সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড : বড় মুনাফা এনেছিলেন আতাউর রহমান প্রধান

আগের সংবাদ

ভরা মৌসুমেও চালে অস্থিরতা : খুচরা বাজারে মোটা চাল ৫০ টাকা, পিছিয়ে নেই সরু চালও > কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় বাড়ছে দাম

পরের সংবাদ

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বাতিঘর

প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বাতিঘর হিসেবে এ জনপদে যে ক’জন আমাদের সমকালে ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ গঠনের কাজ করছিলেন, তাদের প্রধান পুরোহিত ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এ জনপদের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটানো এবং তার মধ্যে সেক্যুলার ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ তৈরির চেষ্টা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কাজটি অতীতে যেমন কঠিন ছিল, বর্তমানেও কুসুমাকীর্ণ নয়। মানস গঠনের এই কাজটি করতে গিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সবই দেখেছেন, জানতেন। তবুও তিনি বাঙালির জাতীয়তাবাদী মানস গঠনের কারিগর হিসেবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ’৭৫ পরবর্তী বাঙালি না বাংলাদেশি বিতর্কে বাংলাদেশি পক্ষের সাম্প্রদায়িক মুখোশ উন্মোচনের শক্তিশালী যুক্তিবাদী সাহসী পুরুষ ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তার প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থের নামও ছিল ‘বাংলাদেশী না বাঙ্গালী’।
গত শতকের আশি এবং নব্বইয়েরর দশকে স্বনামে কলাম লেখকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সেসব বিরল সাহসী মানুষদের একজন। তার কলাম ব্যতীত আর অন্য কারো কলাম আজ অবধি পুনর্মুদ্রিত হতে দেখিনি। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে আমাদের প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসীরা ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকা পড়ত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘তৃতীয় মত’ কলামের জন্য। তিনি লিখেছেন তথ্য এবং তত্ত্বের ভিত্তিতে। তার তত্ত্ব হলো বাঙালির জাতীয়তাবাদ। এর বিকাশের প্রয়োজনে তিনি যেসব তথ্য উপস্থাপন করতেন যুক্তি হিসেবে তা ছিল আন্তর্জাতিক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যে ঘটে চলেছে বারে বারে তাও ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়ে দিতেন তিনি। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী বর্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজয় দিবস উদযাপন কমিটি যে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করে, তাতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখার শিরোনাম ছিল- ‘বিজয় দিবসের ট্রি অব লিবার্টি কেন দেশপ্রেমিকের রক্তে রঞ্জিত’। এখানে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের কথা লিখতে গিয়ে শুরু করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দিয়ে। এই বিবরণ মোটেই অপ্রাসঙ্গিক ছিল না। এখানে তিনি একস্থানে লিখেছেন, ‘ওকলাহামার সন্ত্রাসীরা যেমন জাতীয় বীর টমাস জেফারসনকে তাদের প্রেরণাদাতা বলে দাবি করে তার বাণী উৎকীর্ণ টি মার্ট গায়ে চড়িয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল ডানচক্রের একটি অংশও তেমনি অন্যতম জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে নিজেদের বলে দাবি করে তার রাজনৈতিক লক্ষ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে নিজেদের প্রেরণা ও আদর্শ হিসেবে প্রচার চালাচ্ছে।’ এই যে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের অন্তরায়কে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ একমাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি সমকালীন যেকোনো ঘটনাকে তুচ্ছভাবে বিশ্লেষণ না করে ইতিহাসের আলোকে আন্তর্জাতিকতার মোড়কে উপস্থাপন করতেন। ফলে মনোযোগী পাঠক তার লেখাতে ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণের স্বাদ গ্রহণ করতেন। তার বক্তব্যের স্পষ্টতা এবং গভীরতা উপলব্ধির জন্য আরো একটি উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক হিসেবে তুলে ধরছি- ‘জাতির পিতা জাতির জীবনের একান্ত প্রয়োজনটি সঠিক সময়েই বুঝেছিলেন। বাঙালিরা মিশ্র ধর্ম, মিশ্র বর্ণ, মিশ্র সংস্কৃতির একটি জাতি। আমেরিকানদের মতো তাদের এক সূত্রে বেঁধে রাখার জন্য একটি সিভিল রিলিজিয়ন প্রয়োজন। অতীতেও বাঙালি জাতিসত্তার জন্য এই সিভিল রিলিজিয়নের প্রয়োজনেই সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদের অভ্যুদয়। এ যুগে শেখ মুজিব আমেরিকার জেফারসনের মতো বাঙালির ঐক্যবিধায়ক একটি সিভিল রিলিজিয়ন সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। জেফারসন যেমন আমেরিকানদের সিভিল রিলিজিয়নদের তিনটি মূলমন্ত্র দিয়েছিলেন, লিবার্টি, ন্যাশালিজম এবং ফেইথ; তেমনি শেখ মুজিবও বাঙালিকে দিয়েছিলেন মূলত তিনটি মূলমন্ত্র- ডেমোক্র্যাসি, ন্যাশনালিজম এবং সেক্যুলারিজম। এই তিনটি মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে তৈরি সিভিল রিলিজিয়ন যদি বাঙালির জীবনে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার পরিচয় ও ঐক্য নিশ্চিত হয়। ফলে তার স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধিও স্থিতিশীল না হয়ে পারে না। ব্যক্তি জীবনের ব্যক্তিধর্মের বা ধর্মাচরণের তাতে কোনো ক্ষতি হয় না।’ তার এমন পর্যবেক্ষণ আজো ভাবনার দাবি রাখে এবং বাস্তবায়নযোগ্য। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ওই লেখার শেষাংশে লিখেছেন- ‘কুড়ি বছরের নৈরাজ্যের পর সহসাই আমাদের ট্রি অব লিবার্টিতে বসন্তের হাওয়া লাগবে, তা প্রত্যাশা করি না। তবে গণতন্ত্রকে তার শবাধার থেকে উত্তোলনের একটি সমষ্টিগত উদ্যোগ প্রয়োজন।’ এরপর আরো ২৫ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। আমরা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে ফেলেছি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও চলে গেলেন। কিন্তু তার প্রত্যাশার প্রতিফলন এখনো ঘটেনি। এখন তো সেক্যুলারিজম তলানিতে এসে ঠেকেছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্য চেতনা হিসেবে কাজ করেছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা। যা কিনা আবদুল গাফফার চৌধুরী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। তার জন্মের ২৯ বছর আগে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫ সাল) হয়েছে। যা কিনা প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে। তার জন্মের চার বছর আগে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ হয়ে গেছে। পণ্ডিতরা বলে গেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন। এসব কিছু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছে। তাই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৫০ সালে মেট্রিক পাস করে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’র মতো কালজয়ী গান রচনা করতে পেরেছিলেন। পূর্বসূরিদের বিকশিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় শানিত হয়েছিলেন বলেই সেদিন গানের মাধ্যমে আগুন ঝড়াতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আজ বলাই বাহুল্য।
লেখালেখির জগতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। তার এ পর্যন্ত প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে- ডানপিটে শওকত (১৯৫৩), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭), বাংলাদেশ কথা কয় (সম্পাদনা) (১৯৭২) এবং আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে তার তেমন কোনো গ্রন্থ বের হয়নি। তখন তিনি পুরোটা সময় জুড়ে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো লড়াই করে গেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সড়ক নির্মাণে। কারণ একাত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যে বাংলাদেশ, সেই জাতীয়তাবাদী চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে পঁচাত্তরে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে। এ কারণে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রায় প্রতিটি কলামে বাংলার জনপদের হাজার বছরের ইতিহাসের একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপট তুলে ধরতেন। কখনো প্রসঙ্গক্রমে বাঙালি সভ্যতার ক্রমবিকাশ ব্যক্ত করতেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদ্যোপ্রান্ত লিখে ফেলতেন অনায়াসে। এমনকি তারও আগে সেই উয়ারী, বটেশ্বরে প্রাগৈতিহাসিক কালের ইতিহাস কিংবা লারমাই পাহাড়ে প্রাচীনকালে জনবসতি গড়ে ওঠার কথকতা। বাদ পড়ে না ভারতবর্ষের বস্তুবাদী, সংশয়বাদী চিন্তার প্রাচীন ইতিহাসের কথা। এসবই তার জাতির জনক রাজনীতির মাধ্যমে যে কাজটি করেছেন, তাঁরই অনুসারী হিসেবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লেখনীর মাধ্যমে করেছেন। তিনি সাত দশকের লেখালেখি জীবনে একটি যুদ্ধই করে গেছেন তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে তরুণ প্রজন্মের মানস গঠন, একটি সিভিল রিলিজিয়ন তৈরি করতে চেয়েছেন।
বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাস ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নখদর্পণে। ইতিহাসের দিনক্ষণ উল্লেখ করে ঘটনার চরিত্রগুলোকে কেমন জানি জীবন্ত করে তুলতেন। আবার সে চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ চরিত্রকে মিলিয়ে ঘটনার পরিণতি বিশ্লেষণ করতেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে। তার লেখার উপস্থাপনা শৈলী ছিল প্রাণঞ্জল এবং নিজস্ব একটি স্টাইলও ছিল। তার লেখনি শৈলীর কারণে মনে হতো, প্রতিটি ঘটনার তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সাংবাদিক হিসেবে কোনো কোনো ঘটনার সাক্ষী যে ছিলেন না, এমনো নয়। ইতিহাসের অনেক বাঁক বদলের সাক্ষী যে ছিলেন, তা তিনি অকপটে স্বীকারও করেছেন বন্ধু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাছে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক। তার এই বহুমাত্রিক লেখার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার বিকাশ সাধন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান কিংবা নাটক অথবা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সব কিছুর মূলে কাজ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় মানস গঠন। এমনকি পলাশী থেকে ধানমন্ডি চলচ্চিত্রেও তিনি এই মানস গঠনের কাজটি করে গেছেন। তার লেখাগুলো পাঠ করলে মনে হতে পারে গল্প, কবিতা, গান কিংবা নাটক অথবা কলাম ইত্যাদিকে তিনি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এসবকে শুধু মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার সব মাধ্যমের লেখায় একই সুর বহমান। সেই সুরের নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ গঠনের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। কারণ তিনি দেখেছিলেন এ জাতির সব ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কূপমণ্ডূকতার নেপথ্যে কাজ করেছে চেতনাগত অভিশাপ। একটি মহল বার বার ভুল পথে চালিত করেছে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ইতিহাসের আলোকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেসব কূপমণ্ডূকদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী চল্লিশের দশকে যখন সাহিত্য সাধনায় নিবিষ্ট হয়েছেন, তখন তার সমকালীন লেখকদের বেশিরভাগই ছিলেন চেতনাগতভাবে ছিলেন ধর্মান্ধ, প্রগতি বিমুখী। একটি পশ্চাৎপদ সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজেকে তৈরির পাশাপাশি সমাজ-রাষ্ট্র এবং সমগ্র জাতির মানস গঠনের পথ নির্মাণ করতে ব্রতী হয়েছিলেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির বর্ণনা যতটা সহজ, সেদিন তা উপলব্ধিতে আনা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। যদিও আজকের দিনেও সে ঝুঁকি বর্তমান, কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালির জাতীয়তাবাদের চেতনায় মানস গঠনের কাজটি করার সময়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সবসময় বটবৃক্ষ হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছেন। তার ছায়ায় থেকে সুশীতল বাতাস প্রবাহের কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতাকে যারা দুর্বলতা হিসেবে দেখেছে, তাদেরও মুখোশ উন্মোচিত করেছেন। এ কারণে তিনি অনেক সময় ‘বাংলাদেশে তিনি আওয়ামী লীগপন্থি কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত এবং সমালোচিত’ হয়েছেন। অনেকে বলেছেন, তিনি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রচারক হিসেবে তিনি রাজনৈতিক বিষয়াবলী ব্যাখ্যা’ করছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এর কোনোটারই জবাব দেননি। কারণ তিনি একটি বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করেছেন। তার সেই লক্ষ্য হলো ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ তৈরি করা। গাফ্ফার চৌধুরী তার এ কাজে যাকে যখন সাথী হিসেবে পেয়েছেন তাকেই বুকে ঠাঁয় দিয়েছেন কিংবা সেই বাহনে নিজেই আরোহী হয়েছেন। এ কারণে বাঙালির মানস গঠনের কাজে বঙ্গবন্ধুবিহীন আওয়ামী লীগকে যখনই লক্ষ্যচ্যুত হতে দেখেছেন, তখনই আবদুল গাফফার চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের নীতি বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন প্রচারে এমন সিদ্ধহস্ত পুরুষ খুব কমই ছিলেন। কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর অনুলেখক হবেন। স্ত্রী চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুদিন দুপুরবেলা গণভবনে বসে বসে নোট নেওয়ার কাজটি শুরুও করেছিলেন। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ও ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হন, যা পরবর্তীকালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে সেক্যুলার মানস গঠনের কাজ আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় পশ্চাৎপদতার কারণে আজো সরল রৈখিকভাবে এগোতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে কূপমণ্ডূকেরা ফতোয়া দিয়েছে। ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা থেকে চার হাজার বছর পরও এ জনপদের মানুষকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী শত প্রচেষ্টার পরও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ‘টচ বেয়ারের’ সংখ্যা অসংখ্য করতে পারেননি। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সৃষ্ট হিন্দু-মুসলমান দ্ব›দ্ব একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে নিঃসন্দেহে। এ থেকে বাঙালি জাতির আজো উত্তোরণ ঘটেনি। এসব বেদনাহত ইতিহাস আজ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রয়াণ তর্পণে আরো বেশি করে মনে পড়বে আলোচকমাত্রেই। তাই মৃত্যু অনিবার্য জানার পরও বেদনাহত হয়ে উঠি; কারণ সেই পশ্চাৎপদ চেতনা থেকে বাঙালি জাতিকে বের করে আনার মতো সঠিক অর্থে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাতিঘরের আলোগুলো একে একে নিভে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়