কুসিক নির্বাচন : ইভিএমে ভোটের প্রক্রিয়া দেখলেন ২১ প্রার্থী

আগের সংবাদ

গোপনে তৎপর জামায়াত : কৌশলে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম > ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের ছক

পরের সংবাদ

সলিমুদ্দি ডাক্তার

প্রকাশিত: জুন ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সলিমুদ্দি গ্রামের একজন হাতুড়ে ডাক্তার। মাঝারি গড়নের মানুষ। রাশভারি স্বভাব। মাথাভরা শুভ্র চুল। লম্বা চাপদাড়ি। কোটরগত চোখ। ইয়া বড়ো ভুড়ি। সবসময় সফেদ পাঞ্জাবি পরে থাকেন। চোখে পুরো গøাসের চশমা পরেন। তবে চশমাটা সবসময় নাকের ডগায় এসে ঝুলে থাকে। সলিমুদ্দি পান খেতে বড়ো ভালোবাসেন। সারাক্ষণ মুখে পান পুরে জাবর কাটেন।
তার একজন সহকারী আছে। নাম তোতা মিয়া। তোতা মিয়া বেটেখাটো মানুষ। লিকলিকে শরীর। ওপরের পাটির দাঁতগুলো উঁচু। সবসময় বেরিয়ে থাকে। দেখে মনে হয় সারাক্ষণ বুঝি সে হাসি দিয়ে রয়েছে। তোতা মিয়ার পড়াশোনা নেই। তবে ওষুধের গায়ে লেভেল দেখে ঠিক ঠিক চিনতে পারে।
গ্রামের বাজারে ডাক্তারের এই ওষুধের দোকান। প্রতিদিনই দোকান খোলা রাখতে হয়। ওষুধ কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। সোম ও শুক্রবার হাটবার। হাটবারে লোকজন গিজগিজ করে দোকানে। ছোটখাটো কিছু রোগ আছে, যা গ্রামের লোকদের হামেশাই লেগে থাকে। এই যেমন- জ¦র, সর্দি-কাশি, আমাশয়, উদরাময় এসব নিরাময়ে সলিমুদ্দি ডাক্তারের জুড়ি নেই।
অজপাড়াগাঁ হওয়ায় এখানে পাস করা কোনো ডাক্তার নেই। পনেরো-বিশ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর। সেখানে বড়ো হাসপাতাল আছে। মুমূর্ষু রোগী হলে তাকে মাচানে করে সেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কারু এই অঞ্চলে যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি, ঘোড়া আর রিকশা। কিন্তু রিকশায় শহরে যাওয়া যায় না। একে তো কাঁচা রাস্তা, তার ওপর বালুময় হাওর-বাওড়। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায় সময় পথের মাঝেই রোগী পটল তোলে। অনেক সময় দূরত্বের কথা চিন্তা করে লোকজন রোগী নিয়ে সদর হাসপাতালে যাওয়ার সাহস করে না। আল্লাহপাকের ওপর ভরসা করে বাড়িতে রোগীর চিকিৎসা চলে। সলিমুদ্দি ডাক্তারই ওষুধপত্র দেন। অযতেœ-অবহেলায় পড়ে থাকে রোগী। শেষে রোগে ভোগেই একদিন নীরবে ওপারে পাড়ি জমায়।
একদিন ডাক্তারের কাছে গ্রামের একজন লোক এলো। লোকটির নাম জুবেল মিয়া। সুঠাম দেহী হৃষ্টপুষ্ট মানুষ। জুবেল মিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, ডাক্তার সাব অভয় দিলে একটা কথা বলতে চাই।
সলিমুদ্দি কৌতূহলী হয়ে বললেন, কী কথা! নির্ভয়ে বলুন।
ভরসা পেয়ে জুবেল মিয়া বলল, আপনি তো আবার মানুষের ডাক্তার। কিন্তু আমার রোগী তো মানুষ না।
সলিমুদ্দি বললেন, মানুষ না বলছেন! তাহলে রোগীটা কে?
জুবেল মিয়া বলল, ডাক্তার সাব, কী করি বলুন তো- আমার গাই গরুটা কদিন ধরে ঘাস-পানি কিছুই মুখে তুলছে না।
জুবেল মিয়ার কথা শুনে সলিমুদ্দি ডাক্তার মৃদু হাসলেন। হেসে হেসেই বললেন, ও এই কথা। কোনো সমস্যা নেই। যে মানুষের চিকিৎসা দিতে পারে, তার পক্ষে গরু-ছাগলের চিকিৎসা করা কোনো ব্যাপার হলো মিয়া?
ডাক্তারের কথা শুনে জুবেল মিয়ার মুখখানা সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। হাসি হাসি মুখ করে বলল, তো গরুটাকে নিয়ে আসতে বলছেন।
সলিমুদ্দি বললেন, নিশ্চয়ই নিয়ে আসুন। কেন নয়। এই তোতা- তুই একটু উনার সঙ্গে যা তো।
কিছু সময় পর গরুর দড়ি টানতে টানতে তোতা মিয়া ফিরে এলো। গরুর লেজ ধরে জুবেল মিয়া দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ডাক্তার কী বলেন শোনার জন্য অধীর হয়ে রইল।
সলিমুদ্দি মুখটা একটু গম্ভীর করে বললেন, কী হয়েছে গরুর! এই তোতা, গরুর মুখটা ধরে হা করা তো দেখি।
তোতা মিয়া গরুর মুখ ধরে হা করালো। ডাক্তার টর্চ টিপে দেখলেন গরুর গলায় আখের একটা টুকরো আটকে আছে। মনে মনে তিনি ভাবলেন- আখের টুকরোটার জন্যই হয়তো গরুটা ঘাস-পানি খেতে পারছে না। ওটা সরিয়ে দিতে পারলে নিশ্চয়ই গরুটা সেরে উঠবে।
পরে তিনি জুবেল মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, দু-তিন দিনের মধ্যে গরুটাকে আখ খাইয়েছিলেন নাকি?
জুবেল মিয়া বলল, জি ডাক্তার সাব। গত পরশু ছোট ছোট টুকরো করে গরুকে আখ খাওয়ানো হয়েছিল।
ডাক্তার বললেন, হুম্ বুঝতে পারছি ঘটনা!
পরে তিনি সহকারীকে বললেন, তোতা, আমার কাঠিটা একটু নিয়ে আয় তো।
কাঠি আনতে তোতা মিয়া গরুর দড়িটা ছেড়ে দিয়ে একলাফে গিয়ে দোকানে প্রবেশ করল। ডাক্তারের বাঁশের একটা লম্বা কাঠি আছে। ওটা দোকান ঘরের কোণায় রাখা। তোতা মিয়া কাঠিখানা ডাক্তারের হাতে এনে দিলো।
ডাক্তার বললেন, গরুর মুখটা ধরে একবার হা করা।
তোতা মিয়া গরুর মুখটা শক্ত করে ধরে হা করালো। সলিমুদ্দি হাতের কাঠিটা গরুর মুখের ভেতর পুরে দিলেন। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই গরুর মুখের ভেতর থেকে আটকে থাকা আখের টুকরোটা বের করে আনলেন।
টুকরোটা দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, এই যে দেখেন। আখের এই টুকরোটা গরুর গলায় আটকে ছিল। তাই সে ঘাস-পানি ছেড়ে দিয়েছিল। আশা করছি এখন সে ঘাস-পানি খেতে আর আপত্তি করবে না।
জুবেল মিয়া ডাক্তারের খরচ মিটিয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।
জুবেল মিয়া চলে যাওয়ার পর তোতা মিয়া মনে মনে ভাবল- চিকিৎসাবিদ্যা তো দেখছি ভারি সহজ! অথচ আমি কিনা সামান্য সহকারী হয়েই জীবন পার করে দিচ্ছি। ডাক্তার সাব কাঠি দিয়ে এইমাত্র যা করলেন, তা তো আমিও করতে পারতাম। আমি করতে চাইলেই কী তিনি আমাকে কাজটা করতে দিতেন? দিতেন না। দিবেন কেন? দিলে যদি আমি আবার ডাক্তারিবিদ্যাটা শিখে ফেলি। তখন তার দোকানে আর কে সহকারী হয়ে থাকবে? যাক ভালোই হলো- বিদ্যাটা শিখে নিলাম।
তার কিছুদিন পর একদিন সলিমুদ্দি ডাক্তার দোকানে আসতে দেরি করলেন। তোতা মিয়া সেই সকাল থেকে দোকান খুলে তার অপেক্ষা করছে। কিন্তু তিনি আসছেন না। ডাক্তার সাব না এলেও রোগীরা কিন্তু ঠিকই আসা-যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। এই একটু আগেও একজন জ¦রের রোগী এলো। তোতা মিয়া তার হাতে হাজার পাওয়ারের দুই পাতা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ধরিয়ে দিলো। আর বলল, তিনবেলা খাওয়ার পর দুটো করে খাবেন। আশা করি জ¦র আর থাকবে না। জ¦রজারি বাপ বাপ বলে পালাবার পথও খুঁজে পাবে না।
তারপর এল একজন উদরাময়ের রোগী। তোতা মিয়া তার হাতে ২০ প্যাকেট খাওয়ার স্যালাইন ধরিয়ে দিলো। আর বলল, আধা লিটার পানিতে দুই প্যাকেট স্যালাইন গুলে খাবেন। দৈনিক পাঁচ-ছয়বার করে খাবেন। উদরাময় ভালো না-হয়ে দেখি যায় কোথায়?
তারপর গলায় কাঁটা বিঁধিয়ে এলো আরেকজন রোগী। তোতা মিয়া রোগীকে হা-করিয়ে টর্চ টিপে ভালো করে গলাটা একবার দেখে নিল। সলিমুদ্দি ডাক্তার সেদিন যে কাঠি দিয়ে গরুর গলা থেকে আখের টুকরো বের করে এনেছিলেন, তোতা মিয়া গিয়ে দোকানের কোণা থেকে সেই কাঠিটাই খুঁজে বের করে আনলো। পরে সে রোগীকে লম্বা একটা টুলের ওপর শুইয়ে দিলো। বলল, বড়ো করে একবার হা করুন তো।
রোগী যথাসাধ্য হা করল। অমনি তোতা মিয়া রোগীর মুখের ভেতর লম্বা কাঠিটা পুরে দিলো। সলিমুদ্দি ডাক্তার যেভাবে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে গরুর মুখের ভেতর থেকে আখের টুকরোটা বের করে এনেছিলেন, তোতা মিয়াও সেভাবেই খোঁচাতে শুরু করল। কিন্তু মানুষ আর গরু কী এক! তোতা মিয়ার কাঠির খোঁচায় রোগীর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে গেল। সেখান থেকে অনবরত রক্ত বেরুতে লাগল। রোগীর মুখভরা রক্ত দেখে তোতা মিয়ার মাথাটা কেমন যেন একবার চক্কর দিয়ে ওঠল। মনের ভেতর কিছু একটা ভয় দানা বাঁধতে লাগল। মনে মনে সে ভাবল- সেদিন তো এভাবে রক্ত বের হয়নি! আজ হচ্ছে কেন?
ততক্ষণে সলিমুদ্দি ডাক্তার দোকানে পৌঁছে গেলেন। দোকানে এসে সহকারীর কাণ্ডকীর্তি দেখে মুহূর্তেই তার মনমেজাজ বিগড়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন- তার অনুপস্থিতিতে সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে গেছে। তিনি আর দেরি করলেন না। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে শক্ত করে তোতা মিয়ার ঘাড় চেপে ধরলেন। ঘাড় ধরে তাকে দোকান থেকে বের করে দিলেন। বললেন, দূর হ হতভাগা। আমি তোর মুখ দর্শন করতে চাই না।
জসীম আল ফাহিম

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়