সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড : বড় মুনাফা এনেছিলেন আতাউর রহমান প্রধান

আগের সংবাদ

ভরা মৌসুমেও চালে অস্থিরতা : খুচরা বাজারে মোটা চাল ৫০ টাকা, পিছিয়ে নেই সরু চালও > কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় বাড়ছে দাম

পরের সংবাদ

নজরুলের ঈশ্বর-ভাবনা

প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পীরের কবর, মসজিদ ও মক্তব পরিবেষ্টিত পরিবেশে জন্ম কবি কাজী নজরুল ইসলামের। শৈশবে বেড়ে ওঠেন আল্লাহ্র প্রতি ইমান, আজান, নামাজ, রোজা, কুরআন পাঠের মধ্য দিয়ে। শৈশবে রচনা করেন কবিতা, ‘আল্লাহ এক, তিনি মহা জ্যোতির্ময়,/সৃজন করেছেন যে, তিনি সমুদয়…/করি স্মরণ সে খোদার নাম,/ভনে কাজী নজরুল ইসলাম,/সালাম, সালাম হাজার সালাম, সেই সে বিশ্বপ্রভুর পায় \’১ লেটোগানের জ্যোতির্ময় স্রষ্টাই পরিণত বয়সে তার চিত্তে ‘আমার সুন্দর’। তার প্রথম দিকের প্রকাশিত সাহিত্য ছোটগল্প, কবিতা উপন্যাস এবং সাংবাদিকতায় নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী পত্রিকায়- সকল ক্ষেত্রে সকল প্রচেষ্টাতেই তিনি তার সুন্দরের (ঈশ্বরের) প্রেরণা উপলব্ধি করেছেন, “আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোটগল্প হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে। তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ও ভাব হয়ে। উপন্যাস, নাটক, লেখা (গদ্য) হয়েও মাঝে মাঝে এসেছিলেন। ‘ধূমকেতু’ ‘লাঙল’ ‘গণবাণীতে’, তারপর এই ‘নবযুগে’ তার শক্তি-সুন্দর প্রকাশ এসেছিল… এ লেখা আমার নয়, এ লেখা আমারি সুন্দরের।”২ সারা জীবন তিনি যা লিখেছেন তা তিনি লেখেননি, তাকে দিয়ে লিখিয়েছেন সেই ‘সুন্দর’ সেই ঈশ্বর- এই তার বিশ্বাস।
তার প্রারম্ভিক গল্প, উপন্যাস, কবিতায় আল্লাহ্ রাসুল সদা উপস্থিত। গল্প উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের সংলাপে খোদার স্মরণ অহরহ ছিল। ধর্মীয় অনুভূতি, খোদার কাছে আকুতি, মুসলিম বীরদের প্রশস্তি, আজানের ধ্বনি, ‘খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্তে’র ওপর অবিচল আস্থা প্রকট ছিল। তার কবিতা ‘খেয়া পারের তরণী’, ‘কোরবাণী’, ‘মোহররম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দহম’ ধর্মাশ্রয়ী এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক। বিশেষত: কবিতার চরণ ‘দাঁড়ি মুখে সারি-গান-লা-শরিক-আল্লাহ!’ (খেয়া পারের তরণী), ‘আল্লার নামে জান কোরবানে’ (কোরবানী) ইত্যাদিতে আল্লার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় আপ্লুত তিনি। ‘আগমনী’, ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’র মতো ধর্মাশ্রয়ী কবিতাও তিনি লিখেছেন তার কবি জীবনের শুরুতে। কিন্তু মাত্র ক’দিন পরেই আচমকা লিখলেন ‘বিদ্রোহী’ (১৯২১) এবং তারপর ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) ইত্যাদি। লিখলেন, ‘আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর’, ‘ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি’, ‘ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন’ এবং আরো অনেক ভয়াবহ কথাা। ভয়ানক ঈশ্বরদ্রোহ। অথচ এই বিদ্রোহের দায় তিনি চাপালেন ঈশ্বরেরই ওপর- বললেন (১৯২৩) ভগবানই তাকে দিয়ে এসব লিখিয়েছেন, ‘আমি ভগবানের হাতের বীণা… যে বাণী আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে, তার জন্য দায়ী আমি নই। দোষ আমারও নয়, আমার বীণারও নয়; দোষ তার- যিনি আমার কণ্ঠে তার বীণা বাজান … সেই বীণা-বাদক ভগবান। তাকে শাস্তি দেয়ার মতো… দ্বিতীয় ভগবান নাই।… আমার উদ্দেশ্য ভগবানকে পূজা করা;… আজ… একা আমি দাঁড়িয়ে নেই, আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্যসুন্দর ভগবানও দাঁড়িয়ে।… ভগবান আমার সাথে আছেন।’৩ অদ্বিতীয় ঈশ্বরের প্রতি অবিচল আস্থাই তাকে প্রেরণা জুগিয়েছে প্রকাশ্য আদালতে ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’তে সর্বসমক্ষে এ প্রত্যয় উচ্চারণ করতে।
১৯২৯ সালে এলবার্ট হলে প্রদত্ত সংবর্ধনার উত্তরে তিনি বলেন, “সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম… আমি শুধু সুন্দরের হাতের বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে, তাকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তব-স্তূতি।’৪ সেই ‘সুন্দর’ ঈশ্বর বিশ্বভুবনের সর্বত্র বিরাজিত, সকল আনন্দ বেদনায় সর্বাবস্থায় তার মাঝে উপস্থিত।
‘বিদ্রোহী’, ‘ধূমকেতুু’ ইত্যাদিতে যে ঈশ্বরদ্রোহ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন তা তার অভিমান-প্রসূত। নার্গিসের সঙ্গে তার বৈবাহিক বিপর্যয় ছিল মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু তার অভিমান মানুষের উপরে যত তার চেয়ে বেশি মানুষের স্রষ্টার ওপর যিনি শোক-তাপ সৃষ্টি করেছেন। ‘কে এমন করে আমার পথের বাসা বারেবারে ঝড়ে উড়িয়ে দেয়?… কেন তার এ অহেতুক দুষমনি আমার ওপর?… কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে’৫ ‘আমার দুষমনি মানুষের ওপর নয়, মানুষের স্রষ্টার ওপর।’৬ পুত্র শোকে কাতর কবি আর্তনাদ করেন, ‘কোন নিষ্ঠুর এই সৃষ্টি করে, কেন সেই শিশু-সুন্দরকে কেড়ে নেয়… জেগে উঠল স্রষ্টার বিরুদ্ধে প্রগাঢ় অভিমান, সেই অভিমান… আমার সর্ব অস্তিত্বে দেখা দিল ভীষণ মৌন বিদ্রোহ হয়ে, বিপ্লব হয়ে।’৭ বিদ্রোহ তার গভীর অভিমানের রূপান্তর, গভীর নিবিড় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। যখন যে নামেই তাকে অভিহিত করে থাকেন না কেন, তার প্রেম প্রীতি রাগ অভিমান তার সকল কর্মে, সকল চিন্তা-চেতনায় সেই ঈশ্বর বিরাজিত। ‘অন্তরে তুমি নাথ সতত বিরাজ’৮; ‘অন্তরে তুমি আছো চিরদিন ওগো অন্তর্যামী/… প্রাণের মতন আত্মার সম/আমাতে আছো হে অন্তরতম।’৯
তার লেখায় আগের মতো তেজ নেই এই অভিযোগের জবাবে ১৯২৬ সালে আনওয়ার হোসেনকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আমি যার হাতের বাঁশি, সে যদি আমায় না বাজায় তাতে আমার অভিযোগ করবার কিছুই নেই। কিন্তু আমি মনে করি- সত্য আমায় তেমন করেই বাজাচ্ছে, তার হাতের বাঁশি করে।’১০ একই সময়ে শামসুন্নাহারকে লেখেন, ‘আমার পনেরো আনা চলেছে আর চলেছে সৃষ্টি-দিন হতে আমার সুন্দরের উদ্দেশে। আমার যত বলা আমার সেই বিপুলতরকে নিয়ে, আমার সেই প্রিয়তম, সেই সুন্দরতমকে নিয়ে।’১১ ‘সে থাকে সকল সুখে সকল দুখে/আমার বুকে অহরহ। /কভু তায় প্রণাম করি, বক্ষে ধরি/…মোর সাথে মিলন বিরহ \’১২ ১৯৪১ সালে তিনি লেখেন, ‘আমার কবিতা আমার শক্তি নয়; আল্লার দেওয়া শক্তি- আমি উপলক্ষ মাত্র! বীণার বেণুতে সুর বাজে কিন্তু বাজান যে গুণী, সমস্ত প্রশংসা তারই।’১৩ সারা জীবন কবির সকল চেতনা ঈশ্বরময়। তার সকল কর্মের চালিকা-শক্তি সেই এক ঈশ্বর।
সচেতন জীবনের অন্তিম সময়ে লেখা তার কবিতা : ‘ঘুমে জাগরণে শয়নে স্বপনে সর্বকর্মে মম/তব স্মৃতি তব নাম যেন হয় সাথী মোর প্রিয়তম! /নিবিড় বেদনা হইয়া আমার বক্ষে নিত্য থেকো /… বলো! বলো! কোথায় লুকাইয়া আছ সৃষ্টির কোনখানে! /…কোথা তুমি, সেথা লয়ে যাও, এই অন্ধ ভিখারি যাচে! /…আর কিছু নয়, চির প্রেমময়, তোমারে ভিক্ষা চাই,/এক তুমি ছাড়া এই ভিখারির কিছুই চাওয়ার নাই! /তব দেওয়া এই তনু মন প্রাণ মোর যাহা কিছু আছে,/তুমি জান, কেন নিবেদন করে দিয়াছি তোমার কাছে।’১৪ স্রষ্টা তার পরম প্রিয়। স্রষ্টার কাছে তিনি আত্ম-নিবেদিত। বোধশক্তির অগম্য অকল্পনীয় সেই ঈশ্বরকে প্রিয়তম ভেবে ঈশ্বরের সন্নিকটবর্তী হতে চেয়েছেন তিনি, ‘যাঁহার বিপুল সৃষ্টির সীমা আজিও জ্ঞানের পারে।/…কিছু বুঝি তার, কিছু বুঝি নাকো, শুধু কাঁদি আর কাঁদি;/কথা ভুলে যাই, শুধু সাধ যায় বুকে লয়ে তারে বাঁধি।’১৫ সাধ অসীম! প্রতীক্ষা অনন্ত! ‘আরো কতদিন বাকি?/বক্ষে পাওয়ার আগে বুঝি, হায়, নিভে যায় মোর আঁখি !’১৬ ঘরোয়া অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা চিরসুন্দর সৃষ্টির আবরণ পরে- এই যে আবরণের মধ্যে অনন্ত নিরাবরণ দেখতে পাই, এই হচ্ছে পরম সুন্দর।… তোমার সুরের নেশায় যখন/ঝিমাবে আকাশ, কাঁদিবে পবন,/রোদন হইয়া হইয়া আসিব তখন/তোমার বক্ষে দুলিতে।’১৭ স্রষ্টাকে তিনি এতটাই ভালবাসতেন যে তাকে পরম প্রিয়তম ভাবতে পেরেছেন, বক্ষে পেতে চেয়েছেন, বক্ষে দুলতে চেয়েছেন। ঈশ্বর বিরাট, তিনি অসীম সর্বশক্তিমান, তিনি অকল্পনীয়; তাকে ভয় করা যায়, তার কাছে প্রণত হয়েছেন তিনি, আকুতি মিনতি প্রার্থনা জানিয়েছেন এবং তাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে বক্ষে ধরার অভিব্যক্তি নজরুলের ঈশ্বর-প্রীতির এক ব্যতিক্রমী বিশেষত। এই অভিব্যক্তি প্রকাশের সাহস তিনি কোথায় পেলেন! তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়।’১৮ তার ভালবাসা গভীর।’ আল্লাহ্ পরম প্রিয়তম মোর, আল্লা তো দূরে নয়,/নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময়!/ পূর্ণ পরম সুন্দর সেই আমার পরম পতি,/মোর ধ্যান-জ্ঞান তনুমন-প্রাণ, আমার পরম গতি। /প্রভু বলি কভু প্রণত হইয়া ধুলায় লুটাইয়া পড়ি,/কভু স্বামী বলে কেঁদে…।’১৯
এই পরম প্রিয় প্রেমময় আরাধ্য দেবতাকে তিনি খুঁজেছেন নিরন্তর। লিখেছেন, ‘যুগ যুগ ধরি লোকে-লোকে মোর/প্রভুরে খুঁজিয়া বেড়াই/…তার চরণ পাবার আশা লয়ে মনে/ফুটিলাম ফুল হয়ে কতবার বনে। /পাখি হয়ে তারি নাম/শতবার গাহিলাম/তবু হায় কভু তার দেখা নাহি পাই।/…পর্বত হয়ে নাম কোটি যুগ ধেয়ালাম/নদী হয়ে কাঁদিলাম খুঁজিয়া বুথাই \’২০ সহজ সরল ভাষায় ঈশ্বর অন্বেষণের নিত্য আকুতি তার। তার উপলব্ধিতে, ‘তোমারে কত নামে হায় ডাকিছে বিশ্ব শিশুর প্রায়,/কতভাবে পূজে তোমায় ফেরেশতা হুর পরী ইনসান \/ নিরাকার তুমি নিরঞ্জন, ব্যাপিয়া আছ ত্রিভুবন,/পাতিয়া মনের সিংহাসন, ধরিতে চাহে তবু প্রাণ \’২১ তিনি লিখেছেন, ‘অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক/গাহে তোমারি জয়। /আকাশ-বাতাস রবি-গ্রহ-তারা-চাঁদ,/হে প্রেমময়,/গাহে তোমারি জয়\ /…সকল জাতির কোটি উপাসনালয়/গাহে তোমারি জয় \ /…কোটি যুগ-যুগান্ত সৃষ্টি প্রলয়/গাহে তোমারি জয় \’২২
সকল পথের লক্ষ্য যিনি২৩ সেই খোদার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তোমার রূপের ইঙ্গিত খোদা/ফুটিছে বনের কুসুমে সদা/…ধানের খেতে নদী-তরঙ্গে/দুলে তোমার রূপ মধুর ভঙ্গে,/নিতি দেখা দাও হাজার রঙ্গে/অরূপ নিরাকার তুমি নিরঞ্জন।’২৪ রূপ-পিয়াসী কবির রচনা (১৯৪০), “তসবি’তে জপি যত তার নাম তত ঝরে আঁখি -নীর! /‘তশবিহি’ রূপ এই যদি তার, ‘তন্জিহি’ কিবা হয়,/নামে যার এত মধু ঝরে, তার রূপ কত মধুময়। /কোটি তারকার কীলক রুদ্ধ অম্বর-দ্বার খুলে/মনে হয় তার স্বর্ণ-জ্যোতি দুলে উঠে কৌতূহলে।”২৫ স্বর্ণ-জ্যোতির কথা কবি অনেক বার স্মরণ করেছেন। মুসা (মোজেস বা মোশি) যখন স্রষ্টাকে দেখতে চাইলেন তখন তুর পাহাড়ে জ্যোতির বিকীরণ চ্ছটায় তিনি মুর্ছা গেলেন। এই ঘটনায় আন্দোলিত কবি বহুবার সেই কোহ-ই-তুরের উল্লেখ করেছেন তার রচনায় এবং স্রষ্টার স্বর্ণ-জ্যোতি অবলোকনের নিবিড় আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন। তার প্রার্থনা, ‘তোমার প্রেমে সন্দেহ মোর/দূর করো নাথ ভক্তি দাও। /যেখানে হোক তুমি আছো-/ এই বিশ্বাস শক্তি দাও। /যে কোন জনমে আমি/পাবই পাব তোমায় আমি/অবিশ্বাসের আঁধার রাতে/তোমায় পাবার পথ দেখাও \’২৬
প্রিয় যে ঈশ্বর, চিস্তা-চেতনায় যে সতত বিরাজে, যার স্বর্ণ-জ্যোতির চ্ছটায় ত্রিভুবন আলোকিত সেই সুন্দরকে, শুধু ধ্যানে নয়, স্বপনে নয় স্বচক্ষে দেখার এক ব্যকুল বিপুল অসম্ভব বাসনা কবিকে দিশেহারা করেছে। ‘বিশ্ব ব্যাপিয়া আছো তুমি জেনে শান্তি তো নাহি পাই/রূপ ধরে এসো দাড়াও সমুখে দেখিয়া আখি জুড়াই।/…রূপের লাগিয়া কেন প্রাণ কাঁদে রূপ যদি তব নাই\’২৭ কিম্বা, ‘নব মেঘচন্দনে ঢাকি অঙ্গ জ্যোতি/প্রিয় হ’য়ে দেখা দাও ত্রিভুবন পতি।’২৮ এ সাধ তার শৈশব থেকে যখন লেটো গানে তিনি লেখেন, ‘দেখা দাও ওগো বারি এ গুনাহ্গারে/দর্শন বিনে তোমারে, কাঁদি জারে জার \ /একিন মনে ডাকি তোমায় ওগো এলাহী,/দয়া করে, এ অধীনে, দেখা দাও বারি,/নহিলে এ প্রাণ বধি, তরেতে তোমার \ /নিরঞ্জন, নৈরাকার, তুমি করতার,/তোমা বিনে দো-জাহানে কে বা আছে আর,/রাখিতে, মারিতে পার, তোমার এখতিয়ার\’২৯ ঈশ্বর দর্শনের আকাক্সক্ষা তার এত তীব্র যে ধর্মের দোহাই দিয়ে, মুহম্মদের দোহাই দিয়ে তিনি খোদার কাছে মিনতি জানিয়েছেন, ‘আছ সকল ঠাঁয়ে শুনি বলে সবে,/এমনি চোখে তোমার দিদার কবে হবে;/…তোমার হাবিবের আমি উম্মত এয় খোদা/তাইতো দেখিতে তোমায় সাধ জাগে সদা,/আমি মুসা নহি যে বেহুঁশ হয়ে পড়ব ভয়ে \’৩০ মুসা বেহুঁশ হ’য়ে পড়লেও তিনি পড়বেন না!! সুফিবাদে শ্রদ্ধাপ্লুত এক আত্মসমর্পিত মানুষের সীমাহীন অনুভূতি। মৃত্যুর আগে অন্তত: একবার সেই ঈশ্বরের দর্শনের আকুতি জানিয়েছেন তিনি, ‘তোমারে খুঁজিয়া সদা ফিরি ঘুরে/পাব কি গো দেখা বারেকের তরে/আমার জীবন সাঁঝে \’৩১ কবি যুক্তির আশ্রয় নেন, ‘ He is Omnipotent, He is potent to manifest Himself in any manner anywhere and at any time He likes.’ (যেহেতু ঈশ্বর সর্বশক্তিমান সেহেতু এই ক্ষমতা তার আছে যে তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনোভাবে যে কোনো স্থানে যে কোনো সময়ে নিজেকে প্রকাশ করবেন।)
যুক্তিও যখন হার মানে, প্রত্যাশা তখন পার্থিব লোক অতিক্রম করে যায়, ‘যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী/সেদিন তোমার দিদার (সাক্ষাৎ) আমি পাব কি আল্লাজী?/…আমি তোমায় দেখে হাজারো বার দোজখ যেতে রাজী/যেরূপে হোক বারেক যদি দেখে তোমায় কেহ/দোজখ কি আর ছুঁতে পারে পবিত্র তার দেহ।’ অগাধ বিশ্বাস আর অসাধারণ প্রত্যাশা তার। কবি হয়তো রোজ হাশরের সেই দিদার বা সাক্ষাতের আশাতেই চক্ষু মুদেছেন। নিরাকার এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরকে যে কোনো রূপে অনুভব করতে তার বাসনা ছিল। জীবনের শুরু থেকে সচেতন জীবনের শেষ অবধি সর্বশক্তিমান অনাদি অনন্ত সেই বিশ্ব-নিয়ন্তার ধ্যানে তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন। সেই ধ্যানের প্রকাশ তার অবয়বে নয়, সেই ধ্যানের প্রকাশ তার অনুভূতিতে, তার চিন্তা চেতনায় লেখনীতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়