এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের নিন্দা

আগের সংবাদ

পারাপারে প্রস্তুত স্বপ্নের সেতু : প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই উদ্বোধন, ১৫ দিনের মধ্যে শতভাগ প্রস্তুত হবে সড়কপথ

পরের সংবাদ

উপাত্ত সংগ্রহ : স্মৃতি ও সখ্যের গল্প

প্রকাশিত: মে ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বহুমাত্রিক লেখক ফরিদ আহমদ দুলাল। কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, লোকগবেষক, সম্পাদক, সাহিত্য সংগঠক, এরকম আরো কতকিছু। তার সঙ্গে আমার যৎকিচির পরিচয় ছিল লেখার সূত্রে। দেখাও যে হয়নি এমন নয়, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার শুরু দেড় যুগ আগে। কবি মাহমুদ কামালের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম এক সাহিত্য সভায় প্রধান আলোচক হয়ে। আমার মূল বক্তব্য ছিল কবিতার নির্মাণকলা আর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা। সেই সভায় পঠিত কবিতাগুলোর ওপর আলোচনা করেছিলেন দুলাল। তখনি তার মননশীলতার বিশেষ পরিচয় পাই। পরবর্তীকালে কবিতা বিষয়ে দুলালের গভীর অনুসন্ধিৎসা এবং প্রজ্ঞার স্বাক্ষর বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি আমি।
সেবার আমার টাঙ্গাইল যাওয়ার আরেক মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল টাঙ্গাইল শহরের অদূরে প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস পাথরাইল গ্রাম সরজমিন পরিদর্শন। আমার সঙ্গী আশরাফুজ্জামান ছাড়াও টাঙ্গাইলের এক তরুণ অধ্যাপক আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করছিলেন। পাথরাইলে পৌঁছেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম। কাজ মানে জরিপ। জরিপের জন্য আগে থেকেই আমরা করে রেখেছিলাম একটি ফরম্যাট। তাকে অনুসরণ করে তথ্য। এই ফরম্যাটেরই একটা অংশ ছিল আর্থিক মূল্যায়ন। একেবারে আনকোরা হয়েও দুলাল সেই ফরম্যাটটি অবলীলায় আয়ত্ত করে নিলেন। ফলে আমার কাজ অর্ধেক কমে গেল। আমি ছোট্ট টেপ-রেকর্ডার হাতে ইন্টারভিউ করছি, প্রশ্ন-উত্তর করছি, জামান মুভি ক্যামেরায় তা ধারণ করছেন, আর দুলাল দ্রুত হাতে মূল বিষয়গুলো লিখে নিচ্ছেন।
সারাদিন লেগে গেল পাছরাইল নামক এই অনন্য গ্রামটির ছয় শতাধিক তাঁতী পরিবারের অনুপূর্ব জরিপ শেষে টাঙ্গাইলে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রেস্ট হাউসে ফিরতে। রাতে আহার ইত্যাদির পর পুরো প্রতিবেদনটি তৈরি হলো বাংলায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ল্যাপটপে তার ইংরেজি অনুবাদ করে নিলাম।
পুরোটা দিন আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, দুলাল কেবল হিসাব-নিকাশে বা তথ্যবিশ্লেষণেই পারঙ্গম নন, তিনি লোকসংস্কৃতিতেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অঙ্গীকৃত। আমি তখন পুরো বাংলাদেশকে মোট আটটি লোকসাংস্কৃতিক এলাকায় ভাগ করে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি এলাকা সফর করছি এবং লোকসংস্কৃতির আর্থিক মূল্যমান নির্ণয়ের জন্য একটি পরীক্ষামূলক চিরুনি-জরিপ সম্পাদন করে চলেছি। আর প্রতিটি এলাকার সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছি এক-একজন মুখ্য গবেষককে। ভাবছিলাম ময়মনসিংহ এলাকার দায়িত্ব হয়তো ওই এলাকার কোনো কলেজের প্রবীণ কোনো গবেষক অধ্যাপককে দেব। কিন্তু দুলালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি ভিন্ন চিন্তা করতে শুরু করলাম। তারপর প্রায় অঘোষিত পরীক্ষা হিসেবে আমি তাকে আমার প্রদত্ত ফরম্যাট অনুযায়ী বৃহত্তর ময়মনসিংহের ওপর একটি প্রতিবেদন দিতে বললাম। ভাবছিলাম হয়তো পৃষ্ঠা দশেকের এক প্রতিবেদন আমি পাব। কিন্তু আমাকে অবাক করে তিনি প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার একটি সুবিস্তৃত প্রতিবেদন দিলেন, যা প্রত্যক্ষ তার বহুদিনের সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার ফল। সেই থেকে দুলাল আমার সর্বকাজে মূলত সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়ালেন। আমি লোকবাংলা নামক একটি সংগঠন করলাম লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার জন্য। দুলাল তাতেও প্রায় সার্বক্ষণিক শ্রম ও মেধা দিতে লাগলেন। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তার একটি গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে পেরে, কেননা ওটি বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে তার একক সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার প্রশংসনীয় স্বাক্ষর। সন্দেহ নেই, এই গ্রন্থের বিষয়-বিন্যাসে জেনেভাস্থ ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অরগানাইজেশন প্রদত্ত গাইডলাইন ও মৎপ্রদত্ত রূপরেখা প্রধানভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমে প্রতিটি জেলার পরিচিতি, তারপর মূর্ত (টেনজিবল) ও বিমূর্ত (ইনটেনজিবল) এই দুই প্রধান শাখায় সব লোকসাংস্কৃতিক উপাদান ও অভিব্যক্তিকে ভাগ করে আইটেমমাফিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিষয়টা খানিকটা জাল দিয়ে পুকুরের সব মাছ ছেঁকে আনার মতো। তারপর মাছগুলো শ্রেণি ও নাম অনুযায়ী আলাদা করে প্রতিটির বর্ণনা, বিশেষত্ব, সম্ভাব্য দাম ও তার সর্বমোট মূল্যমান প্রাক্কলন করার মতো। সবচেয়ে কঠিন কাজ মেধাস্বত্ব নির্ধারণ, যার ফলে এই মূর্ত ও বিমূর্ত সম্পদের একটি আনুপূর্বিক মূল্যমান নির্ণয় করা সম্ভব। প্রথাগত লোকসাংস্কৃতিক গবেষণায় এটি একটি নতুন মাত্রা। বলাবাহুল্য, বিশ্বে লোকসংস্কৃতি শনাক্তকরণ, তার মূল্যমান নির্ণয় ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে এই পদ্ধতির প্রায়োগিক সাফল্য অপরিসীম। আমাদের সৌভাগ্য, এই ধরনের গবেষণা বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। দুলালের গবেষণা সেই ঘরানারই প্রত্যক্ষ ফসল। আসলে দুলাল আমাকে যে ৫০ পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি দিয়েছিলেন, তারই সম্প্রসারিত ও প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপ তার ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান’ গ্রন্থটি।
লোকসংস্কৃতি মূলত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত লোকমনীষার ক্রমবিবর্তিত রূপ। এখানে প্রচলিত অভিব্যক্তির পাশাপাশি রয়েছে বিপন্ন, প্রায় বিলুপ্ত আর বিলুপ্ত অভিব্যক্তিরও ছায়া-রূপ। এই শেষোক্ত অভিব্যক্তি শনাক্তকরণ বা তার সম্ভাব্য পুনরুজ্জীবন একটি দুঃসাহসিক কাজও বটে। দুলাল এ ধরনের কিছু অভিব্যক্তির ছায়া-রূপ শনাক্তকরণেও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আর প্রচলিত প্রায় সব মৌখিক, লৌকিক ও হস্তশিল্প জাতীয় প্রকরণ দলিলীকরণ করেছেন। বলাবাহুল্য, এই ফরম্যাট অনুসরণ করে আমি এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত’ নামক একটি প্রামাণ্য গবেষণাগ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করেছি কয়েক বছর আগে। দুলাল সেখানেও একই বিষয়ে একটি অনুসন্ধিৎসু প্রবন্ধ জমা দিয়েছিলেন। বর্তমান গবেষণায় সেটিও সহায়ক হয়েছে বলে মনে করি। যে সব বিষয়ে এই গ্রন্থে অপূর্ণতা থেকে গেল তা পরবর্তী সংস্করণে (যদি হয়) দূর করা বাঞ্ছনীয়। কেননা বিশেষ সময়ের পর উপকরণ, অভিব্যক্তি ও প্রকাশভঙ্গি সাধারণত বদলে যাওয়াই লোকসংস্কৃতির সচল রীতি।
গ্রন্থটি পাঠক-গবেষক সবার কাজে আসবে বলে মনে করি। কেননা তৃণমূলীয় সংস্কৃতিই একটি জনগোষ্ঠীর তথা জাতির অবিকৃত ইতিহাসের তথ্য ও উপাত্ত। দুলালকে অভিনন্দন, এমন একটি সময়ানুগ ও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য।
এ ধরনের গ্রন্থ যত বহুল পঠিত হবে, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। ফরিদ আহমদ দুলালের মতো একজন নিষ্ঠ কবি, গভীর মননের প্রাবন্ধিক, বহুল আলোচিত নাট্যকার সর্বমহলে সমাদৃত হবেন, এই প্রত্যাশা আমার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়