কুসিক নির্বাচন : ইভিএমে ভোটের প্রক্রিয়া দেখলেন ২১ প্রার্থী

আগের সংবাদ

গোপনে তৎপর জামায়াত : কৌশলে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম > ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের ছক

পরের সংবাদ

ফেনীর ঘটনায় সচেতন মহলে তোলপাড় : পার্ক থেকে শিক্ষার্থী আটক করা মানবাধিকার পরিপন্থি

প্রকাশিত: জুন ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : ফেনীর বিজয় সিংহ দীঘির পার্ক থেকে গত রবিবার ২৫ শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এ অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। পুলিশের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক, শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, কোনো অভিযোগ ছাড়া পার্ক কিংবা বিনোদন কেন্দ্র থেকে অভিযান চালিয়ে এভাবে শিক্ষার্থী আটক করা আইনসিদ্ধ নয়। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ।
জানা যায়, গত রবিবার দুপুরে ফেনী শহরের মহিপাল বিজয় সিংহ দীঘির পার্কে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১ জন ছাত্রী ও ১৪ জন ছাত্রকে আটক করে থানায় নিয়ে অভিভাবকদের ডেকে তাদের জিম্মায় দেয়া হয়। একই সময়ে আটক শিক্ষার্থীদের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আটক শিশু-কিশোরদের বেশির ভাগই শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের লজ্জায় মুখ ঢাকতে দেখা গেছে। সামাজিক মর্যাদার ভয়ে তাদের চোখেমুখে ছিল ভীতি-আতঙ্ক। কারণ, থানা থেকে ছেড়ে দিলেও লোকলজ্জা এবং অভিভাবকদের কাছে হেয় হওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল শিক্ষার্থীরা। অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আটক ছেলেমেয়েরা পার্কে বন্ধুর পাশে বসে ও দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কারো আচরণই আপত্তিকর ছিল না।
সচেতন নাগরিকদের মতে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত বিনোদন পার্কে একসঙ্গে বসতে পারবে না, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারবে না, এমনটা রাষ্ট্রতন্ত্রের কোথাও লেখা নেই। স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিনোদন পার্কে আড্ডা দিলে পুলিশ স্কুল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে পারে, অভিভাবকরা সমাবেশ করে বিষয়টি তাদের নজরে আনতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই আটক করে শিশুদের মানসিক নির্যাতন করার অধিকার পুলিশের নেই। এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির

(সনাক) সাবেক সভাপতি, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ বজলুল করিম বাহার বলেন, নির্মল বিনোদনের জায়গা হলো পার্ক। সেখানে বসে ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেবে, গল্প করবে, জীবনকে জানার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস বাড়বে। সামাজিক বন্ধন আরো মজবুত হবে। তাদের পুলিশ দিয়ে আটক করা নিষ্ঠুর আচরণের শামিল। শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত বিনোদন পার্কে বসে কী এমন অশ্লীল কাজ করেছে, তাদের এভাবে পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করা হলো? শিক্ষার্থীদের অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো কেন? পুলিশ শিশু অধিকার আইনের ধারা রীতিমতো লঙ্ঘন করেছে। এতে করে ওই কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়েছে। ভুক্তভোগী শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট সালমা আলী বলেন, পার্ক সবার জন্য খোলা। পার্কে শিশুরা যাবে, নারীরা যাবে, সাধারণ মানুষ যাবে। সেখানে বন্ধু-বান্ধব মিলে বেড়াতে যাবে কিংবা ঘুরতে যাবে। এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। দিনের আলোতে পার্ক থেকে তাদের আটক করে মানসিক নির্যাতন করার অধিকার পুলিশের নেই। এজন্য পুলিশকে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পুলিশ শিশু অধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য চাইলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিভাবকরা মানহানি কিংবা মানসিক নির্যাতনের মামলা করতে পারেন। এছাড়া মানসিকভাবে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণের মামলাও করতে পারেন। সব পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত।
শিক্ষার্থীদের পার্ক থেকে আটকের বিষয়ে দেশের আইন কী বলে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, বিনা অপরাধে পার্ক কিংবা যে কোনো স্থান থেকে শিক্ষার্থী কিংবা শিশু-কিশোরদের আটক করতে পারে না পুলিশ। এটি মানাবিধকার পরিপন্থি কাজ। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা কয়েক দফায় মানসিক টর্চারের শিকার হয়েছে। প্রথমত, পুলিশ কর্তৃক থানায় নিয়ে যাওয়া, তারপর বাবা-মায়ের দ্বারা। কারণ, সামাজিক সম্মানহানি হওয়ায় বাবা-মা নিশ্চয়ই তাকে বকাবকি করবেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনও করতে পারেন। এরপর শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সামাজিকভাবে মানসিক টর্চার তো রয়েছেই।
তিনি আরো বলেন, এ বয়সের ছেলেমেয়েদের তো আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বলে থাকি। কারণ, এ বয়সে তাদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা নেই। এ সময়ে সুন্দরভাবে, মোলায়েমভাবে মোটিভেশনের মাধ্যমে তাদের বোঝাতে হবে, গাইড করতে হবে। এ অবস্থায় পুলিশের উচিত ছিল, তাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষক অথবা বাবা-মাকে ডেকে বুঝিয়ে তাদের হাতে তুলে দেয়া। কোনোক্রমেই তাদের থানায় নেয়া উচিত হয়নি।
আটক কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কী ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের ছেলেমেয়েদের পার্ক থেকে পুলিশ আটক করেছে, তা পরিষ্কারভাবে জানতে চান তারা। এভাবে আটক করে থানায় নেয়ায় তাদের ছেলেমেয়েরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অনেকেই লোকলজ্জায় এখন ঘর থেকে বের হতে পারছে না। বিদ্যালয়ে যেতেও ভয় পাচ্ছে। পড়াশোনা ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন চিন্তিত অভিভাবকরা।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১১ জুন বগুড়ার একটি বিনোদন পার্কে একজন নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। ওই অভিযানে আটক করা হয়েছিল ১৪৪ জন তরুণ-তরুণীকে। বিনোদন কেন্দ্রে একসঙ্গে বসে থাকার দায়ে তাদের অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছিল। অভিযানের ভিডিও চিত্র ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এরপর ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একই জেলার জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শহরের রেস্তোরাঁ ও ফাস্ট ফুডের দোকানে নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে আরেকবার অভিযান চালায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ৪০ শিক্ষার্থীকে আটক করার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায়ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা হয়। তাতেও পুলিশের বোধদয় হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়