ঢাকায় সিপিবির সমাবেশ কাল

আগের সংবাদ

টার্গেট এবার রাজপথ দখল : পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি

পরের সংবাদ

ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীত : মানবিকতাবোধ, স্রষ্টাপ্রেম ও পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতিচর্চার বাহন

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে মানুষের জীবনবোধকে পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও বিশুদ্ধ করার মহান ব্রত নিয়ে। সব ধর্মমতই মানবিকতা, প্রেম ও শান্তির কথা বলে; একটা পরিশীলিত জীবনাচার, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা আর মহত্তম আদর্শের কথা বলে। জীবনকে সুশৃঙ্খল উপভোগের প্রকৃষ্ট উপকরণ আর সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে মিলনের সেতুবন্ধন হিসেবে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতকে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য, ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাব ও অধ্যাত্মবাদের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে সংগীতের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সব ধর্ম ও দর্শনে তাই সংগীতের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের প্রাত্যহিক জীবনাচারে আমরা সংগীতের ঘনিষ্ঠ প্রয়োগ দেখতে পাই। পবিত্র ইসলামের নিত্যদিনকার আমল হিসেবে পাঁচবার আজান ও নামাজে মনোমুগ্ধকর ও চিত্তাকর্ষক সুরের মূর্ছনা উপভোগ করি। কনফুসিয় ধর্মের মূল রসদ হচ্ছে তার সংগীত; এগুলো বৌদ্ধ ও জেনধর্মীয় সংগীতের মতোই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এভাবে প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক রীতিনীতিতে সংগীতের সংশ্লিষ্টতা এক অনিবার্য বাস্তবতা।
ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সামার, সুফি সংগীত, কাওয়ালির। এর বাইরে বাউল, মারফতি ছাড়াও অনেক ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের প্রকার রয়েছে। আমরা প্রথমেই সামার বিষয়টি আলোচনা করতে চাই। সামা আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো শ্রবণ করা। পারিভাষিক অর্থে সামা বলতে ধর্মীয় সংগীত বা ভাব সংগীত বোঝায়। পবিত্র কুরআনে কবি ও কবিতার কথা উল্লেখ রয়েছে; মূলত কবিতার সঙ্গে সুর, তাল ও লয় যোগ করলেই তা সংগীতে পরিণত হয়। আর সেই সংগীতের মূর্ছনায় আন্দোলিত হয় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ; আর মানবজীবনে সংগীতের প্রভাব সুস্পষ্ট। এসব দিক বিবেচনায় খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি, ইমাম গাজ্জালি, শেখ সাদি শিরাজি ও জালালুদ্দিন রুমিসহ বিশ্ববরেণ্য সুফিগণ সামা তথা ধর্মীয় সংগীতকে পুরোপুরি বৈধ বলেছেন। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বুজুর্গ সুফি কবি শেখ সাদি শিরাজি সামার গুরুত্ব সম্বন্ধে বলেছেন : ‘পুরো বিশ্ব সংগীত, প্রেমমত্ততা ও সুরে পরিপূর্ণ। কিন্তু যে আসলে অন্ধ সে আয়নাতে আর কী দেখবে?’
প্রেম ও প্রজ্ঞার বাহক, অধ্যাত্মবাদের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক জালালুদ্দিন রুমি বলেন : যেথায় তুমি নিজেকে ভেঙে চুরমার করতে পারো সেখানে তুমি নৃত্য করো; তোমার কামপ্রসূত ক্ষত মুখ থেকে তুলার পট্টি যেন অপসারণ করতে পারো।’
রুমি আরো বলেছেন : ‘আসো যদি তুমি মোর কবর জিয়ারতে, দেখবে তোমায় সুর ও ছন্দের তালে অনুরোধ করছি নাচতে।’
বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি বলেছেন : ‘বিজ্ঞ হোক আর অজ্ঞ হোক যারা সুফিদের সামা, অজ্দ বা সংগীতের প্রভাবজনিত হৃদয়ে সৃষ্ট আলোড়ন ও অনুপম অবস্থাকে অস্বীকার করে তারা বস্তুত এখনো শিশু; তারা নিতান্ত নির্বোধ।’
জগদ্বিখ্যাত সুফি যুন্নুন মিসরি বলেন : ‘সামা বা ধর্মীয় সংগীত সত্যকে আনয়ন করে, অন্তরকে আন্দোলিত করে সত্যের দিকে ধাবিত করাই সামার কাজ।’
রুমি প্রবর্তিত মৌলাভিয়া তরিকার অনুসারীরা উধহপরহম উবৎারংয, ডযরৎষরহম ফবৎারংয তথা নৃত্যপর দরবেশ বা ঘূর্ণয়মান দরবেশ নামে পরিচিত; যারা সুরের মূর্ছনায় দৃষ্টিনন্দন নৃত্যে নিয়োজিত হয়ে থাকেন।
ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের আয়োজনকেও আমরা সামা হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। সেই আয়োজনের প্রাণশক্তি বা সঞ্জীবনী সুধা হচ্ছে সুফি সংগীত, ভাববাদী গান, মারফতি সরুদ, বাউল সংগীত ও কাওয়ালির মতো চিত্তাকর্ষক, জনপ্রিয় ও উপভোগ্য বিষয়। ভারতীয় উপমহাদেশে সংগীতের শীর্ষগুরু ছিলেন ‘তুতিয়ে হিন্দ’ তথা ভারতের তোতা পাখি-খ্যাত অমর ফারসি কবি আমির খসরু দেহলাভি; যিনি ভারতের সংগীত পদ্ধতির কার্যকর সম্মিলনের অনুঘটক, নতুন গীত ও নতুন রাগ পদ্ধতির উদ্ভাবক এবং সংগীত ভুবনে নতুন লয়, তাল ও বাদ্যযন্ত্রের মহান স্রষ্টা। সেতার, ঢোল ও তবলাসহ যন্ত্রসংগীতের উদ্ভাবক হিসেবে তার ভূমিকা কিংবদন্তিতুল্য। বিপুল জনপ্রিয় ও সর্বমহলে সমাদৃত কাওয়ালি সংগীতের জনক হিসেবেও তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
আমাদের বাংলা ভূখণ্ডে ফকির লালন শাহ মরমি ভাবধারার জন্য অমর হয়ে আছেন। তার রচিত মরমি কবিতা ও সংগীত বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাংলা বাউল গানের স্রষ্টা লালন; যেসব গানে আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় স্তান পেয়েছে। বাউল গানের আত্মতত্ত্বে মনের প্রস্তুতি, দেহতত্ত্বে সাধনার রীতি-পদ্ধতি, গুরুতত্ত্বে গুরুর চরণ শরণ, সৃষ্টিতত্ত্বে জীবসৃষ্টির রহস্য এবং মানুষতত্ত্বে পরমাত্মার মিলনাকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। লালন মানবদেহ ও মানবজীবনকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। তার উক্তি : ‘শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/জন্ম নিতে মানবে।’ একইসঙ্গে লালন জাতিভেদেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘জাত হাতে পেলে পুড়াতাম আগুন দিয়ে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বাউলদের জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদমুক্ত জীবনবোধ ও ধর্মাদর্শের প্রশংসা করে একে ‘মানবধর্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন।
আমাদের জন্য পরম গর্বের বিষয় এই যে, বাংলার বাউল গান এখন বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বাংলাদেশের বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ বলে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাউল গানকে ‘ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা ‘মানবজাতির অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’-এর তালিকাভুক্ত করে। বিশ্ব সংস্থাটির এই স্বীকৃতি-পত্রে বলা হয় : ইধঁষ ঢ়ড়বঃৎু, সঁংরপ, ংড়হম ধহফ ফধহপব ধৎব ফবাড়ঃবফ ঃড় ভরহফরহম যঁসধহশরহফ’ং ৎবষধঃরড়হংযরঢ় ঃড় এড়ফ, ধহফ ঃড় ধপযরবারহম ংঢ়রৎরঃঁধষ ষরনবৎধঃরড়হ.

বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে সুফিগণের মাধ্যমে। সুফিগণ উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। তারা ছিলেন নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ চিত্তের; বাঙালির মন-মানসে সুফিগণের অনুপম আদর্শ রেখাপাত করেছে। সেজন্য জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি এক অসাম্প্রদায়িক জীবনাদর্শ লালন করে এবং একে অন্যের প্রতি সহনশীল থাকতে সচেষ্ট হয়। সামা, বাউল আর কাওয়ালিসহ যাবতীয় ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতকে তারা ভালোবাসে এবং হৃদয়ে ধারণ করে। এর পাশাপাশি বঙ্গীয় অঞ্চলে আগমনকারী আমাদের পূর্বসূরি সুফিদের আদর্শ ধারণ করলে বাংলাদেশের সর্বত্র সব ধর্মমতের মানুষের মাঝে সহাবস্থানের প্রেমময় পরিবেশ বিরাজমান থাকবে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের এক স্বর্গোদ্যান হলো চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ। এ দরবারে সুফিতাত্ত্বিক পরিবেশনা, বাউল আর কাওয়ালির সমন্বয়ে উপস্থাপিত সামা মাহফিল হয়ে উঠে স্রষ্টাপ্রেমের এক মিলনমেলা, ভক্তিবাদের পরম নিদর্শনও পরিলক্ষিত হয় সেখানে। ‘কাওয়ালি’ এক প্রকার আধ্যাত্মিক প্রেমবিষয়ক ভক্তিমূলক গান। ‘কওল’ থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি। কওল-এর আভিধানিক অর্থ বলা। কাওয়ালি সুফিদের গান। বহুকাল আগে সুফি-সাধকগণ খোদার প্রেমে মশগুল হয়ে বিশেষ কোনো নামের জিকির করতেন। অর্থাৎ, একই শব্দ বা বাক্য পুনরাবৃত্তি করতেন। সুরের মাধ্যমে এই পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাকে কাওয়ালি বলা হতো। অষ্টম শতাব্দীতে পারস্যের বিভিন্ন সুফি আস্তানায় এ ধরনের গানের আসর বসত। বাবা ভাণ্ডারি নামে খ্যাত মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার শরিফে প্রথম সামা মাহফিলের প্রবর্তন করেন। রমেশ শীলসহ দেশের অনেক গুণী শিল্পীর প্রতিভা বিকশিত হয় তার পৃষ্ঠপোষকতায়। আর এ দরবারে সামা মাহফিল পূর্ণতা লাভ করে মাওলানা সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারির হাতে; তিনি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীত রচয়িতাদের এবং কাওয়াল শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বর্তমানেও মাইজভাণ্ডার শরিফের বিখ্যাত শিল্পী নাসির কাওয়াল তার সাংস্কৃতিক পরিবেশনার দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন। সংগীতের এসব মজলিসে এক ধরনের ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ একটি আধ্যাত্মিক মিলনমেলার অনুপম পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়