করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এশীয় রাজনীতি-কূটনীতি

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ মহাদেশ এবং প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত ও স্বীকৃত। মানব সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে আবির্ভূত ধর্মগুলোরও উৎস এই মহাদেশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক চেতনার প্রকাশ ঘটাতে, বিশেষ করে শিক্ষা, দর্শন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতির উন্নত যাত্রায় সঙ্গী হয়ে উৎকর্ষ ঘটাতে না পারলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় অন্যের প্রভুত্ব।
এই পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এশিয়া অনেক পিছিয়ে পড়েছে, ইউরোপ উল্লেখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে দৌড়ে এগিয়ে। সেক্ষেত্রে যে সাহস, মেধা ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন তার প্রকাশ ঘটিয়েছে ইউরোপ, বিশেষ কয়েকটি জাতিরাষ্ট্র। ভূপর্যটনে, নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারে পর্তুগালের ছোট্ট দেশেরও কী দুঃসাহসী ভূমিকা। ব্রিটেন, স্পেন, এমনকি বেলজিয়ামের মতো দেশও উপনিবেশ স্থাপনে বিশিষ্ট। সবারই টার্গেট অজানা দেশ-মহাদেশ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এমনকি প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো। বিশেষ লক্ষ্য কিংবদন্তির ভারতীয় উপমহাদেশ।
কারণ একটাই। ইউরোপজুড়ে প্রচলিত প্রবাদ- ভারতের গাছের পাতা থেকেও সোনা ঝরে। মনে পড়ে দশম শ্রেণির স্কুলপাঠ্য বইয়ের একটি প্রবন্ধে ভারতকে সমৃদ্ধি বিচারে রূপকথার দেশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রচীন ও মধ্যযুগে আমরা দুই ‘গ্রেট’-এর সন্ধান পাই- সম্রাট অশোক ও বাদশাহ আকবর। শেষোক্তজন ‘দ্য গ্রেট মুঘল’ হিসেবে পরিচিত। এরা ‘আলেকজান্ডারের দ্য গ্রেট’-এর চেয়েও সুশাসনের জন্য স্মরণীয়।
যতদূর মনে পড়ে (৭৪ বছর পর) ওই প্রবন্ধের প্রথম বাক্যটি ছিল এ রকম : ‘দ্য গ্রেট মুঘল ওয়াজ অ্যা সর্ট অব ফেয়ারি টেল ইন দ্য ওয়েস্ট।’ সোনার ভারত আবিষ্কারের জন্য পশ্চিমা দেশ ও তাদের ভূপর্যটকদের মধ্যে প্রবল উন্মাদনা ও প্রতিযোগিতা। বঙ্গের শিশুপাঠ্য বইতে এদের অমানবিক চরিত্র ভুলভাবে আদর্শরূপে (দুঃসাহসী) চিত্রিত। অথচ নিরীহ কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে নিয়ে দাসপ্রথা প্রচলনের ন্যক্কারজনক ভূমিকা তো কলম্বাসেরই। ইদানীং শ্বেতাঙ্গা-কৃষ্ণাঙ্গ সংঘাতে এবং মার্কিনি পুলিশের কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনায় (আই ক্যান্ট ব্রিফ) যে বিশাল আন্দোলন, তার সুফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে বহু নামিদামির নাম এই দাস ব্যবসার জঘন্যতম অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত। ইতিহাসের সেসব কালো অধ্যায় এখন নিন্দিত আলোচনায় উঠে আসছে। এতে সবার সেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারপরই ব্রিটেন, স্পেন এবং আরো একাধিক কথিত সভ্য রাষ্ট্র!

দুই.
মূল বিষয়ে যাবার আগে এক পাতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচনার উদ্দেশ্য একটি সত্য পাঠককে অবহিত করা যে এশিয়ার উল্লিখিত পিছিয়ে পড়ার দায় এশিয়ারই। ইউরোপ যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন চর্চায় মগ্ন আরব বোদ্ধাদের উত্তরসূরি হিসেবে তখন উপমহাদেশীয় শাসকবর্গ বিলাসী জীবন উপভোগে মগ্ন। এ জাতীয় জীবন ইউরোপীয় সম্রাটগণও যাপন করেছেন, কিন্তু তাদের বোদ্ধা সমাজের লক্ষ্য ছিল ভিন্নতর। এর সুফল ভোগ করেছে ইউরোপ, কখনো সদ্ব্যবহারে, প্রায়শ আগ্রাসী অসদ্ব্যবহারে। পরিণাম বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ এবং ঔপনিবেশিক শোষণ ও অত্যাচার আর স্বদেশের সমৃদ্ধি অর্জন।
এর সর্বাধিক ভুক্তভোগী ব্রিটেন, পৃথিবীর দুই গোলার্ধে যাদের উপনিবেশ- যেজন্য প্রবাদবাক্য : ‘মহারানীর (ভিক্টোরিয়া) রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না।’ পৌনে দুইশ বছর ভারত শাসন করেছে ব্রিটেন- সূচনা বৃহৎ বঙ্গে মীরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখের দেশবিরোধী বিশ্বাসঘাতকতায় (১৯৫৭) পলাশীর যুদ্ধে। একশ বছর পর (১৮৫৭ থেকে) হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত বিদ্রোহ (কারো মতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ)। অসম শক্তির যুদ্ধে বিদ্রোহীদের পরাজয়।
চতুর ইংরেজ এই যুদ্ধ- এবং এর আগে দীর্ঘস্থায়ী ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নেয়, ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (‘ডিভাইড এন্ড রুল’) নীতির বরাবর প্রয়োগে। এরই সুফল পৌনে দুশ বছর ভারত শাসন বহু আন্দোলন ও সন্ত্রাসী গুপ্তহত্যার মুখে। অবাক লাগে সমাজে ম্যাক ডোনাল্ডের মতো উদারপন্থি (কারো মতে ভারত শ্রেষ্ঠ) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ‘কজিউনাল অ্যাওয়ার্ড’ (সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ) কমন্স সভায় পাস (১৯৩২) এবং ১৯৩৫-এ তা ভারতে প্রবর্তন। দুই সম্প্রদায়ের পথ আলাদা করার এই অপচেষ্টা সমৃদ্ধ হয় জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘোষণায়।
পরিণাম লাগাতার দাঙ্গা বাংলা-বিহার-বোম্বাই-মধ্যপ্রদেশজুড়ে। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাধান্য।
শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দৌত্যে সমঝোতামূলক ক্রিপস মিশন (১৯৪২) এবং সর্বশেষ প্রভাবশালী কেবিনেট মিশন প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির চেষ্টায়। এ প্রস্তাব (আধা পাকিস্তান অখণ্ড ভারতে) মন্দের ভালো হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল, যেজন্য মৌলানা আজাদ অক্লান্ত পরিশ্রম করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন প্লানে দুই পক্ষের অনিচ্ছামূলক বাধ্যতায় ভারত ভাগ পরিকল্পনা গ্রহণ। কংগ্রেস ওয়ার্কি কমিটির অধিবেশনটি ছিল উত্তেজনায় টানটান। সম্ভবত কুখ্যাত কলকাতা দাঙ্গার (১৯৪৬) প্রভাবে এ সিদ্ধান্ত। দাঙ্গার উৎস জিন্নাহর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন। আশ্চর্য, বোম্বাই, লাহোর, মাদ্রাজ, এলাহাবাদ ছেড়ে কলকাতাকে বেছে নেয়া হলো দাঙ্গার অকুস্থল হিসেবে। এর দায় জিন্নাহ এবং বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেয়ার ব্যর্থতায়। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার।
এবার পূর্বেকার কথায় ফিরি। সেই উত্তপ্ত, উত্তেজনাপূর্ণ বা প্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায়, আরএসপি নেতা রামমনোহর লোহিযার অভিযোগ, আজাদ নাকি নিঃশব্দে একটানা সিগ্রেট টানে সভার দূর প্রান্তে একাকী বসে। আমি বলি, এছাড়া কী করার ছিল আজাদের? তার প্রস্তাব তো কমিটিতে সমর্থন পায়নি। কমিটি শেষ পর্যন্ত পূর্ব প্রস্তাবের চেয়ে নিকৃষ্ট মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব ও দেশভাগ মেনে নিল।
প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় পাখতুন নেতা বাদশা খান নীরব গাজ্জীকে লক্ষ্য করে বলেন, এতদিন কংগ্রেসের সঙ্গে এক কাতারে শেষ পর্যন্ত এই পরিণাম যে আপনারা আমাকে নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলে পিছু হটলেন, ভারত ভাগ মেনে নিলেন? এর পরিণাম ভারতের জন্য শুভ হবে না। আশ্চর্য, বাদশা খানের এই আবেগসিক্ত বক্তব্যেও শীর্ষনেতাদের মন ভিজেনি। গান্ধী নীরব, তেমনি নেহরু, নেহরু কি মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব গ্রহণে এডুইনাপ্রেমে প্রভাবিত হয়েছিলেন? কুলদ্বীপ নায়ারের গবেষণাজাত স্মৃতিকথাও এর জবাব দিতে পারবে না।
ঠিকই বলেছিলেন বাদশা খান (খান আবদুল গাফফার খান)। পাকিস্তান আমলে তার বাকি জীবনটা কেটেছে কারাগারে, না হয় কাবুলে মিত্রদের মাঝে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। শীষ পাখতুন নেতাদের একই অবস্থা। এমনকি পুত্র ওয়ালি খানেরও। অতএব ভারত ভাগ, বঙ্গ ও পাঞ্জাব ভাগ। দাঙ্গায় লাখো নিরীহ মানুষের মৃত্যু, কোটি মানুষের বাস্তুত্যাগ। কুলদীপের মতো বহু শিখ ও হিন্দু পরিবার বাস্তুত্যাগী, দুঃসহ শরণার্থী জীবন। একই অবস্থা পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুদের, ব্যতিক্রম নিম্নবর্গীয়রা। এক জিন্নাহকুহকে মন্ত্রী যোগেন মণ্ডল। শেষ পর্যন্ত তাকেও দেশত্যাগী হতে হলো। এই ছিল দেশভাগের পরিণাম।

তিন.
ইতিহাসবিদ কারো নাকি তার মৃত্যুপূর্বলগ্নে তার সিদ্ধান্তের জন্য মনস্তাপে ভুগতেন। কথাটা বিশ্বাস হয় না। তবে এটা ঠিক, জীবন সায়াহ্নে দেশভাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল (সূত্র, তার এডিসি)। কিন্তু ভারত ভেঙে গান্ধী-নেহরুকে এক হাত নেবার পরিতৃপ্তি তার অহমবোধের। তবে পাকিস্তানের বর্তমান দশা দেখতে পেলে তার তৃপ্তি হাওয়ায় উড়ে যেত। তবে তার যা নিরাসক্ত, নির্মম ব্যক্তিত্ব তাতে উত্তরসূরি কিরভ হত্যার প্রতিক্রিয়ায় স্তালিনের দিশাহারা হওয়ার মতো অবস্থা তার হতো না, এটা ঠিক।
এবার মূল এশিয়া প্রসঙ্গ। তিরিশে রবীন্দ্রনাথ এক প্রবন্ধে বিশ্ব রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ এশিয়ার বিশেষ ভূমিকা পালনের কথা লেখেন, যা বহুধা বিভক্ত এশিয়ায় অসম্ভব বলা চলে। এশিয়ার বর্তমান রাজনেতিক চালচিত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্বে অবশ্যই ভারতের কথা উঠবে। সার্কের ব্যর্থতার কথা মনে রেখে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোন ভারত এ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম? সংবিধানসম্মত নেহরুর সেকুলার ভারত নাকি মোদির হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া ভারত, যেখানে এখনো সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা অব্যাহত? সে নেতৃত্ব কি সবার মনঃপুত হবে?
বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্কের পরিবেশে বাংলাদেশ হয়তো বিরোধিতা করবে না। কিন্তু প্রশ্ন থাকে বর্তমান পরিবেশেও মমতার বিরোধিতায় বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত হলো না। লক্ষণীয় যে, ভারতীয় সাংবাদিকদের অনেকেই (যেমন- জয়ন্ত ঘোষাল, সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ) বাংলাদেশের সঙ্গত দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা যুক্তি, তথ্য দিয়েই লেখেন। কিন্তু তাতে কোনো সুফল মেলেনি, সেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে মোদি পর্যন্ত আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
জয়ন্ত ঘোষালের কালের কণ্ঠে লেখা ‘দিল্লির চিঠি’র শিরোনাম : ‘ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে এগোতে হবে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভারতের সশস্ত্র সহযোগিতার ভূমিকার কথা মনে রেখে এমনটাই যুক্তিসঙ্গত হওয়ার কথা। শ্রীঘোষালের রচনাটি বহুমাত্রিক। তাই সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে বরং বলি, সেই যৌথযাত্রার নেপথ্যনীতি হবে উভয়ত সমস্বার্থভিত্তিক।
বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়ার দুটি বৃহৎ দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য তথা পণ্যবাজার সম্পর্ক গভীর, যেমন ভারত ও চীন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কের বিষয়টি বহুল আলোচিত, এর মধ্যে ভিন্নমতও রয়েছে। চীনা বিনিয়োগ ও চীনা পণ্যে বাংলাদেশের বাজার কম ভর্তি নয়। পারম্পরিক সম্পর্ক ভালোই বলতে হবে। রাষ্ট্রনৈতিক-কূটনৈতিক যোগাযোগও কম নয়।

চার.
চীন এখন শুধু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেই নয়, গোটা এশীয় মহাদেশে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় অবস্থান করছে, এবং তা আন্তর্জাতিক শক্তির বিচারেও। বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হলো সেই চীন এবং বাংলাদেশের মিত্র ভারতের সম্পর্কটা যথেষ্ট মসৃণ নয়। কারণ আর কিছু নয়, মূলত সীমান্তরেখা নিয়ে বিরোধ। এর সূচনা ১৯৬২-এর চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময় থেকে, যখন থেকে ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ সম্পর্কের মধুচন্দ্রিমার অবসান।
চীন-ভারত মধুর সম্পর্কের রূপকার ছিলেন মূলত ভারতের সেকুলার গণতান্ত্রিক উদারচেতা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, যিনি গান্ধীর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র লেখক নেহরু শুধু মননশীল রোমান্টিক চরিত্রের রাজনীতিকই ছিলেন না যৌবনে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার কিছুটা মোহ ছিল। কিন্তু পথ পাল্টে গেল কংগ্রেসে গান্ধী নেতৃত্ব অবিসংবাদিতভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে, যখন এই প্রতিভাবান যুবকটির প্রতি গান্ধীর সুনজর স্থির হলো, আর নেহরুও বাঁধা পড়লেন গান্ধী-আশ্রমের জালে।
কংগ্রেস দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নেহরুর প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, যিনি একাধারে রক্ষণশীল (নন-সেকুলার) এবং প্রচণ্ড রকম সমাজতন্ত্রবিরোধী। দলে গান্ধীর পর নেতৃত্বের এক নম্বর পদটির প্রতি তীক্ষè নজর ছিল তার। কিন্তু গান্ধী সম্ভবত মানব চরিত্র মোটামুটি ভালোই বুঝতেন। তাই গান্ধীভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি নেহরুর পর অর্থাৎ দুই নম্বর পদটি প্যাটেলের জন্য নির্দিষ্ট করেন।
প্যাটেল ছিলেন কঠিন প্রকৃতির বাস্তববাদী রাজনীতিক, সম্ভবত এই চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য নম্র প্রকৃতির গান্ধীর পছন্দসই ছিল না। অন্যদিকে প্যাটেলের আরেক বৈশিষ্ট হিন্দু মহাসভার প্রতি আকর্ষণ। এ বৈশিষ্ট্যও ‘রামধুন’ গায়ক গান্ধীর ভালো লাগার কথা নয়। গান্ধী রাম রাজ্যের প্রবক্তা হয়েও মোটামুটি হিসেবে অসাম্প্রদায়িকই ছিলেন।
অদ্ভুত স্ববিরোধিতা যে গান্ধী কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা প্রায় সবাই (রাজেন্দ্র প্রসাদ, পন্থ প্রভৃতি) কম-বেশি রক্ষণশীল। এটা ডা. আনসারি, আসফ আলী, কিদোয়াই প্রমুখের উপস্থিতি সত্ত্বেও। মৌলানা আজাদ এখানে ‘মিসফিট’, যেমন অংশত ‘মিসফিট’ নেহরু। গান্ধীই তাকে কংগ্রেসের এক নম্বর নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। রোমান্টিক ও আবেগপ্রবণ নেহরু এত বড় বহুজাতিক দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য পুরোপুরি যোগ্য ছিলেন কী না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিছু ঘটনা তেমন সাক্ষ্যই দেয়।
কথিত আছে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইয়ের কক্ষের একটি চীনা মানচিত্রে ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডের কিছুটা চীনের অন্তর্ভুক্ত দেখে নেহরুর প্রশ্নের জবাবে চৌ-এর ব্যাখ্যা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেই থেকে চীনা বন্ধুত্ব নিয়ে মাথায় কাঁটার খচখচ। সর্বশেষ আঘাত চীনের ভারত সীমান্ত আক্রমণ, ভারতের পরাজয়। সান্ত¡না চীনা সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ভারত ভূমি ও সীমান্ত রেখার ওপারে চলে যায় শক্তি প্রদর্শন শেষে। অনেকের ধারণা এই মানসিক আঘাতেই ইমোশনাল নেহরুর অকাল মৃত্যু (১৯৬৪)।
তাতে প্যাটেলের ইচ্ছাপূরণ হয়নি। তিনি আগের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই থেকে গেলেন। মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকে বড় একটা প্রাধান্য দিতেন না। তার যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী গুজরাতি নরেন্দ্র মোদি, যদিও স্বভাব বৈশিষ্ট্যে দুজনের মধ্যে অনেক প্রভেদ। তবু তার নির্দেশে প্যাটেলের বিশাল পূর্ণদৈর্ঘ প্রতিমূর্তি স্থাপন। যোগ্যকর্মই বটে!
নেহরু সম্পর্কে আর দুই-একটি ঘটনা বলে এ প্রসঙ্গের ইতি টানব। চীনা আক্রমণের মর্মবেদনা ও পরাজয়ের গøানি মাথায় নিয়ে জনপ্রিয় নেতার পৃথিবী থেকে বিদায়, সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত না করার একরাশ অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার নম্র, বিদগ্ধ মননশীলতার বোদ্ধা সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে তার প্রতি শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন। তাই তার অকাল প্রয়াণে শোকার্ত রাজনৈতিক (সিপিআই) সাংস্কৃতিক নেতার মন্তব্যের অংশবিশেষ- অ্যা গ্রেট কলোসামের বিদায়। কথাটা কংগ্রেসবিরোধী রাজনৈতিক নেতা অনেকের সমালোচনার উপকরণ জোগায়।
আরেক সাবেক মার্কসবাদী শোকার্ত কবি আবেগভরে লেখেন : ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে।’ শবদেহের কফিনে স্তূপীকৃত ফুল দেখে কবির প্রতিক্রিয়া। এসব তো নেহরুর মৃত্যু পরবর্তী অনেক ঘটনার দু-একটি। কিন্তু যে তথ্য পাঠকের বিস্ময় জোগাবে তাহলে তারুণ্যে নেহরুর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া পড়ে চে-গুয়েভারা এতটা মুগ্ধ হন যে দীর্ঘদিন পরেও নেহরুর সঙ্গে দেখা করার জন্য দিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু আলাপ করে খুশিমন নিয়ে ফিরতে পারেননি। কারণ ততদিনে দুজনের চিন্তা জগতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। তবু ঘটনাটি ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকার যোগ্যতা রাখে।
কংগ্রেসি অবাঞ্ছিত শাসন সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর প্রতি গণতন্ত্রী তো বটেই, হীরেন মুখার্জি ছাড়াও অনেক প্রগতিবাদীর এবং বৌদ্ধিক সমাজের শ্রদ্ধা বা দুর্বলতা (মূলত সিপিআই) মুক্তবুদ্ধির যুক্তিবাদী মানুষ সঙ্গত মনে করেন না। ‘তবুও মনে রেখো’ কি সবার বেলায় খাটে? এর বড় কারণ- নেহরুর রোমান্টিক আবেগ প্রবণতা ও দুর্বল ব্যক্তিত্ব, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখানে ঘাটতি থাকলেও মানুষ নেহরুকে অনেকেই শ্রদ্ধেয় মনে করেন। সম্প্রদায়বাদী প্যাটেল কি ‘বেটার অপশন’ ছিল? আমার তা মনে হয় না। আসলে সমস্যা যোগ্য নেতৃত্বের (একজন চৌ-এর) অভাব। নেহরুর পর নন্দ, শাস্ত্রী প্রমুখের, এমনকি কবি নরসীমা রাও- কেউ প্রয়োজনীয় যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। ব্যতিক্রম নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, যিনি জনপ্রিয়তার টানে প্রিয় দর্শিনীর সম্মান সূচক নামে ভূষিত। কিন্তু তার মধ্যেও ঘাটতি বা স্ববিরোধিতা ছিল। না হলে নিজ বুদ্ধিমত্তার বাইরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চতুর, কূট কুশলী মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কুপরামর্শে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন কেন। এই ঘটনা তার জনপ্রিয়তায় আঘাত হানে, যেজন্য বুদ্ধিমতী ইন্দিরা প্রকাশ্য সভায় জনতার কাছে মাফ চেয়ে নেন। তার রূপমুগ্ধ জনতা তাকে ক্ষমা করে দেয়।
সুযোগ্য নেতৃত্ব, সঠিক নীতি এবং দুর্নীতিমুক্ত শাসন ব্যবস্থার অভাবের চেয়েও ভারত শাসনে বড় সমস্যা ছিল কংগ্রেস দলে সততার অভাব এবং দুর্নীতিবাজ বৃহৎ ব্যবসায়ীকুলের প্রাধান্য। এক কথায় ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সাংগঠনিক প্রাচীন বটবৃক্ষটি (১৮৮৫) সময়ের দান অবক্ষয়েই জীর্ণ নয়, এর গায়ে দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কীটদষ্ট ক্ষতের বাহুল্য। এর মধ্যে দু-চারজন সৎ মানুষ কী করতে পারে।
স্বভাবতই সেকুলার সংবিধানের ভারতের উত্থান ঘটে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির- দুই আসন থেকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং তা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাই দৃশ্যমান। এ পরিণতি কি কাম্য ছিল নেহরু যুগের সীমিত গণতন্ত্রের মধ্যেও, কিংবা প্রিয় দর্শিনীর শাসনামলে?
কিন্তু সময় থাকতে সাবধান হওয়া ও ব্যবস্থা না গ্রহণের ফলে এই অবাঞ্ছিত পরিণাম, যা পাশ্চাত্য মহলেরও কাম্য নয়। তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের যা কিছু মান-মর্যাদা, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রতিফলিত নয়। এমনকি বিজেপির শাসনামলেও নয়। এ সময়ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, তবে ততটা জোরেশোরে নয়।

পাঁচ.
আমাদের প্রশ্ন, হিন্দুত্ববাদী ভারত কি পশ্চিমা তথা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য? শুরুতে তো তারা এর বিরোধিতাই করেছে। কিন্তু পরে সামলে নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের প্রধান শক্তি ভারতকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। কিন্তু স্বচ্ছ মনে নয়। গণতন্ত্রী ভারতের এই হিন্দুত্ববাদী তথা সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন কোনো গণতান্ত্রিক কাম্য হতে পারে না, প্রগতিবাদী বা সমাজতন্ত্রীদের তো নয়ই।
তুলনায় পাকিস্তানের অবস্থা আরো খারাপ, যা এর আগে বলা হয়েছে। পাকিস্তান সমরতন্ত্র প্রভাবিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র হয়েও সামাজিক-রাজনৈতিক সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যা ও চরম নৈরাজ্যের শিকার। ক্রিকেট-লিজেন্ড ইমরান খানের সাধ্য কি তা নিয়ন্ত্রণে আনে। তার নিজের ব্যক্তি জীবনই তো দুই ধারার টানে (রক্ষণশীলতা ও আধুনিকতা) ফালাফালা। সেটাই অনিয়ন্ত্রিত। তিনি কীভাবে একটি দেশের অরাজকতা সামাল দেবেন। তাই ক্ষমতা থেকে তার বিদায় এবং সংসদীয় রাজনীতির শাহবাজ শরিফ হাজির কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবে কিনা সে বিষয়ে বোদ্ধামহলে গভীর সন্দেহ।
আগেই বলেছি এশিয়ার অঞ্চল বিভাগ সত্ত্বেও চীনের সার্বিক প্রাধান্য। তার প্রাণপণ সাধনা অস্ত্রে নয়, অর্থনৈতিক শক্তি বিচারে এক নম্বর স্থানটি দখল। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেখানে চীনা স্বার্থ প্রবল, সেখানে তার সক্রিয় উপস্থিতি। আর সে কারণেই বিপর্যস্ত সিরিয়াকে বাঁচাতে পুতিনের সশস্ত্র উপস্থিতি সত্ত্বেও চীন নৈতিক সমর্থন জানিয়েই নীরব। চীনের এ জাতীয় ভূমিকা একাধিক উপদ্রুত দেশের ক্ষেত্রে সত্য। আদর্শ-টাদর্শ বিবেচ্য বিষয় নয়, ‘আপনা স্বার্থ জগন্নাথ।’
রাজনীতির এই সংকটময় পরিস্থিতিতে চীন-ভারত প্রশ্নে কী হবে বাংলাদেশের ভূমিকা। সে কোন দিক রক্ষা করে চলবে? বিষয়টি অত্যন্ত জটিল নানা রাজনৈতিক ইস্যুর দ্ব›েদ্ব জটিল। চীনকে অসন্তুষ্ট করে সে যেমন গলার কাঁটা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে পারবে না, প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারতের সঙ্গে তার নানা মাত্রিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে আছে।
এ জটিল সমস্যার সমাধান নির্ভর করছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ভূমিকার ওপর। এছাড়া বর্তমান অবস্থায় অন্য কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। তবে প্রসঙ্গত আরো একটি কথা মনে এলো, বাংলাদেশের কূটনীতি কি ভারত-চীন সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে? হোক না বাংলাদেশ ছোট একটি রাষ্ট্র।
এ বিষয়টি নির্ভর করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতি কতটা পরিণত, কতটা প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ তার ওপর। পাকিস্তান আমলে দেখেছি শফিউল আজম, এ কে এম আহসান প্রমুখ মেধাবী উচ্চ পদস্থ আমলাদের, যারা পাকিস্তানি স্মার্ট আমলাদের চেয়ে কম চৌকশ ছিলেন না। এমনকি বর্ষ-ব্যাচের মেধাবী গোলাম রাব্বানি কিংবা তুখোড় কাজী ফজলুর রহমান বা কূটনীতিক সৈয়দ মোয়াজ্জম আলীরা কম দক্ষ ছিলেন না। তাহলে একালের মেধাবী অনুরূপ পদস্থরা পূর্বসূরিদের ভূমিকা যথার্থভাবে পারন করতে পারবেন না কেন? বরং বর্তমান প্রজন্ম তো সংলাপের স্মার্টনেসে এক পা এগিয়ে। সমাধানটা নির্ভর করে যোগ্য ব্যক্তি বাছাই এবং যথা স্থানে ব্যবহারের ওপর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়