কুসিক নির্বাচন : ইভিএমে ভোটের প্রক্রিয়া দেখলেন ২১ প্রার্থী

আগের সংবাদ

গোপনে তৎপর জামায়াত : কৌশলে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম > ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের ছক

পরের সংবাদ

যে কারণে হঠাৎ উত্তাল রাজনীতি

প্রকাশিত: জুন ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : সরকারের মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর পরই রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। আর বিএনপির এ চেষ্টা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরো মাঠ উত্তপ্ত করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। উভয় দলই তাদের প্রধান নেত্রীকে হত্যার হুমকির অভিযোগ তুলে মাঠে নেমেছে। এ নিয়ে বাকযুদ্ধের পাশাপাশি চলছে মৃদু সহিংসতা। উভয় দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে এ নিয়ে সংঘর্ষ, মামলা-পাল্টা মামলার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৪ জুন সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। তবে এই বাকযুদ্ধ এবং সহিংসতায় কোনো পক্ষই লাভবান হবে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম শুরুর পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের প্রায় চার বছর পর জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৮ মে আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, পদ্মা সেতু থেকে খালেদা জিয়াকে টুস করে ফেলে দেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রতিবাদে পরদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা ক্ষুব্ধ। এ বক্তব্যের নিন্দা জানাই।
এরপর ২২ মে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বেশ কিছু কড়া বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, অনেকেই মনে করছেন আমরা তপ্ত রোদে উত্তপ্ত! আমরা উত্তপ্ত নই, শেখ হাসিনা আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছেন; আমাদের আদর্শিক মাকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাই আমরা উত্তপ্ত।
শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, কত রক্ত চাই আপনার? ওয়ান ইলেভেনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার জন্য বাংলার মাটিতে আসতে পেরেছেন, রাজনীতি করতে পেরেছেন। সেই নেত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করতে আপনার বিবেকে লাগেনি। কারণ আপনি বিবেক বিবর্জিত মানুষ।
ছাত্রলীগের অভিযোগ- ওই সমাবেশে ছাত্রদল নেতারা ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ এমন স্লোগান দেন। জুয়েলের এই বক্তব্য ও সেøাগানের পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রলীগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। এই স্লোগান ও বক্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাইলে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদককে প্রতিহতের

ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। এরপর উত্তপ্ত হয়ে উঠে ঢাবি ক্যাম্পাস।
গত ২৪ মে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের গেট থেকে শোডাউন নিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে আসে ছাত্রদল। এ সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ছাত্রদলকে বাধা দেয় ছাত্রলীগ। তারা ছাত্রদলকে ধাওয়া দিলে পিছু হটে। এরপর ছাত্রলীগকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে ছাত্রদল। ছাত্রলীগও পাল্টা ঢিল ছোড়ে। উভয় পক্ষের প্রায় ৩০ নেতাকর্মী আহত হন। উত্তপ্ত হতে থাকে ঢাবি ক্যাম্পাস।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ছাত্রদল কিলিং মিশন নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল। ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে ছাত্রদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এখানে এসেছে। আর ঢাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক আকতার হোসেন বলেছিলেন, ছাত্রদল কাউকে হামলা করেনি। আমরা সংবাদ সম্মেলন করতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে।
এরপর বুধ ও বৃহস্পতিবার ফের ছাত্রদল ক্যাম্পাসে যাওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ বাধা দেয়। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ হয়। হাইকোর্ট গেটেও ছাত্রদলের সঙ্গে কয়েক দফা মারামারি হয় ছাত্রলীগের। এই কয়েকদিনে হামলা-পাল্টা হামলায় দুই সংগঠনের দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। ছাত্রলীগের ওপর হামলার অভিযোগ এনে শুক্রবার ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন ঢাবি শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। আর রবিবার ছাত্রলীগের সহসভাপতি তিলোত্তমা শিকদারসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম কোর্টে মামলা করেন ছাত্রদল নেত্রী মানসুরা আলম। এতে বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। যা গড়ায় জাতীয় রাজনীতির মাঠে।
ছাত্রদলের কটূক্তি ও হামলার প্রতিবাদে গত রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধনে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান জয় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ছাত্রদল যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, এজন্য তাদের ক্ষমা চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে হবে। নাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিহত করবে। আর গতকাল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক বারবার’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমসাময়িক সময়ে এ ধরনের কোনো স্লোগান দেয়া হয়নি। কোনো মাধ্যমেই কেউ ঢাবি ক্যাম্পাসে এই স্লোগান দেয়ার সত্যতা প্রমাণ করতে পারবে না।
এ পরিস্থিতিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একের পর এক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছে বিএনপি। সমাবেশে বিএনপি নেতারা ছাত্রলীগ ও সরকারকে নিয়ে উত্তপ্ত বক্তব্য দেন। ‘সরকার পতনের আন্দোলন ছাত্রদলের মাধ্যমেই শুরু’ বলে বক্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার সঙ্গে সুর মেলান বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ অন্যরা। পাল্টা বক্তব্যে ঢাবি ক্যাম্পাসে লাশ ফেলতে মির্জা ফখরুল ছাত্রদলকে উসকানি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
একদিকে খালেদা জিয়াকে পদ্মা নদীতে ‘টুস করে’ ফেলে দেয়া, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করার অভিযোগে দেশের রাজনীতি এখন বেশ উত্তপ্ত। বিএনপি সরকারকে ক্ষমতা ছাড়ার কিংবা পদত্যাগে বাধ্য করার হুমকি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারাও বিএনপির আন্দোলনকে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে তা মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছেন।
বিএনপি বলছে, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আওয়ামী লীগ উল্টাপাল্টা বলছে। আওয়ামী লীগ বলছে, পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পগুলো হওয়ায় বিএনপির অন্তর্জালা শুরু হয়েছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে লাশ ফেলতে চায়। দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
এদিকে বিএনপির অপতৎপরতা মোকাবিলায় আওয়ামী লীগকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক বৈঠকের পর তিনি বলেন, বিএনপি শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে, আর আমরা বসে বসে কী তামাক খাব? আমরা বিএনপির সমাবেশে বাধা দিচ্ছি না। নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) উদ্দেশ করে বলছেন, পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠুক আরেকবার। এই কথা শুনলে তরুণদের মাথা ঠিক থাকে না। শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিলে ছাত্রলীগ কি চুপ করে বসে থাকবে? বিএনপির মহাসচিবকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ছাত্রদল দিয়ে আন্দোলন শুরু করবেন? আমরাও দেখব কত ধানে কত চাল। সব কিছুর একটা শেষ আছে। বাড়াবাড়ি ভালো নয়।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপি পঁচাত্তরের কথা বলবে। খুনিদের মতো বক্তব্য দেবে। তারা সন্ত্রাসের ভাষা, অরাজনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করবে, আগুন সন্ত্রাসের পথে হাঁটবে। জ¦ালাও-পোড়াও করবে। এসব হতে দেব না। এজন্য জনগণকে সচেতন করতে ৪ জুন আমরা সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করব।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই আন্দোলনের মধ্যেই আছি। আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই সরকারের পদত্যাগ চাই। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। এজন্য আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনের পথেই আছি। আমাদের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে হামলা-মামলা শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর কয়েক দফা হামলা করেছে।
তিনি বলেন, এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতারা বিএনপি সম্পর্কে ভিত্তিহীন কথা বলে জাতির দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়নি। কটূক্তিও করা হয়নি। বরং তারাই আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ‘টুস’ করে নদীতে ফেলে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকির পর তারা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিক্ষোভের কর্মসূচি দিচ্ছেন।
বিশ্লেষকের মত : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ছাত্ররাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতিতে কয়েকদিন ধরে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেটা বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে নিয়মিত যে শব্দবাণ নিক্ষেপের খেলা চলে, সেটা তারই একটা অংশ। চলতি সপ্তাহে এই শব্দ ব্যবহারের মাত্রা কিছুটা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, দুই পক্ষের মধ্যে মৃদু উত্তেজনার রেশ ধরে ঢাবিসহ বিভিন্ন জায়গায় মৃদু সহিংসতা দেখতে পাচ্ছি। এগুলোকে এখনো নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখার কিছু নেই। আমার ধারণা আগামী দুই সপ্তাহ পর সেটা কমে যাবে। কারণ সহিংসতা করে কোনো পক্ষই লাভবান হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়