প্রশ্নফাঁস : মাউশির অফিস সহকারী নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল

আগের সংবাদ

জীবনযাত্রায় চাপ আরো বাড়বে : গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব : শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে > সব পণ্যেরই দাম বাড়বে

পরের সংবাদ

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে কাটছাঁট নয় : বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও সংস্কারে জোর

প্রকাশিত: মে ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। প্রতি অর্থ বছরে টাকার অঙ্কে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও বাড়ছে না মোট বাজেটের অনুপাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে এই খাতে বরাদ্দ ১৫ শতাংশে উন্নীতকরণের নির্দেশনা থাকলেও তা রয়ে যাচ্ছে ৬ শতাংশের নিচে। সরকারের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা পেলেও পরিসংখ্যান বলছে, দেশের জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। এই অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। বাংলাদেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৪৫ ডলার। অপরদিকে নেপালে ৫৮ ডলার, ভারতে ৭৩ ডলার, ভুটানে ১০৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় ১৫৭ ডলার। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ অনেক কম। বরাদ্দের স্বল্পতা এবং দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতের প্রতি অবহেলার চিত্রটি ফুটে উঠেছে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর। তখন স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দৃষ্টি দেয় সরকার। বাজেটে বরাদ্দও বাড়ানো হয়। কিন্তু বরাদ্দের অর্থ পুরোপুরি খরচ করার সক্ষমতাও নেই এই খাত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। এমনকি করোনাকালের কেনাকাটায় একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দের পুরো অর্থ সময়মতো খরচ করতে পারেনি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে খরচ করতে না পারায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা সরকারি তহবিলে ফেরত গেছে বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, করোনা অতিমারির মধ্যে টিকা, ভেন্টিলেটর, এম্বুলেন্সসহ জরুরি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ১৩ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। তারা খরচ করতে পেরেছে ৮ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ও সবার জন্য সেবা

নিশ্চিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট বাজেটের শতকরা ৭ থেকে ৮ শতাংশ স্বাস্থ্যে বরাদ্দ প্রয়োজন। আর এই খাতের বড় অংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দের কথা বলেন তারা। অপরদিকে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে মন্ত্রণালয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সেবার প্রতিটি স্তরে আমূল সংস্কার করে পুরো স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর চেয়ে ব্যবস্থাপনার দিকে বেশি নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন।
এদিকে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দিকটা কতটা গুরুত্ব পাবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই দেখা গিয়েছে প্রশ্ন। কারণ সরকারের অর্থ বিভাগের বরাতে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে যে ধারণা করা হচ্ছে, চলমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে এ বছর কিছুটা সংকোচনমুখী বাজেট তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার। আয় বুঝে ব্যয় করার সক্ষমতা হয়তো আগামী বাজেটে দেখা যাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো কাটছাঁট করা একেবারেই সমীচীন হবে না। বরং এ খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে এর বড় অংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ করা এখন সময়ের দাবি।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য বাজেট বিষয়ক এক জাতীয় সংলাপে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৫ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মোট স্বাস্থ্য বরাদ্দের ২৫ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেয়া হয়। এই অনুপাত আসন্ন অর্থবছরে ৩০ শতাংশ এবং মধ্য মেয়াদে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ করতে হবে। সবার জন্য সেবা নিশ্চিতে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহে বরাদ্দ ৩ গুণ করতে হবে। এতে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে নাগরিকদের নিজস্ব খরচ ৬৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫৮ শতাংশের নিচে নেয়া সম্ভব।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য বাজেট নিয়ে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেছেন, গতানুগতিক বাজেট থেকে বেরিয়ে এসে শুধু বরাদ্দের মধ্যেই আটকে না থেকে তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরিতেও মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা বিষয়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি খুব কি বদলেছে? দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে হবে। বাজেটে টাকা বরাদ্দের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পুরনো মডেলের। এটা দিয়ে দেশের জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ সম্ভব নয়। সংস্কার অবশ্যই করতে হবে।
এদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে অঞ্চল ভেদে প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও বরাদ্দের ক্ষেত্রে তারতম্য নেই। এছাড়া ধনী দরিদ্রের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে যে ব্যয় সেখানেও রয়েছে বিস্তর তফাৎ। ধনীরা তাদের আয়ের ৫ শতাংশ ব্যয় করে স্বাস্থ্যে, আর দরিদ্ররা স্বাস্থ্যে ব্যয় করে তাদের আয়ের ৩৫ শতাংশ। এই বৈষম্য বাড়ছে।
এদিকে বরাদ্দকৃত অর্থ কেন খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য খাত- এর বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় চিকিৎসককে। রোগী দেখা ও প্রকল্প পরিচালনা দুটি কাজ একসঙ্গে করতে গিয়ে কাজের ব্যাঘাত ঘটে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও কেনাকাটার নিয়ম সম্পর্কেও তাদের তেমন ধারণা থাকে না। এছাড়া জমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদার নিয়োগের জটিলতায়ও বরাদ্দকৃত অর্থ সময়মতো ব্যয় করা সম্ভব হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য বাজেটের উন্নয়ন অংশের ব্যয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, এই অংশের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ খরচ করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কেনাকাটার বিষয়ে আটকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা কম। তাদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে। এ সংক্রান্ত নিয়মকানুনেও গলদ আছে। সমস্যা আছে অডিটেও। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সংস্কারে হাত দিতে হবে নাকি, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করার পর সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। তবে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করার জন্য টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়