ঢাকায় সিপিবির সমাবেশ কাল

আগের সংবাদ

টার্গেট এবার রাজপথ দখল : পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি

পরের সংবাদ

পর্যটনের পাঁচ প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা > মাস্টারপ্ল্যান করছে সরকার : মন্ত্রী

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরীফা বুলবুল : করোনা মহামারির ভয়াবহতা কাটিয়ে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। উন্নয়ন ও সেবার সব খাত সচলসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্মুক্ত হওয়ায় ভ্রমণ আর পর্যটনে গতি ফিরেছে। করোনার আগে বিশ্বজুড়ে পর্যটন খাতে যেখানে শত কোটির বেশি পর্যটকের অবদান ছিল, বর্তমানে সেই সংখ্যা বাড়ছে। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার পর দেশে দেশে মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি বহির্মুখী ও ভ্রমণমুখী হয়েছে; যা পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনাকে প্রসারিত করছে প্রতিদিন।
বিশ্বের ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার ভয়াবহতার পর দেশে দেশে পর্যটকের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দুয়েক বছরের মধ্যে তা আড়াইশ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের মধ্যে ৭৩ শতাংশের বেশি বেছে নেবেন এশিয়ার দেশগুলোকে। বিশ্বপর্যটনের বিশাল সেই বাজার ধরতে পারলে এই খাতের হাত ধরেই আরো দ্রুত বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
সূত্রমতে, করোনাকালের বড় আঘাতে বিশ্বপর্যটনে গভীর ক্ষত তৈরি হলেও বাংলাদেশ দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। যার প্রমাণ মিলেছে গত ২৪ মে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলছে ভ্রমণ ও পর্যটনে বিশ্বের শীর্ষ দেশের তালিকায় তিন ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের সূচকে ১০৩তম থেকে এবার উঠে এসেছে ১০০তম অবস্থানে। দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে শীর্ষে ভারত। বিমান পরিবহন অবকাঠামো, নিরাপত্তা, সংস্কৃতি, বাসস্থান, টাকার মান ও স্থিতিশীল ভ্রমণের সুযোগসহ ৯০টি মানদণ্ড বিবেচনা করে পর্যটনের এ র‌্যাঙ্কিং করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সদ্য সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদ বলছেন, ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে করোনাকালীন দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের যে উত্থান হয়েছে, তা বিবেচনায় এসেছে। দেশে হসপিটালিটি-রিসোর্ট খাতে নতুন ডাইমেনশন তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সেবার মান আঞ্চলিক পর্যায়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। 
করোনার আগে থেকেই পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মহাপরিকল্পনা হাতে

নিয়েছে সরকার। প্রচলিত পর্যটনের বাইরে নতুন নতুন স্পট তৈরির চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশিদের আকর্ষণ করতে নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তবে করোনাকালে হঠাৎ করেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। এখন করোনার ভয়াবহতা কাটিয়ে পর্যটন খাতে সুবাতাস বইতে থাকায় আবারো আশাবাদী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। তবে দেশে পর্যটন সম্প্রসারণ ও বিকাশে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এসব বাধা দূর করতে পারলেই অপার সম্ভাবনা বাস্তবে ধরা দেবে। এতে দেশের জিডিপিতে বড় অবদান রাখতে পারবে পর্যটন খাত।
ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে পর্যটন খাতের রাজস্ব আয় যেখানে বছরে ৭০-৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; সেখানে সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর রাজস্ব বহুগুণ। নেপাল আয় করছে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই গুণ, ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। পাকিস্তানে পর্যটন খাতের আয় বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ, টাকার অঙ্কে ২৭৬ মিলিয়ন ডলার; শ্রীলংকায় পাঁচ গুণ, যা টাকার অঙ্কে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার (বর্তমান পরিস্থিতির আগে) এবং মালদ্বীপ আট গুণ, টাকায় ৬০২ মিলিয়ন ডলার। আর পর্যটন খাতে রাজস্ব আয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ থাকা প্রতিবেশী ভারত আয় করছে বাংলাদেশের চেয়ে ১৪১ গুণ, প্রায় ১১ হাজার মিলিয়ন ডলার।
অথচ খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাদের মতে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, মাটিই শুধু নয়, এখানকার বৈচিত্র্যভরা মানুষও পর্যটকের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। সে কারণে পর্যটন শিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পর্যটন খাতের মডেল। অথচ বিদ্যমান বাধা আর প্রতিবন্ধকতার কারণেই আটকে আছে সেই সম্ভাবনা।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যটন খাতের বিকাশে এখনো বাধা হয়ে আছে ভিসা জটিলতা, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ঝুঁকি, পণ্যের বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যমান আদায়ের প্রবণতা, হয়রানিমূলক আচরণ সেই সঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্ম ব্যবসায়ীদের বাধা ও সামাজিক রক্ষণশীলতা। এমনিতে আগের চেয়ে দেশীয় পর্যটকদের ভ্রমণ প্রবণতা বেড়েছে। কোনো বিশেষ দিবসে ছুটি পেলেই মানুষ পরিবারসহ ছুটে যান পর্যটন স্পটগুলোয়। এতে যোগাযোগ খাতসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেমন উপকৃত হন, তেমনি পর্যটন ব্যবসার পরিধিও বাড়ে। তবে দেশের অপ্রচলিত স্থানীয় স্পটগুলোয় বিশেষ নজর না দেয়ায় রাজস্ব আয়ে সেগুলো উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন ছাড়াও দেশে প্রচলিত কয়েকশ পর্যটন স্পটের বাইরে অপ্রচলিত স্পটের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। যেসব স্পট পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। পাশাপাশি সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুণ্ড্রনগর বা মহাস্থানগড়ের মতো বহু পুরাকীর্তি ও প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশন স্পটগুলো নিয়েও চলছে পরিকল্পনা, যেসব জনপ্রিয় স্পট বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে প্রতিদিনই তুলে ধরছে পর্যটকদের সামনে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত প্রায় ১৫ লাখের বেশি জনবল আর পরোক্ষভাবে ২০ লাখের বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এ শিল্পে। করোনার আগে জাতীয় আয়ে পর্যটন খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে এই পরিসংখ্যান আর বড় হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
 জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান কবির ভোরের কাগজকে বলেন, বাধা তো আছেই। তবে এর চেয়ে বড় কথা পর্যটন আমাদের অগ্রাধিকারেই নেই। পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক আয়, কর্মসংস্থান চাইলে এই খাতকে ফোকাস করতেই হবে। এখনো মনে করা হয় বিদেশি পর্যটক দরকার নেই। অথচ একজন বিদেশি পর্যটক এলে দশজনের কর্মসংস্থান হয়। অথচ সেটাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। দূতাবাসগুলোকেও কাজে লাগানো হচ্ছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি কূটনৈতিক চ্যানেলে পর্যটন বিকাশের ক্ষেত্রে, প্রচারণায় ব্যাপকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, তাহলে পর্যটন এগোবে। করোনার পর যে বাংলাদেশের দ্বার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, সেই ঘোষণাও দেয়নি সরকার। ট্যুরিজম বোর্ড একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেও কাজ হয়নি।
অটিজম কিংবা আইসিটি খাতের মতো যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রী নিজে ট্যুরিজমের নাম উচ্চারণ করবেন, ততক্ষণ কিছুই হবে না- এমন মন্তব্য করে আকতারুজ্জামান কবির বলেন, সরকার প্রধানের কথাতেই দেশে সব কিছু চলে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমের কণ্ঠেও একই সুর শোনা গেল। তিনি বলেন, কেবল ভিসাসহ নানা জটিলতাই নয়, আসলে দেশকে ব্র্যান্ডিং করাই হচ্ছে না। এসব উদাসীনতার কারণেই দেশ এগোতে পারছে না। তিনি বলেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তারপরও সেসব দেশে পর্যটক অনেক বেশি। আমাদের দীর্ঘতম বিচে বসে থাকার জন্য তো মানুষ আসবে না। বিচটা নিরাপদ আর পরিচ্ছন্ন কিনা সেটা জানান দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি ই-ভিসা, রোড শো চালু করতে হবে।
দ্য বেঙ্গল লজিস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রফিকুল ইসলাম নাসিম বলেন, সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি সম্ভাবনাও আছে। ট্যুরিজমের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারত-নেপালের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে আমাদের দেশকে রি-ব্র্যান্ডিং করতে হবে দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ রাফিউজ্জামান রাফি বলেন, পর্যটন শিল্প বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশি পর্যটকনির্ভরতা ছাড়াও দেশের পর্যটকের নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার দিলে মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। পর্যটন বিকাশে পেশাদারিত্ব থাকা প্রয়োজন,  আমাদের দেশে যা এখনো গড়ে ওঠেনি। পেশাদারিত্ব থাকলে বিদেশিরা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
তবে আশার কথা শোনালেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। পর্যটন মাস্টারপ্ল্যানের সুসংবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, যে মাস্টারপ্ল্যান আমরা করতে যাচ্ছি, তা সুপরিকল্পিতভাবে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে করতে হবে। মূল বিষয় হবে, যে জায়গার সঙ্গে, যে পরিবেশের সঙ্গে যেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন বরিশালে রিভারাইন ট্যুরিজম, পাহাড়ি এলাকায় সেখানকার ইকো-সিস্টেম মেইনটেইন করে ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হবে। পর্যটন খাতের প্রসারে দেশের ইতিবাচক ইমেজ বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে প্রচারণার ওপর বিশেষ মনোযোগ দেয়া হবে। পর্যটনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। কারণ আমাদের সংস্কৃতি পর্যটনবান্ধব। তবে আমাদের আরো উদার হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গবেষণা এবং পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) মো. সাইফুল হাসান বললেন, ভিসা জটিলতা, ধর্মীয় বাধার কারণে পর্যটকরা খোলামেলা পোশাক পরে ঘুরতে পারেন না। এসব জটিলতা দূর করতে ট্যুরিজম বোর্ড কাজ করছে। ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম জোন ফর ট্যুরিস্ট’ করার কথা ভাবছি। যেখানে কেবল ট্যুরিস্টরাই বিকিনি পরে সানবাথ, পার্টি করাসহ অবাধ ঘোরাফেরা করতে পারবে। এছাড়া অনলাইন ভিসা চালুর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইউনাইটেড নেশন ভলান্টিয়ারের সহায়তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের উইং বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়