ঢাকায় সিপিবির সমাবেশ কাল

আগের সংবাদ

টার্গেট এবার রাজপথ দখল : পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি

পরের সংবাদ

পদ্মা সেতু স্বনির্ভরতার স্মারক

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ দেশের মানুষের অনেক স্বপ্নের ধন, কোটি মানুষের বিপুল আশার আলো এবং বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসার প্রতীক পদ্মা সেতু। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে এ জুন মাসেরই ২৫ তারিখ। এ পদ্মা সেতু নিয়ে জনপরিসরে প্রচুর কথা প্রচলিত আছে। প্রচুর আবেগ জড়িয়ে আছে এ পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। এদেশের মানুষের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এ পদ্মা সেতুতে। এ পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার এবং মানুষ অতি সেনসেটিভ বা সংবেদনশীল, কারণ এ পদ্মা সেতু তৈরি করা হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এদেশের জনগণের টাকায় তৈরি হচ্ছে এ পদ্মা সেতু। প্রকৃতপক্ষে দেশের অবকাঠামোর জগতের এত বড় এবং বিপুল উন্নয়ন কাজ হচ্ছে এদেশেরই জনগণের টাকায়, এ ভাবনাই এদেশের মানুষকে যেমন আবেগতাড়িত করে, তেমনি গর্বের জায়গা তৈরি করে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ব্যঙ্গ করে যে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, সে বাংলাদেশ আজ নিজের টাকায় তৈরি করছে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ খাতের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু। টাকার পরিমাণও এদেশের মানুষের গর্বের কারণ বৈকি। কেননা পদ্মা সেতুর জন্য ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯২ কোটি টাকা এবং এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কোনো ধরনের বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া এদেশের জনগণের ঘামের এবং শ্রমের আয় থেকে ব্যয় করা হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতু হচ্ছে স্বনির্ভর বাংলাদেশের একটি গর্বিত স্মারক।
উল্লেখ্য, এ পদ্মা সেতুর পরিকল্পনার শুরু থেকেই নানা ধরনের বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, যাতে এ প্রকল্প শুরুই করা না-যায়, তার জন্য কত দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা আমাদের অনেকেই জানেন। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের আনা অর্থ-আত্মসাতের দুর্নীতির অভিযোগ এ সেতু নির্মাণের যে মহৎ পরিকল্পনা সেটাকে শুরুতেই বিতর্কের মুখে ফেলে দেয়। ২০০৬-২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তির দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল সেটা প্রত্যাহার করে নেয়। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের এ অভিযোগের হাত ধরে অন্যান্য দাতা দেশ ও গোষ্ঠীও পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রæতি প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংকের এ অভিযোগের কারণে বাংলাদেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে, এ ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরে যেতে হয়েছিল এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোশারফ হোসেন ভূইয়াকে রীতিমতো জেলে যেতে হয়েছিল। অথচ একটা মিথ্যা অভিযোগ তুলে পুরো পদ্মা সেতু প্রকল্পটিকেই শুরু থেকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া না যাওয়ায় কানাডার একটি আদালত মামলাটি বাতিল করে দেন। এরপর বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই পদ্মা সেতু নিয়ে এদেশের মানুষের আবেগের কোনো কমতি নেই এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক।
পদ্মা সেতুর ২০১১ সালের ‘পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প’ হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে স্বপ্নের যাত্রা শুরু। আর সব শত্রæতা, সব বিরোধিতা এবং সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অবশেষে ২০২২ সালের জুনের ২৫ তারিখ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ প্রতিদিন একদিন একদিন করে দিন গুনছে কোটি মানুষের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখার জন্য। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত সেতুটির উপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা সেতুতে প্রায় ৪২টি পিলার আছে। প্রত্যেক পিলারের নিচে ৬টি পাইল আছে। পদ্মা সেতুতে প্রায় ৪১টি স্প্যান আছে। এ সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা সংযুক্ত হবে। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে তৈরি করবে এক চমৎকার অবকাঠামোগত মেলবন্ধন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে।
পদ্ম সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার চোহারাই পাল্টে যাবে। কেননা এ সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে, তাতে করে পদ্মার ওইপারের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিল্প বিকাশে যুগান্তকারী অবদান রাখবে। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। সম্প্রসারিত হবে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। ফলে ২১টি জেলার মানুষের জীবনমানে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পদ্মা সেতুর কারণে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার (বাংলাদেশের প্রায় ২৯ শতাংশ) প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিকস কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু ক্রমান্বয়ে ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসে’ পরিণত হচ্ছে বলে আশা করা যাচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর কারণেই মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি প্রায় ১.২, কারো কারো মতে ১.৩ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে প্রায় ২.৩ শতাংশ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার এ অভাবনীয় উন্নয়নের কারণে সমাজে তৈরি হবে গতিশীলতা। পরিবৃদ্ধি ঘটবে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের, যা প্রকারান্তরে গোটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে।
এত বড় এবং বৃহৎ একটি প্রকল্প যখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে, তখনো কিছু মানুষ পদ্মা সেতু নিয়ে নানাভাবে নানা বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি, পদ্মা সেতু এদেশের মানুষের আত্মমর্যাদার চিহ্ন। এদেশের মানুষের আবেগ ও ভালোবাসার প্রতীক। ২০২২ সালের বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা ও আত্মনির্ভরতার স্মারক। তাই কেবল রাজনীতির জন্য রাজনীতি করে, কেবলই সরকারের সমালোচনা করার জন্য, কেবলই বিতর্কের খাতিরে এবং সরকারের কৃতিত্বকে খাটো করার জন্য, পদ্মা সেতুকে বিতর্কিত করার কোনো মানে হয় না। তাই আমি মনে করি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা এবং গর্বের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে, আমরা যেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের কৃতিত্বের শরিক হই। ‘আমাদের পদ্মা সেতু’ বলে আত্মনির্ভরশীলতার সঙ্গী হই। এবং ‘বাংলাদেশের পদ্মা সেতু’ বলে বাংলাদেশের অমর কীর্তি এবং অসামান্য অর্জনের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করি। কেননা পদ্মা সেতু কেবলই একটি সেতু নয়, এ সেতু আমাদের এবং উত্তর প্রজন্মকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহস জোগাবে অনন্তকাল।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়