আইপিও আবেদন করতে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ

আগের সংবাদ

‘ইভিএম’ রেখেই ভোটের ছক!

পরের সংবাদ

অনন্য নজরুল

প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অনন্য প্রতিভাধর ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মাত্র ২২ বছরের লেখকজীবনে তিনি অনেক অনেক কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেছেন। ছোটদের জন্যও লিখেছেন মজার মজার ছড়া, কবিতা ও গান।
যারা লেখালেখি করেন তারা জানেন, একটি ভালো লেখা লিখতে হলে দরকার হয় নিরিবিলি পরিবেশের এবং যে বিষয়ে লিখবেন আগে থেকেই সে বিষয়টি নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তার। কিন্তু লেখার জন্য নজরুলের কোনো পূর্বপ্রস্তুতির দরকার হতো না। যে কোনো পরিবেশে যখন-তখন তিনি লিখে ফেলতে পারতেন অনেক সুন্দর সুন্দর ছড়া, কবিতা বা গান। নজরুলের লেখালেখির শুরুটাই বলা যায় এক বিরূপ পরিবেশে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। সেনানিবাসে থাকা অবস্থায় তিনি রচনা করেন তার প্রথম গল্প ও প্রথম কবিতা। যুদ্ধ চলাকালীন একজন সৈনিক সেনানিবাসে বসে গল্প-কবিতা লিখছেন, ভাবা যায়! কিন্তু সেখানে বসেই তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠাতেন। নজরুলের তাৎক্ষণিক বুদ্ধি ও চিন্তাভাবনা যে কত প্রখর ছিল তা বোঝা যাবে নিচের ঘটনাগুলোর দিকে খেয়াল করলেই।

নজরুল তখন ম্যাডন থিয়েটারের একজন গীতিকার এবং সুরকার। বাজারে উর্দু কাওয়ালি গানের জয়জয়কার। ঠিক সে সময় একদিন শিল্পী আব্বাস উদ্দীন কবি নজরুলকে বললেন, এই যে কাজীদা, দেখুন, পাশের রুমে পিয়ারু কাওয়াল উর্দু কাওয়ালি গানের রিহার্সাল দিচ্ছে। বাজারে সেসব খুব চলছে। আপনি বাংলায় এমন কিছু গান লেখেন না কেন?
নজরুলের পাশে বসে থাকা কোম্পানির বাঙালি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, না না, ওসব চলবে না বাজারে।
এভাবে চলে গেল প্রায় এক বছর। কী ভেবে যেন এবার কর্তা রাজি হলেন। আব্বাস উদ্দীন ছুটে গিয়ে কবিকে বললেন, কাজীদা, কর্তা রাজি হয়েছেন।
এ খবর শুনে নজরুল একটি আলাদা রুমে গিয়ে ঢুকলেন। আব্বাস উদ্দীনকে বললেন, কিছু পান নিয়ে এসো। আব্বাস উদ্দীন পান নিয়ে এলেন ঠোঙা ভর্তি করে। কবি নজরুল বললেন, দরজাটা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো। পনেরো থেকে বিশ মিনিট পর কবি মাথা তুলে বললেন, এই যে নাও।
শিল্পী আব্বাস উদ্দীন তো অবাক। এই ক’মিনিটেই নজরুল লিখে ফেলেছেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি।

একবার নজরুল কুমিল্লায় গেছেন বেড়াতে। উঠেছেন ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত নামে একজনের বাড়িতে। তার ছোট্ট মেয়ের নাম অঞ্জলি। একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ল অঞ্জলির দিকে। দেখলেন, একটা পেয়ারাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কিন্তু কাছে গিয়ে গাছে কাউকেই দেখতে পেলেন না। অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে? অঞ্জলি বলল, ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালি। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না। কাঠবেড়ালির প্রতি অঞ্জলির এই আক্ষেপের কথা চিন্তা করে নজরুল লিখে ফেললেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’ নামের কবিতাটি-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?

আরেকটি ঘটনা। ছোটদের জন্য পাঠ্যবই লিখতেন আলী আকবর নামে এক লোক। একদিন তিনি নজরুল ইসলামকে একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে তার মতামত চাইলেন। পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, আপনার পাণ্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। যদি বলেন তো আমি একটা ছড়া লিখে দিতে পারি।
আলী আকবর সাহেব খুশিমনে রাজি হয়ে গেলেন। নজরুল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখলেন ‘লিচু চোর’ কবিতাটি-
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া…

আরেকদিন শিল্পী আব্বাস উদ্দীন কবি নজরুলের বাসায় গেলেন একটা ইসলামি গজল লিখিয়ে নেয়ার জন্য। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন। তিনি ইশারায় আব্বাস উদ্দীনকে বসতে বললেন। আব্বাস উদ্দীন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে উসখুস করতে লাগলেন। নজরুল বললেন, কী, তাড়া আছে নাকি?
আব্বাস উদ্দীন বললেন, ঠিক তাড়া নেই, তবে জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেয়ার জন্য।
নজরুল আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে বিছিয়ে দিলেন। আব্বাস উদ্দীন সেখানে জোহরের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল তার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার গজল। গজলটি ছিল-
হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ
দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ…’

কলকাতার এক বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী কবি নজরুলের কাছে এসে বায়না ধরলেন, একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতে হবে। কোম্পানিটির নাম ডোয়াকিন এন্ড সন্স। তাদের নির্মিত হারমোনিয়ামের জন্য নজরুল তখনই লিখে দিলেন একটি বিজ্ঞাপন-
‘কি চান? ভাল হারমোনী?
কাজ কি গিয়ে- জার্মানী?
আসুন দেখুন এইখানে
যেই সুর যেই গানে
গান না কেন, দিব্যি তাই
মিলবে আসুন এই হেথাই
কিননি কিন, ডোয়াকিন…’

পত্রিকায় ডোয়াকিন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে বাহাদুর কোম্পানি নামে আরেক বাদ্যযন্ত্রের কোম্পানির লোক ছুটে এলো নজরুলের কাছে। তাদেরও দাবি, আমাদের জন্যও লিখে দিন এমন একটি বিজ্ঞাপন। কী আর করা? কবি এবার লিখলেন-
“মিষ্টি বাহা বাহা সুর
চান তো কিনুন ‘বাহাদুর’।
দুদিন পর বলবে না কেউ ‘দূর দূর’
যতই বাজান ততই মধুর মধুর সুর!!
করতে চান কি মনের প্রাণের আহা দূর?
একটি বার ভাই দেখুন তবে ‘বাহাদুর’,
যেমন মোহন দেখতে তেমনি শিরীন ভরাট
বাহা সুর, চিনুন, কিনুন বাহাদুর।”
এরপর কয়েক মাস ধরে একই পত্রিকায় এ দুটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল একসঙ্গে।

কবি নজরুল কোনো অনুষ্ঠানের মধ্যে থেকেও ছড়া বানাতে পারতেন। পাড়ায় নতুন জামাই এসেছে। নজরুল বন্ধুদের নিয়ে ফন্দি আঁটলেন জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা খসাতে হবে। তিনি জামাইকে গিয়ে বললেন, নতুন জামাইদের দরমা পীরের দরগায় যেতে হয়। চলুন। নইলে অকল্যাণ হবে।
নজরুলের বুদ্ধিতে একটা পোড়ো বাড়ির মধ্যে ‘দরমা ঘর’ আগে থেকেই লাল কাপড়ে ঢেকে রাখা হলো। জামাই সেখানে গিয়ে সালাম করে নগদ সালামি দিলেন। অথচ ‘দরমা’ মানে হলো হাঁস-মুরগির ঘর। এরপর বন্ধুরা মিছিল করে জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলো। গেটে দাঁড়িয়ে নজরুল ছড়া কাটতে শুরু করলেন-
মাসি গো মাসি
তোমার জামাইয়ের দেখ হাসি
দরমা পীরে সালাম দেওয়ালাম
খাওয়াও মোদের খাসি।

জহিরুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়