নিজের আন্তরিকতা প্রমাণের চেষ্টার একটি নমুনা হিসেবে ভাবা যায়। ফল কতটা মিলবে, তা ভবিষ্যৎ। আর বর্তমান হচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কাক্সিক্ষত সেই ‘মডেল’ নির্বাচনের প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব হুঁশিয়ারির ফাঁকে তিনি এ কথাও বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন ব্যর্থ হলে দায় ডিসি-এসপির।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বাদেও এ সময় স্থানীয় সরকারের আরো কয়েকটি নির্বাচন রয়েছে। এগুলো নিয়ে স্ব-স্ব এলাকা সরগরম। উত্তেজনাও কম নয়। বিরোধী দল বিএনপি প্রকাশ্যে না থাকলেও এসব এলাকায় প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের অন্ত নেই। সেগুলোতেও এখন পর্যন্ত শক্তি-সামর্থ্যরে জানান দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। শরীয়তপুর ও ঝিনাইদহে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন এমপিকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে ইসি। তারা হলেন শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. ইকবাল হোসেন, ঝিনাইদহ-১ আসনের মো. আবদুল হাই ও ঝিনাইদহ-২ আসনে তাহজীব আলম সিদ্দীকি। চিঠিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, কোনো কোনো এলাকায় আচরণ বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে অথবা প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য করে ওই তিনজনকে সতর্ক করা হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের ক্ষেত্রেও সাবধান বার্তার ঘটনা রয়েছে। ঝিনাইদহ পৌরসভায়ও সক্ষমতার জানান দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে সংঘর্ষের ঘটনায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আব্দুল খালেকের প্রার্থিতা বাতিল করেছে। ইসি সচিবালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
পরিস্থিতি ও ঘটনা বিবেচনায় এগুলো একেবারে ছোট ঘটনা নয়। আউয়াল কমিশনের কর্মতৎপরতায় সক্ষমতা বা মেরুদণ্ডের প্রমাণ দেয়ার চেষ্টার এ ছাপের মধ্যে বিক্ষিপ্ত কিছু বিপরীত ঘটনাও ঘটে চলছে। যা অনেকটা পাল্টা ‘হেডম’ দেখানোর মতো। ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের বাটন টিপতে না পারলে টিপে দেয়ার জন্য নিজের লোক রাখবেন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মিডিয়ায় ভাইরাল চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী। বলতে গিয়ে আর কোনো রাখঢাক রাখেননি তিনি। বলেই ফেলেছেন, ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতেন।
নির্বাচনী সভায় দেয়া তার এমন বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম হট ভাইরাল আইটেম। প্রায় ৪১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে মুজিবুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের ভাষায় ভোটারদের উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে বলেন, ‘তো এখানে ইভিএম একটা করেছে সরকার। তো কী করতাম। একটু কষ্ট করে গিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে ভোট দিতে হবে। চাপ দিতে না পারলে চাপ দেয়ার জন্য সেখানে আমি মানুষ রাখব। রিকশা করে পারেন, যেভাবে পারেন ভোটটা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, ইভিএমের ভোট। ইভিএম না হলে আমি কাউকে খুঁজতাম না, ভোট আমি মেরে দিতাম। যেভাবে পারি ভোটটা মেরে দিতাম।’
মুজিবুল হক আরো বলেন, ‘ইভিএমে আইডি কার্ড ঢুকিয়ে দিতে হয়, নইলে হয় না। এটা না হলে আমি রাতেই নিয়ে ফেলতাম। তো আপনারা একটু কষ্ট করেন, আপনাদের একটু কষ্ট করে ওটা নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে মেশিনে ফিঙ্গার দিতে হবে। কথা বোঝেননি?’
তার এ বক্তব্যের সময় কেউ বিরোধিতা করেননি। বরং কেউ কেউ সমর্থন জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ হচ্ছিলেন বিনোদিত। প্রতিপক্ষকে হুমকি দিতে গিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী জাকের হোসেন চৌধুরী বাচ্চুও কম যাননি। নির্বাচনী সভায় তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন- আমি সরকারি দলের লোক, আমার তো সরকারি গুণ্ডা আছে। আছে না? লাইসেন্সধারী। এরা কি এনাদের (প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী) কাজ করবে, না আমি নির্দেশ দিলে আমার কাজ করবে?’
জাকের হোসেন বাচ্চুর বক্তব্যটিও ভাইরাল হয়ে ঘুরছে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে। ওই সময় মঞ্চে উপস্থিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক খোরশেদ আলমও প্রতিবাদ করেননি। চুপও থাকেননি। হাতে নেড়ে বাচ্চুর বক্তব্যের প্রতি সায় দিয়েছেন খোরশেদ আলমও। বলাবাহুল্য বাচ্চু চেয়ারম্যান একেবারে যেনতেন বা স্থানীয় নেতা নন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।
নির্বাচনের মাঠ বলতে গেলে বিরোধী দল শূন্য। এই শূন্য মাঠেও আন্তরিকতা-সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়ার অবশিষ্ট সুযোগ আছে নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু এক পা এগোতে গিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাওয়ার অবস্থায় পড়ছে তারা। তা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম নিয়েও। চলমান বিতর্কের মাঝে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের একটি স্বীকারোক্তিকে আগুনে ঘি ঢালার পর্যায়ে নিয়ে ঠেকানো হয়েছে। তিনি তার সহযোগী কমিশনার আনিছুর রহমানের ‘কিছুটা স্মৃতিভ্রমের’ কথা বলেছেন। ইভিএমের ভুলত্রæটি ধরতে পারলে ১ কোটি (১০ মিলিয়ন) ডলার পুরস্কার দেয়ার ঘোষণাকে উদ্ভট অভিহিত করে তিনি দাবি করেন, এ ধরনের উদ্ভট কথা তিনি (সিইসি) বলতেই পারেন না। স্মৃতিভ্রমকে সচরাচর ডিমেনশিয়া রোগ বলা হয়। অতিকথনের জেরে এ নিয়ে আজেবাজে নানা কথাও যোগ হচ্ছে। তা ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার পরিস্থিতিকে আমন্ত্রণ করছে কি-না ভেবে দেখার অবকাশ রাখে।
ক্ষমতাসীনদের ইভিএম নিয়ে যারপরনাই আগ্রহের জের পড়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সংসদ অধিবেশন থাকলেও ইভিএমের জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে পারেনি। অধিবেশন শেষ হওয়ার কয়েক দিন পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধন করে ইভিএমে ভোটের বিধান করা হয়। এ জন্য রাতারাতি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার সংস্থানও হয়। কিন্তু ইভিএম পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। তা ব্যবহার হয় খুব সীমিত পরিসরে। এরপর বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সময়ে সময়ে এর ব্যবহার হলেও সন্তোষজনক হয়নি। পায়নি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা। বরং প্রশ্নের পাহাড় জমেছে। এ রকম অবস্থায় ইভিএম নিয়ে প্রশ্নমালায় মাত্রা যোগ হয়েছে আরেক কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবীব খানের বক্তব্যে। ‘ডাকাতি’ শব্দটি টেনে এনেছেন তিনি। তার ভাষায়, “গোপন কক্ষে একজন করে ‘ডাকাত’ দাঁড়িয়ে থাকে, এটাই ইভিএমের চ্যালেঞ্জ।” তার এ মন্তব্য ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরীর ‘বাটন টিপে দিতে কেন্দ্রে আমার লোক থাকবে’- জানান দেয়া একই দিনের ঘটনা। যা প্রকারান্তরে ইভিএম বিতর্ককে শান দেয়ার মতো।
একদিকে আগামী নির্বাচন ইভিএমেই হবে বলে সরকারি ঘোষণা; আরেকদিকে ইভিএম নিয়ে কমিশনের অতিকথন ও অতিতৎপরতা। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপিসহ সুশীল সমাজের ঘোরতর বিরোধিতা। এ সবের যোগফলের মধ্যে পড়ছে কিছু গুণ-ভাগের টোকা। সরল অঙ্কে তা রাজনৈতিক বাড়তি জটিলতার আভাস।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়