সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড : বড় মুনাফা এনেছিলেন আতাউর রহমান প্রধান

আগের সংবাদ

ভরা মৌসুমেও চালে অস্থিরতা : খুচরা বাজারে মোটা চাল ৫০ টাকা, পিছিয়ে নেই সরু চালও > কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় বাড়ছে দাম

পরের সংবাদ

বৈশ্বিক সংকটে অর্থনীতি : সাবধানতা অবলম্বন জরুরি

প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো বেসামাল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে করোনা উত্তরণের কথা বলা হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলো এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে বড় ধরনের সংকট চলছে। এক্ষেত্রে জ্বালানি তেল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীল ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ২০০৮-০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে বড় সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ১৩-১৪ বছরে এবারই সবচেয়ে চাপে বা টানাপড়েনে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এখনো করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিকে বড় ধরনের চাপে ফেলেছে।
বিগত বছরগুলোয় দেশের আর্থিক দায়-দেনা পরিস্থিতির কাঠামোটি সর্বদাই দুর্বল ছিল। এটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর দুর্বলতার লক্ষণ হলো কর-জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাত ১০-এর ওপরে ওঠেনি। অর্থাৎ জিডিপির আকার ১০০ টাকা হলে বর্তমানে কর আদায় মাত্র ৯ টাকা ৪০ পয়সা। দক্ষিণ এশিয়ায় যা সবচেয়ে কম। একই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ে পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। দেশে বাজেট ঘাটতিও বাড়ছে না। এর মূল কারণ হলো দুটি। প্রথমত, সম্পদের অভাব এবং দ্বিতীয়ত, সম্পদ থাকলেও এর গুণগতমান সম্পূর্ণ ব্যয় করতে না পারা। আর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এটি একটি কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা। অর্থাৎ কর আদায় কম, ব্যয়ও কম এবং নিয়ন্ত্রিত বাজেট ঘাটতি। এটি কোনো অবস্থাতেই অর্থনীতির শক্তির লক্ষণ নয়। এবারের পরিস্থিতি আরো ভিন্ন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শক্তির জায়গা ছিল বৈদেশিক খাত। রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক সাহায্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ শক্তিশালী ছিল। এতে বৈদেশিক আয়-ব্যয় বা চলতি হিসাবের ভারসাম্য শক্ত অবস্থানে ছিল। এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কারণ রপ্তানির যে উল্লম্ফন, এটি আমদানিকৃত উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। ফলে এত রপ্তানি বৃদ্ধির পরও দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আর গত বছর এই ঘাটতি ছিল এর অর্ধেকের কাছাকাছি। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমরা এত আত্মতুষ্টিতে ভুগছি, কিন্তু এটি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এখনো এই কমা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে, তা নিয়ে ৪-৫ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না। বর্তমানে টাকার মান ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার ছাড়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৭-৮ টাকা কমে গেছে। এরপর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে রিজার্ভে বড় ধরনের টান পড়বে। ফলে টাকার মান আরো কমতে থাকবে। এ বছরে অর্থনীতির নতুন বিষয় হলো রাজস্ব খাতের সঙ্গে বৈদেশিক খাতের দুর্বলতা বাড়ছে। আরেকটি বড় বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশি। গত ১৭ বছরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও খাদ্যাভ্যাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই উচ্চমূল্যের পণ্য এখনো বাংলাদেশে আসেনি। এছাড়াও মুদ্রার বিনিময় হার আরো বাড়লে তা পণ্যমূল্যে প্রভাব পড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়াতে চাচ্ছে। আর সরকার এই মুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে তা বাস্তবসম্মত হবে না। সরকার যেসব খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে, সেই ভতুর্কি না দিয়ে অর্থ সমন্বয় করা হলে জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। একটি দেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা কতটা সুসংহত, তা বোঝার জন্য তিনটি সূচক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো মূল্যস্ফীতি হার, মুদ্রার বিনিময় হার এবং ঋণের সুদের হার। এই তিনটি সূচকের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় যে বিষয়টি জোর দিতে হবে, তা হলো মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সুদের হার আটকে রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, সুদের হার কম থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ করা হয়েছিল। এতে গত কয়েক বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে- এমন তথ্য আমরা পাইনি। কারণ সুদ ছাড়াও বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে।
ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমছে আমাদের অর্থনীতিতে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত ক্ষতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমছে। এর মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। মাঝখানে রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ বাড়ার গতি থেমে গিয়েছিল। আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট হওয়ায় এর দাম বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ফলে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ কমা এবং ঋণপ্রবাহ বাড়ায় তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি তারল্যের জোগান দিতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। এসব মিলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোর অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে আমদানি ও কর্মসংস্থানজনিত ঝুঁকিই বেশি। এখন আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এই অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়লে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো। কিন্তু এগুলো হচ্ছে না। এখন বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাক্সিক্ষত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়িয়ে তারল্য বৃদ্ধি করতে হবে। ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে লাগামহীনভাবে।
বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকায় দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমছে। এদিকে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাক্সিক্ষত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেয়ার পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর লক্ষ্যে শ্রমনির্ভর রপ্তানিপণ্যের পরিবর্তে মেধানির্ভর রপ্তানিপণ্যে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। মেগা প্রকল্প বা বিনিয়োগগুলো যেন সুশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে ও সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো থেকে যে আয় আসবে তার প্রাক্কলন এবং সেগুলোর ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলনের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। একদিনে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় না, ধীরে ধীরে হয়। তাই যেকোনো উন্নয়নশীল দেশকে এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হার যেন স্থিতিশীল থাকে। আমদানি যেন সময় মতো করা হয়। একই সঙ্গে আমাদের পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের দিকে নজর দেয়াসহ এক্সচেঞ্জ ব্যয় ম্যানেজমেন্ট করা দরকার। অনেক প্রকল্প দীর্ঘতর হয়েছে। ফলে সেগুলোর আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আবার অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে যেগুলোর দরকার ছিল না। তাই প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে সব প্রকল্পের ঋণ পরিষেবার দায়ভার যেন একসঙ্গে না হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে খরচের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আরো নতুন নতুন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটে পড়তে পারি আমরা। সেরকম চিন্তা মাথায় রেখে এখন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় কোনোভাবেই সীমা অতিক্রম না করে সেদিক খেয়াল রাখতে হবে।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়