ঢাকায় সিপিবির সমাবেশ কাল

আগের সংবাদ

টার্গেট এবার রাজপথ দখল : পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি

পরের সংবাদ

একটি পৌর নির্বাচন : অভিবাসী এবং অনুচ্চারিত ওপেন সিক্রেট

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সিলেটের এক পৌরসভার সাবেক মেয়রের সম্পদ নিয়ে আলোচনা করছিলেন সেই এলাকার এক তরুণ, বলছিলেন তার সম্পদের কথা। তরুণ বলেছিলেন, একটা সাধারণ ঘরে ছিল তার আবাস, এখন কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তিনি বানিয়েছেন বাড়ি। ফ্ল্যাট আছে, একাধিক বাড়িও আছে। দুদক তাকে ধরেছিল, কিন্তু যেভাবেই হোক, এখনো আছেন তিনি বহাল তবিয়তে, দেশেই মুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সবার সঙ্গেই মিলেমিশে কাজ করছেন। তবে গত নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। এ হলো একটা পৌরসভার নির্বাচিত মেয়রের সম্পদের মোটামুটি একটা চিত্র।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌরসভার নির্বাচন হচ্ছে। এ নিয়ে আছে বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের মাঝে টানাপড়েন। কারণ দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন ক্ষমতাসীন দল থেকে নির্বাচন করা মানেই জিতে আসা। কয়েক বছর থেকে এরকম বিজয়ই মূলত দেখছে বাংলাদেশের জনগণ। শুধু স্থানীয় নির্বাচন নয়, জাতীয় নির্বাচনেও তা-ই হয়েছে। আর সেজন্য নেতাকর্মীদের কনফিডেন্স বেশি দলীয় নির্বাচন নিয়ে। বিশেষত বিভিন্ন জায়গায়ই বিরোধী দল সরাসরি দলীয়ভাবে নির্বাচন না করায় মাঠও এক ধরনের ফাঁকা থাকে, প্রশাসনও খুব একটা গা দেয় না। যদিও গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও কাক্সিক্ষত ফলাফল আসেনি কর্মীদের ঘরে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমার এলাকা বিয়ানীবাজার পৌরসভার নির্বাচন হচ্ছে আগামী ১৫ জুন। অন্য পৌরসভার খুব একটা খোঁজ নিইনি, তবে এ পৌরসভা নিয়ে একটা কৌতূহল কাজ করছে আমার মাঝে। একদিকে নিজের এলাকা, যেখানে আমি যাতায়াত করি সুযোগ পেলেই। অন্যদিকে সবচেয়ে বড় কারণ হলো ব্রিটেনে বাস করা এই এলাকার অভিবাসীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে নির্বাচনে। পৌরসভার ভেতরের একটি গ্রাম (আমার জন্মভূমিও) থেকেই বর্তমান মেয়রসহ আছেন ৩ জন প্রার্থী। এর মাঝে ২ জনই ব্রিটেন এবং আমেরিকার (আওয়ামী লীগের), একজন কমিউনিস্ট পার্টির।
বর্তমান মেয়র ব্রিটেনেরও নাগরিক এবং লন্ডনবাসী থাকাকালীনই তিনি চার বছর আগে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বছর নির্বাচনে ৯ জন মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। এদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীও তিনি, কারণ এবারো তিনি আওয়ামী লীগ থেকেই মনোনয়ন পেয়েছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচন করছেন তাদের দুজনই আওয়ামী লীগের এই উপজেলার প্রভাবশালী নেতা। বর্তমান মেয়রের পাশাপাশি ছাত্রাবস্থায়ও তারা এ উপজেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। অবশ্য তারা এ ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। আরো একজন আছেন আওয়ামী লীগ পরিবারের মানুষ, অন্য গ্রামে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে বিশেষত তরুণদের মাঝে প্রভাব রাখছেন প্রায় ৪ জন মানুষ এবং তারা মূলত ইংল্যান্ড, আমেরিকার নাগরিক। এ এলাকাটা প্রবাসী অধ্যুষিত এবং প্রবাসীরা সেজন্যই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এমনকি জাতীয় নির্বাচনেও। কোটি কোটি টাকা ব্যয় হওয়া নির্বাচনের সিংহভাগই যায় ইংল্যান্ড-ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। এখানে আরেকটা বিষয় কাজ করে আর তা হলো ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকা প্রবাসী হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে তারা দেশেও বিভিন্নভাবে টেন্ডার-কন্ট্রাক্টরি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত।
আসছি ভিন্ন প্রসঙ্গে। বর্তমান পৌর মেয়রের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল গত কয়েক বছর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রচারণা চালানো হয়েছে। তারা লিখেছেন-বলেছেন বর্তমান মেয়রের দুর্নীতির কথা। কিন্তু কোনোভাবেই এ অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্ট নিউজ আইটেম হয়ে আসেনি, দু-একটা নিউজ শুধু জাতীয় পত্রিকায় এলেও খুব ক্ষোভ সৃষ্টি হয়নি এলাকায়। নিউজ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেগুলো উঠে এসেছে তার মাঝে যেমন কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল পৌরসভায়, কিন্তু কাজ হলো কত টাকার। রাস্তা পাকাকরণে কিংবা একটা টার্মিনাল বানাতে দুর্নীতি হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ নিয়ে সরকারি পক্ষ থেকে কিংবা আদালত থেকে তাকে অভিযুক্ত হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি কিংবা দলও এসবে গুরুত্ব দেয়নি। সেজন্য এবারো সরকারি দল তাকেই মনোনয়ন দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম এজন্যই যে, বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যেমন জনগণও খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি, দলও সেভাবেই কোনো অভিযোগের জন্যই তাকে জবাবদিহিতার পর্যায়ে ফেলেনি। আর সেজন্যই দলের অন্যান্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল তাকেই মনোনয়ন দিয়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতি যদি হয়েই থাকে, তাতেও দল কোনো গুরুত্ব দেয়নি কিংবা দলে এ রকম অভিযোগ কোনো নতুন বিষয় নয়।
অন্যদিকে একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেছে, আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন তারাও কিন্তু উচ্চস্বরে নির্বাচনের আগে বর্তমান মেয়রের দুর্নীতির কথা বলেননি। অর্থাৎ প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে তারা কেউই কথা বলতে চান না, কিংবা এখনো চাইছেন না। এ প্রসঙ্গে আরেকটা উদাহরণ টানা যায়, আমাদের পাশের গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র যুক্তরাজ্যেরও নাগরিক। লন্ডন থেকে গিয়ে তিনিও বিয়ানীবাজার পৌর মেয়রের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। গত বছর তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পর লন্ডনে এসে তার এলাকার জনসাধারণের এক সভায় বলে ফেললেন, কীভাবে তিনি প্রশাসনের উপরে স্তরে স্তরে একটা অংশ দিয়ে পৌরসভার জন্য অর্থ নিয়ে এসে এলাকায় কাজ করেন এবং তিনি এই সভায়ই বলেন যে, এর বাইরে গিয়ে কেউ কখনো এলাকার উন্নয়ন করতে পারবে না। এ কথা বলার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা চাউর হয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে পদচ্যুত করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, তিনি উচ্চ আদালত থেকে তার মেয়র পদটি আবার ফিরে পান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করেনি।
এতেই প্রমাণ হয়েছে যে, গোলাপগঞ্জের মেয়র যা বলেছিলেন, তাতে কিছু না কিছু সত্যতা তো আছেই। অর্থাৎ একটা জায়গায় তারা কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ করেই এলাকার জন্য অর্থ নিয়ে আসেন। সুতরাং প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ তাদের বরাদ্দ থেকে এমনিতেই উধাও হয়ে যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে তাই জনপ্রতিনিধিরও একটা ‘ওপেন-সিক্রেট’ উৎস থাকে ফুলে-ফেঁপে ওঠার।
নির্বাচনকে সামনে নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চলছে। এমনকি ব্রিটেনেও এ নিয়ে সভা-সমাবেশ আছে। আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর প্রচারণা এই ব্রিটেন থেকেই। কিন্তু একটাবারও কেউ প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। প্রার্থীরা বলছেন কয়েকশ কোটি টাকা আসবে আগামী দিনগুলোতে। বরাদ্দের দিক থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মাত্র কয়েকটি (বলা হচ্ছে ১৯টি) পৌরসভার একটি হবে না-কি বিয়ানীবাজার পৌরসভা। তাই শুধু পৌর মেয়র হওয়ার জন্যই লাখো-কোটি টাকা ব্যয় করছেন মাত্র ২৭/২৮ হাজার ভোটারের এই নির্বাচনী এলাকায়। একটিবার কি কেউ ভেবে দেখে, বহু উচ্চারিত এই দুর্বৃত্তায়িত দুর্নীতির উৎস কোথায়? কেন-ই বা একজন জনপ্রতিনিধি খুব কম সময়ে সম্পদে-বৈভবে টইটুম্বুর হয়ে যায়। কেন-ই বা উচ্চারিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলও কথা বলে না। একটি পদ্ধতির মাঝেই আমাদের আর্থ-সামজিক অবস্থা ঘুরপাক খাচ্ছে, একটি বৃত্তের মাঝেই আছে সবকিছু। এই অচলায়তন ভাঙতে কেউই সাহসী হয় না, হতে পারে না। আর সেজন্যই তো এ নির্বাচনে দেখছি, কোনো প্রার্থীই দুর্নীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে কথা বলেন না। শুধু তারা বলেন, উন্নয়নের রোল মডেল করবেন আমাদের পৌরসভা। সরকারের ঘোষিত উন্নয়নের সড়কেই তারা উঠতে চান, প্রচলিত প্রথার মাঝে থেকেই। সেজন্যই তারা প্রচলিত পদ্ধতি সংস্কারের কথা বলে না। এমনকি বলে না দুর্নীতির উৎসের কথা।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়