ভারতের গমে রুবেলা ভাইরাস : অর্ধলাখ টন ফেরত দিল তুরস্ক

আগের সংবাদ

কিশোরগঞ্জে মানববন্ধন : ভোরের কাগজের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার দাবি

পরের সংবাদ

গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন : ৫৪টি ধারার ৩৭টিই সাংবাদিকবান্ধব নয়

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন পরিশোধ, ছুটি নির্ধারণ এবং দাবি নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনে আদালত গঠনের বিধান রেখে একটি নতুন আইন করতে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপিত হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে গত ২৮ মার্চ ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ সংসদে উত্থাপিত হয়। পরে বিলটি ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি উত্থাপিত হওয়ার পরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, টিআইবিসহ বিভিন্ন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো।
সংসদে উত্থাপিত বিলে গণমাধ্যমকর্মীদের ৩টি বিভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- অস্থায়ী বা সাময়িক, শিক্ষানবিশ এবং স্থায়ী। আর কোনো গণমাধ্যমকর্মীর বেতনকাল এক মাসের বেশি হবে না। পরবর্তী মাসের সাত কর্মদিনের মধ্যে তাকে বেতন পরিশোধ করতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের ন্যূনতম বেতন কাঠামো (ওয়েজ বোর্ড) প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংস্কার করা হবে। ওয়েজ বোর্ড সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, বেসরকারি টেলিভিশন, বেতার ও নিবন্ধিত অনলাইন মাধ্যমের জন্য প্রয়োজনে পৃথক পৃথক বেতন কাঠামো নির্ধারণ করবে। আগে শুধু সংবাদপত্র এবং সংবাদ সংস্থার জন্য এই ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হতো। বিলে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমকর্মীকে সপ্তাহে অন্যূন ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। এর বেশি কাজ করাতে চাইলে অধিকাল (ওভার টাইম) ভাতা দিতে হবে। আগে বিলে গণমাধ্যমকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হলেও প্রস্তাবিত বিল পাস হলে গণমাধ্যমকর্মীরা আর শ্রমিক থাকবেন না, তাদের ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে বর্ণনা করা হবে।
আলোচ্য বিলের ১২ ধারায় গণমাধ্যম মালিকদের অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাই করার অধিকার দেয়া হয়েছে, যা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য হুমকি। এছাড়া ১৪ ধারায় অসদাচরণের সংজ্ঞা না দিয়েই এই অপরাধে চাকরি থেকে বরখাস্থ করার বিপজ্জনক বিধান রাখা হয়েছে। বিলের ১৬ ধারা বলা হয়েছে, অগ্রিম ১ মাস আগে না জানিয়ে ইস্তফা দিলে ১ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার সংগঠন করতে পারবে না। যা

গণমাধ্যমকর্মীবান্ধব না বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা।
বিলে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মী এবং মালিকের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ‘গণমাধ্যমকর্মী কল্যাণ সমিতি’ গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে। দেনাপাওনা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকার এক বা একাধিক বিভাগীয় এলাকার জন্য গণমাধ্যম আদালত স্থাপন করতে পারবে। বিলে কর্মীরা কতদিন ছুটি ভোগ করতে পারবেন তাও সুর্নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে, গণমাধ্যম আদালত ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করবে। প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর ন্যস্ত সব ক্ষমতা গণমাধ্যম আদালতেরও থাকবে। বিলে গণমাধ্যম আপিল আদালতেরও বিধান রাখা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম আদালতের আদেশ পালন করতে অস্বীকার করলে বা ব্যর্থ হলে তিন মাসের জেল বা অনূর্ধ্ব পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হবে।
কোনো গণমাধ্যম মালিক নারীকর্মীকে প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা না দিলে সেই মালিককে ২৫ হাজার টাকা দণ্ড দেয়া যাবে। ন্যূনতম বেতন হারের কম বেতন দিলে এক বছর থেকে পাঁচ বছরের জেলের বিধান রাখা হয়েছে। কোনো গণমাধ্যমকর্মী আদালতে মিথ্যা বিবৃতি দিলে তার ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের জেল হবে। অন্যদিকে মালিকের পক্ষ থেকে অন্যায় আচরণ হলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের জেল হবে।
বিলে বলা হয়েছে, এক বছর চাকরিরত অবস্থায় কোনো গণমাধ্যমকর্মী মারা গেলে মৃতের মনোনীত ব্যক্তি বা তার উত্তরাধিকারীকে কর্মীর প্রত্যেক পূর্ণ বছর বা ছয় মাসের অধিক সময় চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ দিনের এবং কর্মরত বা কর্মকালীন দুর্ঘটনার কারণে ৪৫ দিনের বেতন পাবেন। কোনো স্থায়ী কর্মী ৩০ দিনের নোটিস এবং অস্থায়ী কর্মী ১৫ দিনের নোটিস দিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিতে পারবে।
কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাই করতে চাইলে সরকারকে দ্রুত লিখিতভাবে জানাতে হবে। ছাঁটাই করতে হলে কর্মীকে এক মাসের লিখিত নোটিস দিতে হবে অথবা এক মাসের মূল বেতন দিতে হবে। এছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মূল বেতন দিতে হবে। এ বিলের ১১ ধারার (২) উপধারায় গণমাধ্যমকর্মী চাকরি থেকে অবসর নিলে যে সুবিধা পাবেন তার কোনো অঙ্ক উল্লেখ করা হয়নি। গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থ রক্ষার নামে গণমাধ্যম শিল্প ও গণমাধ্যমকর্মীদের আমলাতন্ত্রের অধিকতর নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে।
সম্পাদক পরিষদ গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনের ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টিই সাংবাদিকবান্ধব নয় বলে মনে করছে। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত এ আইন গণমাধ্যমের বিকাশ সংকুচিত করবে বলেও জানিয়েছেন পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। তারা বলেছেন, করোনা মহামারির আঘাতে সংবাদপত্র শিল্প আজ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশ-বিদেশে অনেক দৈনিক পত্রিকা ছাপা বা প্রিন্ট সংস্করণ কমাতে বা বন্ধ করতে শুরু করেছে। বিজ্ঞাপনের আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এমন পরিস্থিতিতে কঠিন সময় পার করছে ছাপা পত্রিকা।
সম্পাদক পরিষদ বলেছে, আইনে মালিক ও গণমাধ্যমকর্মী পরস্পরকে প্রতিপক্ষ বানানো ও এর ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হবে। এ আইনে সরকারকে সংবাদপত্র বন্ধের অধিকার দেয়া হয়েছে, যা অতীতের নিবর্তনমূলক আইন স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে ছিল এবং পরবর্তীতে যা বাতিল করা হয়। এছাড়া সংবাদপত্র শিল্প ব্যক্তিমালিকানাধীন, কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের পথ উন্মোচন করা হয়েছে। আইনটি পাস হলে তা স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাঁধাগ্রস্তসহ সংবাদপত্রের বিকাশ সংকুচিত করবে। এ রকম আইন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। সার্বিকভাবে এ আইন গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মনে করে, প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। এজন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বিলটি সংশোধনের জন্য এককভাবে মালিকপক্ষের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, গণমাধ্যমকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম আদালত ও আপিল আদালত গঠনের মাধ্যমে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য আইনি জটিলতা সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের আদালত স্বাধীনভাবে গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। বিলটির ১৪ ধারায় অসদাচরণের সংজ্ঞা না দিয়েই এই অপরাধে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিপজ্জনক বিধান রাখা হয়েছে। ১৬ ধারা বলা হয়েছে, ১ মাস আগে না জানিয়ে ১ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে গণমাধ্যমকর্মীকে চাকরিচ্যুত করা যাবে। তাছাড়া সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার সংগঠন করতে পারবে।
তিনি বলেন, ২৫ ধারায় ন্যূনতম ওয়েজ বোর্ড গঠনের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করে, সরকারের বিবেচনা ও ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী কল্যাণ সমিতি নামে সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার বিষয়টি থাকলেও, এ সংক্রান্ত বিধিবিধান এই বিলে অনুপস্থিত। বিলে শ্রম আইনে মূল বেতনের দ্বিগুণ ভাতা দেয়া বা সপ্তাহে, মাসে বা বছরে সর্বোচ্চ কতো ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করানোসংক্রান্ত অংশটি বিবেচনা করা হয়নি।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এই আইনটি করার জন্য কোনো ধরনের কোনো কমিটিতে সাংবাদিকদের রাখা হয়নি। যেসব সুযোগ সুবিধার কথা যেমন গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের কথা বলা হচ্ছে এগুলো আগেও ছিল। তবে গ্রাচ্যুইটি কমিয়ে বছরে দুটির পরিবর্তে একটি করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা যেটা হবে এই আইনটির ফলে সাংবাদিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারাতে পারেন। ফলে দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য তারা আন্দোলন করতে পারবেন না। সাংবাদিকরা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না। ফলে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান মনে করেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন থাকতে হবে। সাংবদিকদের পেশাগত আইনি সুরক্ষার বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়