এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের নিন্দা

আগের সংবাদ

পারাপারে প্রস্তুত স্বপ্নের সেতু : প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই উদ্বোধন, ১৫ দিনের মধ্যে শতভাগ প্রস্তুত হবে সড়কপথ

পরের সংবাদ

ফরিদ আহমদ দুলালের লোকসংস্কৃতি সন্ধান

প্রকাশিত: মে ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এখন যে-ভূখণ্ডের পরিচিতির জন্য ব্যবহার করতে হয় ‘বৃহত্তর’ শব্দটি, আগে ‘বৃহত্তম’ কথা দিয়েই তার গৌরবের প্রকাশ ঘটানো হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর নবম দশকে ব্রিটিশ শাসকরা যে ময়মনসিংহ জেলার পত্তন ঘটিয়েছিলেন, সেটি ছিল তৎকালীন ‘বঙ্গদেশ’-এর বৃহত্তম ও অখণ্ড ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। পাঁচটি মহকুমার সমবায়ে গঠিত এককালের ময়মনসিংহ জেলা এখন ছয় জেলায় বিভক্ত- টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সেরপুর (শেরপুর), ময়মনসিংহ ও জামালপুর। কিন্তু এমনটি হলে কী হবে, এখনকার মানুষের চৈতন্য থেকে সেই বৃহত্তম জেলার স্মৃতিটি কোনো মতেই মুছে যাওয়ার নয়। এখনো সেই ময়মনসিংহের জন্য তাদের আকুল আকুতি। সেই আকুতি পরিপূরণের জন্যই তাদের অনেকের দাবি ছিল “ময়মনসিংহ ‘বিভাগ’ (ডিভিশন) চাই।” ছয়টি জেলার প্রতিটির নামের আদ্যক্ষর সংযোগে রচনা করেছে তারা একটি অভিনব বাক্য- ‘টানে কিসে মজা’।
সেই টানে মজা লোটার ইচ্ছারই অভিব্যক্তি ঘটেছে ফরিদ আহমদ দুলালের ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান’-এও। ‘সন্ধান’ করে দুলাল নিয়ে এসেছেন লোকসংস্কৃতির অমূল্য মণিমাণিক্য। সেইসব মণিমাণিক্যের দীপ্তিও যেমন, বৈচিত্র্যও তেমনই।
সংস্কৃতিকে যারা কেবলই সুকুমার শিল্পকলা এবং আচার-আচরণে সুষ্ঠুতা ও শিষ্টাতার বৃত্তেই আবদ্ধ করে রাখেন, দুলাল তাদের দলে নন। তিনি সংস্কৃতির আত্মিক বা ভাবগত রূপকে যেমন দেখেন, তেমনই দেখেন এর বস্তুগত রূপরাশিকেও। তাই তিনি ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকার লোকসমাজে প্রচলিত ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা, সঙ্গীত ও বিভিন্ন ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানের অনুসন্ধানের পাশাপাশি এখানকার গৃহনির্মাণ-গৃহসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যসামগ্রী, কৃষিকাজ-কৃষিব্যবস্থার মতো সবধরনের বস্তুগত কর্মকাণ্ডের স্বরূপ-প্রকৃতিরও সন্ধান করেন। তিনি যে শিল্পের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, সে-শিল্প কেবল আর্ট নয়- ইন্ডাস্ট্রিও। ইন্ডাস্ট্রির ভিত্তির ওপরই তো গড়ে ওঠে আর্টের ভাবলোক, তথা সমগ্র মানবিক সংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতিও তার ব্যতিক্রম নয়, ব্যতিক্রম ঘটেনি ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতিতেও।
ময়মনসিংহের অধিবাসীদেরই অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ আদিবাসী জনগণ। এখানকার আদিবাসী লোকসাধারণ তাদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিকে যেমন লালন করেছে, তেমনই অন্য অধিবাসীদের সংস্কৃতির উপাদানও পরিগ্রহণ করেছে। আবার আদিবাসীদের সংস্কৃতির উপাদানে সমৃদ্ধ হয়েছে অন্যদের সংস্কৃতিও।
তাই ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতির পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যায় আদিবাসীদের সংস্কৃতির স্বরূপসন্ধান ছাড়া। সেই স্বরূপ-সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েই ফরিদ আহমদ দুলাল তার বইয়ে সংযুক্ত করেছেন ‘আদিবাসীদের সংস্কৃতি’ শীর্ষক অধ্যায়টি। লোকসংস্কৃতির আলোচনা করতে গিয়ে অনেক ধীমান সংস্কৃতি-বিশেষজ্ঞও আদিবাসী ও তাদের সংস্কৃতির কথাটি বেমালুম ভুলে থাকেন। দুলাল কিন্তু ভোলেননি।
ময়মনসিংহের বিস্তৃত অঞ্চলে লোকসাধারণের সংস্কৃতি যে বহুবৈচিত্র্যের ধারক, সেই বৈচিত্র্যের অনুপুঙ্খ বিবরণ প্রদান মোটেই সহজ নয়, অসম্ভবই বলা যায়। তবে এককালের ময়মনসিংহ জেলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করে দেখানো যেতে পারে। অনেকেই তেমনটি দেখিয়েছেন। প্রথমে দীনেশচন্দ্র সেন ও পরে আশুতোষ ভট্টাচার্যের সমীক্ষায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই তীরে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য-মণ্ডিত দুটো পৃথক সংস্কৃতি-অঞ্চল। পশ্চিম ময়মনসিংহ বাংলার পাল ও সেনরাজদের আধিপত্যের অধীন হয়েছিল। তার ফলে সেখানকার সংস্কৃতি বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে, ধর্মতান্ত্রিক উপাদান-উপকরণ সে-সংস্কৃতিতে বিপুল পরিমাণে প্রবিষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব ময়মনসিংহের অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ অঞ্চলটি পরোক্ষভাবে কামরূপের সঙ্গে যুক্ত ছিল, প্রত্যক্ষ রাজতন্ত্রের প্রভাব-বলয়ের বাইরে অবস্থিত থেকে এখানে গড়ে উঠেছিল অনেক স্বশাসিত রাজ্য, সেই রাজ্যগুলোতে আদিম সাম্যবাদী সমাজের অনেক উপাদানই ছিল বিদ্যমান। এখানকার লোকসাধারণের ধর্মভাবনা তথা জীবনাচরণও ছিল একান্তই লৌকিক, ধ্রæপদী ধর্মের অনুশাসনকে তারা থোড়াই পরোয়া করেছে। এ রকম পরিবেশ ও পরিমণ্ডলেই লালিত-বর্ধিত হয়েছে এখানকার লোকসংস্কৃতি। তাই এই লোকসংস্কৃতি যথার্থই লোকায়ত, তথাকথিত শিষ্টসংস্কৃতি এর লোকায়ত চরিত্রকে ব্যাহত করতে পারেনি। এখনো সংস্কৃতির বহুমুখী আগ্রাসনের যুগেও, পূর্ব ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি তার আপন বৈশিষ্ট্যকে সর্বাংশে না হলেও, বহুলাংশেই অবিকৃত রাখতে পেরেছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে ফরিদ আহমদ দুলালের বইটি পাঠ করলেই ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতির প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে স্পষ্ট অনুধাবনা সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়