করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্তের যুক্তিবাদী ভূমিকা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুক্তচিন্তার যুক্তিবাদী মানুষ ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্ত সারা জীবন ধরে সত্য ইতিহাসের সন্ধানে ইতিহাসের অলিগলি খুঁজে বেড়িয়েছেন! সত্য ইতিহাসকে সামনে তুলে ধরে ইতিহাসের বিকৃতি সংশোধনের মহান কর্তব্য সম্পাদন করে গেছেন মাথা উঁচু করে! তাঁর উল্লেখযোগ্য পুস্তকগুলি হলো-‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’, ‘প্রসঙ্গ : সাম্প্রদায়িকতা’ এবং ‘ভারতীয় মুসলমানদের সংকট’, ‘মৌলাবাদ ও সমকাল’, ‘রেনেসাঁস বিশ্বায়নের শুরু’! ব্রিটিশদের চরবৃত্তি করা দলের মানুষজন যখন দেশের শাসন ক্ষমতায় এবং সত্য ইতিহাসকে পাল্টে দেয়ার বিকৃত সাধনায় যারা অহরহ মত্ত! তখন আমাদের চিন্তা ও চেতনার জগতকে ক্ষুরধার করতে সুরজিৎ দাশগুপ্তের মতো অসাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষ মানুষের লেখা ইতিহাস পুস্তকগুলি পাঠ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে! ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ও অধিষ্ঠান, উপমহাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে তার সম্পৃক্তি গভীর অধ্যায়নের বিষয়! এ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কাজ করেছেন মুক্তমনের ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্ত! তাঁর ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ প্রথম প্রকাশের পরই আলোড়ন জাগিয়েছিল বিপুলভাবে! পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থের একাধিক সংস্করণ! ‘বইয়ের দেশ’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “আমি দার্জিলিংয়ে ইতিহাস নিয়ে চর্চা শুরু করি, ভারতে ইসলাম আসার ইতিহাস ও তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি! প্রথমে অধ্যাপক ক্ষিতিন্দ্র ঘোষালের ‘আলেখ্য’তে, পরে তার থেকেই লিখি ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’, সেই আমার মৌলবাদ সম্বন্ধে অন্বেষণের শুরু! সেই সূত্রে হয়তো নিমাইসাধন বসুর সুপারিশে আমার হুমবোল্ট ইউনিভার্সিটিতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নিয়ে সেমিনারে অংশ নেওয়া! অন্য যাঁরা বক্তা ছিলেন সকলেই ডক্টরেট ভূষিত! আমাকেও দেয়া হলো সাম্মানিক ডক্টরেট!” এই গ্রন্থের আলোচনাকালে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘ধর্মীয় রাজনীতির ছায়া সরে গেলে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক চন্দ্রগ্রহণ মুক্ত হবে! মুক্ত আলোয় আমরা আমাদের সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারব!’ সে দিক দিয়ে সুরজিৎ দাশগুপ্তের ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থ অশেষ তাৎপর্যময়! কারণ এই গ্রন্থ যেমন নতুন আলোকে ইতিহাস বিবেচনায় সহায়ক, তেমনি বর্তমান অন্ধকার সময়ে যখন সম্প্রীতির চেয়ে সংঘাত হয়ে উঠেছে মুখ্য, তখন ইতিহাসের নতুন আলোকে এই পুস্তক নিজেদের চিনতে ও জানতে সাহায্য করে!
‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থের লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত আরবভূমি থেকে ইসলামের ভারতভূমিতে আগমন এবং ভারতীয় জীবন, রাজনীতি ও লোকসমাজে স্থান করে নেয়ার বিষয়টি নির্মোহ ও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন! গ্রন্থের বিবেচ্য বিষয় কেবল ইতিহাসের অন্তর্গত নয়, গোটা উপমহাদেশের সমসাময়িক জীবনে এর রয়েছে বিপুল অভিঘাত! ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্ত ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থে ভারতবর্ষে মুসলিম আগমন এবং সমাজজীবনে তার প্রভাব ও কারণ বিষয়ে নতুন কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন। ভারতবর্ষে মুসলিমদের জনসংখ্যা তথ্যের একটি রিপোর্ট থেকে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘ব্যাপারটা বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে যে যখন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হাতে সত্যই অনেক শক্তি ছিল, তখন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় লঘু ছিল।’ মুসলিমরা যখন ভারতবর্ষে ক্ষমতায় ছিল, তখন মুসলিম জনগোষ্ঠীরই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভারতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে তখন, যখন মুসলিমরা ক্ষমতায় নেই। তিনি লক্ষ করেছেন, যখন বাংলার শহরাঞ্চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এক নতুন উত্থান ও জাগরণের চেতনায় গৌরবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল, সেই ঘটনার কালেই গ্রামাঞ্চলে বাঙালি মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার গৌরব অর্জন করে। ‘বলপ্রয়োগে’ ইসলাম প্রচারের তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘প্রথমেই আসে বলপ্রয়োগে ধর্ম প্রচারের তাৎপর্য। হৃদয়ঙ্গমের প্রশ্ন। যদি অস্ত্রের সাহায্যেই বা বলপ্রয়োগেই ইসলাম ধর্ম প্রচার হয়ে থাকে, তাহলে মুসলিম শক্তির প্রধান কেন্দ্র থেকে এত দূরে বাংলায়ই ইসলাম ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করল কী করে? বলপ্রয়োগে ধর্ম প্রচারের তত্ত্ব সত্য হলে মুসলিম শক্তির প্রধান কেন্দ্র দিল্লির সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে ইসলামের অধিকতর প্রতিষ্ঠা হওয়াই উচিত ছিল নাকি? বাংলার ক্ষেত্রে গৌড় ও ঢাকার শহরাঞ্চলেই ইসলামের জনপ্রিয় হওয়ার কথা নয় কি? কিন্তু কার্যত তা হয়নি!’
দীর্ঘকাল মুসলমান শাসনে ভারতে হিন্দু ধর্মও ধ্বংস হয়নি, হিন্দু জাতিও ধ্বংস হয়নি। কিন্তু প্রচলিত ইতিহাসে যা ঘটানো হয়েছে তা ঘটনা নয় রটনা, ইতিহাস নয় বরং বিকৃত ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন ‘দীর্ঘকাল মুসলিম শাসনের অধীনে থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অধিকাংশ অধিবাসী, এমনকি মুসলমান শক্তির প্রধান কেন্দ্রগুলোর অধিবাসীও হিন্দু থেকে যায়, কিন্তু ইউরোপে পেগান ধর্মের বিরুদ্ধে এমন সর্বব্যাপী অভিযান চালানো হয় যে পেগান ধর্মাবলম্বী ইউরোপিয়ানদের চিহ্নমাত্র রাখা হয় নি। মুসলমানরা যদি সত্যিই এক হাতে অস্ত্র নিয়ে ধর্ম প্রচারের অভিযানে নামতো তাহলে ইউরোপের মতো ভারতবর্ষেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চিহ্নমাত্র থাকত না!’
স্বামী বিবেকানন্দও তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ বইতে লিখেছেন ‘দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায় আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সে-সব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান!’
ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল সুফী-আউলিয়াদের ভূমিকা, যা বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ‘প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রচার এসব সাধু-সন্ত পীর-ফকীরদের মাধ্যমেই হয়েছে, অর্থাৎ আমীর-ওমরাহ রাজা-বাদশাহের চাইতে ধার্মিক মুসলিমরাই ইসলামের ব্যাপক প্রচার অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন!’
‘মামলুকদের শাসনকাল ত্রয়োদশ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই মুসলিম সাধকরা ভারতবর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কশূন্য জনসাধারণের জীবনে উপনীত হয়েছিলেন এবং তার ফলে ভারতীয় জনসাধারণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলামকে গ্রহণ করেছিল নিতান্তই আধ্যাত্মিক আকর্ষণে!’
কেরলের মালাবার উপকূলে আরব বণিকদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের বিস্তার প্রসঙ্গে লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর পুস্তকে লিখেছেন ‘আমরা দেখেছি যে মালাবার উপকূলে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির আগে থেকেই আরব বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল, বাণিজ্যের সমৃব্ধির জন্য শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা তারা বিশেষ জরুরি মনে করত এবং দেশের ভারতীয় শাসকদের এ ব্যাপারে সাহায্য করত। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আরব বণিকদের অসদ্ভাবের কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। এর থেকে ধরে নেয়া যায় যে নিতান্ত বাস্তব কারণেই উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল। পরে এই আরবরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তখন থেকে তারা পরিচিত হয় মুসলমান বলে!’ স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে মুসলিমদের সঙ্গে স্থানীয় অন্য ধর্মের মানুষের সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল।
“আরব বণিকরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেই ইসলামকে কেরালায় নিয়ে আসে, কেরালাস্থিত তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে ইসলাম প্রচার করে তখন এ বণিকদের স্থানীয় কর্মচারীরাও, যাদের একটা বড় অংশ বণিকদের জন্য কায়িক শ্রম করত, ইসলামের আদর্শ ও বক্তব্য সম্বন্ধে জানতে পারে। তারা জানতে পারে এমন এক শাস্ত্রের কথা, যাতে বলা হয়েছে মানুষকে আলাদা আলাদা জাতিতে জন্ম দেয়া হয়েছে বটে কিন্তু জন্ম দিয়ে নয়, মানুষের বিচার হয় তার স্বভাব-চরিত্র দিয়ে। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত কেরলের জনসাধারণ ইসলাম ধর্মের মধ্যে মানুষ হিসাবে বাঁচার ডাক শুনতে পেল!” এটা স্পষ্ট যে বর্ণভেদ প্রথার ছোবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ইসলাম ধর্মকে বেছে নিয়েছিল।
“ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলোর চাপে কেরালার জনসাধারণ যখন মানুষ হিসাবে নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছে তখন ইসলাম ধর্মের আগমন ও আহ্বান। এই আহ্বানে তারা প্রচণ্ড সাড়া দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল। ‘তুহফাতুল মুজাহিদিন’ এর লেখক জৈনুদ্দিন লিখেছেন, ‘যদি কোন হিন্দু মুসলমান হতো তাহলে অন্যেরা তাকে এই (নিম্নবর্ণে জন্মের) কারণে ঘৃণা করত না, অন্য মুসলিমদের সঙ্গে যে রকম বন্ধুত্ব নিয়ে মিশত, তার সঙ্গেও সেই ভাবে মিশত!’ মানুষের মূল্য পাবে, সমাজে মানুষের মতো ব্যবহার পাবে এটা ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ!” নিপীড়িত মানুষকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল ইসলাম ধর্ম, যার কারণে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
“আগেই বলা হয়েছে যে নিম্নবর্ণের লোকেদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হতো। এককালে কেরালাতে অমুকের স্ত্রী বা মেয়ে ইসলাম নিয়েছে বলার দরকারই হতো না, তার বদলে শুধু ‘কুপপায়ামিডুক’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো কুপপায়ামিডুক শব্দটির অর্থ হলো ‘গায়ে জামা চড়িয়েছে’। অপমান-সূচক বা হীনতা-দ্যোতক এ রকম বহু আচার প্রথা ইসলামের প্রভাবে কেরালায় সমাজ থেকে দূরীভূত হয়। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের ফলে দাস প্রথাও বহুল পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত হয়!” মহিলাদের প্রকৃত সম্মান দিয়েছিল ইসলাম ধর্ম, যার কারণে মানুষ ইসলাম ধর্মকে আপন করে নেয়।
কেরল ও মালাবার অঞ্চলে বাণিজ্যিক কারণে মুসলমান জাতি সেখানে বসতি স্থাপন করে এবং তারা স্থানীয় অন্য জাতির মানুষের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে থাকে। এই মুসলিম জাতিকে ‘মোপলা’ বলা হয়। এই অঞ্চলের ব্যবসার চাবিকাঠি ছিল এই মোপলা মুসলিমদের হাতে। ইতিহাসে কোথাও কোথাও এদের মহাপিলাহ, মোইপিলাহ, মোপলাহ ইত্যাদিও নামে অভিহিত করা হয়েছে। মোপলা মুসলিমরা অত্যন্ত সাহসী, সৎ এবং কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন, তাই হিন্দু রাজারা তাদের সৈন্য হিসাবে বাহিনীতে রাখতেন। ব্যবসা ছাড়াও বিশ্বাসভাজন এবং সুদক্ষ সৈন্য হিসাবেও মোপলা মুসলিমরা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কালিকটের রাজবংশকে জামোরিন বলা হত এবং জামোরিন রাজবংশের শক্তির উৎস ছিল মোপলা মুসলিমরা। এছাড়া মালাবারের প্রত্যেক হিন্দুরাজা মোপলাদের সৈন্য, দেহরক্ষী অথবা পরামর্শদাতা হিসাবে রাখত এবং ছেলের মতো ভালোবাসত। মহাপিলাহ মানে বিখ্যাত পুত্র বা বড় ছেলে।ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন “তেমনই মালাবারের রাজারাও ইসলাম ধর্মাবলম্বী দুর্দান্ত জওয়ানদের পুষত এবং আপন আপন রাজ্যে তাদের বসবাসের সুবন্দোবস্ত কর দিত। বড় ছেলের মতো এদের খাতির করা হতো বলে এদের মইপিলাহ বা মহাপিলাহ বলা হতো!”
মোপলাদের চারিত্রিক গুণাবলি দেখে মালাবারের অনেক হিন্দু রাজা ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন ‘এখানকার কোন কোন রাজবংশ ইসলাম ধর্মের আদর্শে প্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং (তাঁরা) ইসলামের প্রচারে উদ্যোগী হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষের অন্য কোনখানের ইতিহাসে দেখা যায় না। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত নিম্নবর্ণের লোকেরা মানুষের মর্যাদা পাওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছে।’
‘বহু শতাব্দী ধরে এখানই চলে আসছে যে মালাবার রাজাদের মধ্যে চেরমান পেরুমলই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন! তিনি ছিলেন কেরলের পেরুমল বংশের শেষ রাজা! তাঁর অনুরোধে আরব থেকে মালিক ইবন দিনর কুড়িজন সহচর নিয়ে কেরলে আসেন ইসলাম সম্বন্ধে রাজাকে জ্ঞান দিতে! এতে বোঝা যায় ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান দেয়ার মতো জ্ঞানী আরব বণিকদের মধ্যে ছিল না অথবা আরব বণিকরা ব্যবসা বাণিজ্যের বাইরে অন্য কোনো ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না! শুধু নিজে ধর্মান্তরিত হয়ে চেরমান পেরুমল ক্ষান্ত হননি, প্রজাদের মধ্যেও ইসলাম প্রচারে তিনি সচেষ্ট হন!’ দক্ষিণ ভারতে মোপলা মুসলিমরা তাঁদের বীরত্ব ও চরিত্র মাধুর্য দিয়ে সমাজে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
“অনেকে মনে করেন, নবাব-সুলতানদের দরবারে ও দপ্তরে উচ্চ পদ পাওয়ার লোভেই জনসাধারণের একটা অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে দিল্লির সংলগ্ন অঞ্চলেই মুসলিমদের সংখ্যা বেশি হওয়া উচিত, কেননা সেখানেই উচ্চ পদের সংখ্যা ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সুতরাং উচ্চ পদের প্রলোভন ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ হতে পারে না!” এ প্রসঙ্গে সুরজিৎ দাশগুপ্ত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য এবং অভিমতও তুলে ধরেছেন! যেখানে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “অস্ত্রশক্তিতে যেভাবে ভারতীয়রা ধর্ম-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়েছে, প্রেমশক্তিকে (ইসলামের সাম্য ও ভালোবাসার শক্তি) সেভাবে প্রতিরোধ করতে পারেনি।” সুরজিৎ দাশগুপ্ত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থও উদ্ধৃত করেছেন! সেখানে রমেশচন্দ্র মজুমদার সিদ্ধান্ত টেনেছেন এই বলে যে-“উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন করত, তাই নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণের অত্যাচার থেকে অব্যাহতির আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।” সুরজিৎ দাশগুপ্ত অবশেষে নিজস্ব মন্তব্য প্রসঙ্গান্তরে উল্লেখ করে বলেছেন, “হিন্দু নেতারা নিজেদের ধর্মকে যতটা উদার ধর্ম বলে প্রচার করেন, হিন্দু ধর্ম যে সত্যই ততটা উদার নয়, এর উদারতা যে বহুলাংশে প্রচারসর্বস্ব, তার প্রমাণ নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের আচরণেই মেলে।-আপন সমাজকে সুসংহত করার জন্য হিন্দু নেতারা অনুশাসনাদিকে যতই সংকুচিত করতে থাকলেন ততই তাদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্যে একদল, যাদেরকে বলা হয় নির্যাতিত হিন্দু তারা আরো বেশি করে ইসলামের কাছে আশ্রয়প্রার্থী হলো!”
ব্রাহ্মণ্যশক্তি ভারতের বৌদ্ধদের প্রতি এত বেশি অত্যাচার করত তা ভাষায় অবর্ণনীয়। অত্যাচার যখন সহ্যসীমা অতিক্রম করে তখন বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধরা মাথা মুণ্ডন বা নেড়া করতেন, তাই বৌদ্ধদের বলা হতো ‘নেড়ে’। শুধুমাত্র বৌদ্ধরা নয়, ভারতের আরেক বিরাট জনজাতি জৈন সম্প্রদায়ও ভারতীয় হিন্দুদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন; তাদের মধ্যে অনেকে মুসলমান হয়ে নিস্তার পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গেও ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন ‘বাংলার বৌদ্ধদের মতো দক্ষিণ ভারতের জৈনরাও রক্ষণশীল শৈব হিন্দুদের হাতে নিপীড়িত হয় এবং একদিনে আট হাজার জৈনকে শূলে হত্যা করার কথা তামিল পুরাণেই উল্লিখিত হয়েছে। স্পষ্টতই এই সময়টাতে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম পরধর্ম সহিষ্ণুতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল।’
ব্রাহ্মণ্যবাদ এতোই চরম সীমায় পৌঁছেছিল যে ব্রাহ্মণ্যদের দ্বারা যেটাই ঘোষিত হতো সেটাই ঈশ্বরবাক্য বলে মেনে নিতে হতো সমাজকে। ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির এই প্রভাব প্রতিপত্তির সম্পর্কে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন ‘পরে সেন রাজাদের আমলে প্রচণ্ড আগ্রহে ও প্রচারের জন্য উৎসর্গিত প্রাণের উদ্দীপনায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে বাঙালি সমাজে মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের প্রভাব এত বেশি বেড়ে যায় যে তা অচিরে অত্যাচার হয়ে দাঁড়ায়।’ [ভারতবর্ষ ও ইসলাম পৃষ্ঠা ৯৮]
প্রাচীন বাংলায় মুসলিম আগমনের সময় নির্ধারণে সুরজিৎ দাশগুপ্ত মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন! আমাদের দেশের ইতিহাসবিদরা বাংলায় ইসলাম আগমনের বিষয়টি তুর্কি সমরনেতা বখতিয়ার খলজির আগমনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন।বাংলায় ইসলামের একেবারে প্রাথমিক যুগেই আরবরা এসেছিল। ‘পশ্চিমবঙ্গে যখন মুসলিম বিজয় হয়, সম্ভবত তার আগে থেকেই পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ মুসলিমদের সংস্পর্শে এসেছিল। আরব বণিকরা বা মূলত শেখ সম্প্রদায় যুদ্ধবিগ্রহ বা রাজ্য জয়ের চেয়ে বাণিজ্যিক তৎপরতায় অধিক আগ্রহী ছিল তারা যেমন আরব সাগরবর্তী বিভিন্ন ভারতীয় বন্দরে ও সিংহলে পত্তনি পেতেছিল, তেমনই বঙ্গোপসাগর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পথে চট্টগ্রাম বন্দরে ঘাঁটি গড়ে তোলে!’
‘আস্তে আস্তে হিন্দু বণিকদের কাছে আরব বণিকরা স্বীকৃতি পেল। সমাজপতিদের ভয়ে যারা ঘরের কোণে জীবন্মৃত অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করছিল, তাদের ওই আরবরা ডাকল সমুদ্রে; আশ্বাস দিল, সাহস দিল, জোগাল নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা, দিল নতুন ধর্মের আশ্রয়, দিল আত্মবিস্তার ও আত্মবিশ্বাসের অধিকার, সামাজিক স্বীকৃতি ও সক্ষমতার প্রতিশ্রæতি। যাদের রক্তে ছিল পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত সমুদ্রের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ, তারা পরম উৎসাহে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল কাতারে কাতারে!” আরব দেশ থেকে বণিক বা যারাই এ দেশে এসেছিলেন, তাঁরা মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের আগে ব্যবসা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসেছিল! মুহাম্মদ (সা.) যখন ইসলামের বার্তা নিয়ে এলেন, তখন আরবরা আর প্রধানভাবে ব্যবসা নয়, এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের কাজে।
‘প্রসঙ্গ : সাম্প্রদায়িকতা’ নামক পুস্তকে ‘বাংলাভাষীদের মধ্যে মুসলমান বেশি কেন’ অধ্যায়ে ইতিহাস গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, “আরব ভূগোল বিশারদদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে নবম শতাব্দীতে আরব বণিকরা সুদূর সমুদ্রতীরবর্তী ‘সমন্দর’ নামক এক বন্দরে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছিল! পণ্ডিতদের মতে সেই ‘সমন্দর’ পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে নামান্তরিত হয়! একথা মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে পাল রাজাদের আমলে আরব বণিকদের বাংলার বন্দরে পদার্পণ ঘটেছিল! পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর আরবরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী! পাল রাজাদের আমল শেষ হওয়ার প্রায় পাঁচশো বছর পরে দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দূত হিসেবে ইবন বতুতা চীন যাওয়ার পথে ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দের বর্ষা ঋতুতে বাংলার বন্দর চট্টগ্রামে আসেন! তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনীর নাম ‘রেহলা’! লক্ষণাবতী বা লখনৌতির সুলতান তখন আলাউদ্দিন আলী শাহ আর ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সোনারগাঁওয়ের সুলতান! ফকরুদ্দিন ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চট্টগ্রাম জয় করেন! এই তথ্য পাওয়া যায় প্রায় ৩০০ বছর পরে লেখা বাদশাহ আওরঙ্গজেবের অধীন কর্মচারী শিহাববুদ্দিন তালিশের বিবরণ থেকে! পক্ষান্তরে ইবন বতুতার ভ্রমণকাহিনীর থেকে জানা যায় যে ফকরুদ্দিন বা কোন মুসলমানের চট্টগ্রাম বিজয়ের আগেই ইবন বতুতা সেখানে মসজিদ ও বহু মুসলমান গোরস্তান দেখেছিলেন! গোরস্তান নির্মাণ যদি বা স্বল্প ব্যয়ে সম্ভব মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থবল ও লোকবল দুইই চাই! কোন স্থানে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান সমবেত না হলে সেখানে মসজিদ নির্মাণের প্রশ্ন উঠবে কেন? অর্থাৎ মুসলমান বিজয়ের আগেই চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মুসলমান আগমন হয়েছিল! কিভাবে হয়েছিল? যেভাবে খোদ ইবন বতুতা চট্টগ্রামে এসেছিলেন! অর্থাৎ জলপথে! জাহাজে বা চিনা জাঙ্কে চড়ে! সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমানরা যে ভারতে এসেছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণের জন্য কোনো ইতিহাস গ্রন্থের সাহায্য চাই না! কেরলের কোচিন শহর থেকে মাইল তিরিশেক দূরে অবস্থিত ক্যান্নানোরে গেলেই আজও দেখা যাবে ভারতের প্রাচীনতম মসজিদের জীর্ণ কাঠামো! হজরত মুহাম্মদের (সা) জীবদ্দশাতেই এই মসজিদটি মালাবার উপকূলে কারা নির্মাণ করেছিল? প্রচলিত ইতিহাস গ্রন্থাবলি আমাদের ভুল তথ্য দেয় যে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ কাশিমের নেতৃত্বে মুসলমানরা ভারতে প্রথম এসেছিল! মুসলমান ফৌজের আগেই মুসলমান বণিকরা ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্যান্নানোরে মসজিদ নির্মাণ করেছিল! শান্তি-সদভাবেই বাণিজ্যের বিস্তর হয়! শান্তিবাদী হিসেবেই ভারতবর্ষের মাটিতে মুসলমানরা আগমন করেছিল এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে নয়! শান্তিবাদী হিসেবেই বাংলার মাটিতে মুসলমানদের প্রথম পদার্পণ! সপ্তদশ মুসলমান অশ্বারোহীর সপ্তদশ মুসলমান অশ্বারোহীর বাংলা বিজয়ের গালগপ্প একদা ইতিহাস বলে গণ্য হত! কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্র তরঙ্গের সঙ্গে মুসলমানদের প্রথম প্রবেশের বহু সূত্রই কালের তরঙ্গে বিধৌত! একমাত্র ইঙ্গিত ‘শেখ শুভোদয়া’ নামক প্রাচীন পুঁথিখানি! রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভায় জনৈক শেখের উদয়ের কাহিনী তাতে পাওয়া যায়!
বাংলায় কিভাবে প্রথমে পশ্চিমাংশে এবং তারপর ক্রমশ পূর্বাংশে মুসলিম আধিপত্য প্রতিপন্ন হয়েছে তার যে কাহিনী স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইগুলোতে পাওয়া যায় সেগুলির যথার্থতা সম্বন্ধে কতকগুলি প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক! সপ্তদশ মুসলমান অশ্বারোহীর গৌঢ় জয়ের গল্প যেমন আজকাল ঐতিহাসিকরাই অবাস্তব বা মিথ্যে বলে বাতিল করেছেন, তেমনি আরো অনেক ভ্রান্ত চিন্তা বাংলার ইতিহাসে আত্মগোপন করে আছে! ধরে নিচ্ছি যে যোদ্ধা হিসেবে তুর্কি পাঠানরা বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সেই শ্রেষ্ঠতার বিপরীতে ছিল স্থানীয় অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং তার চেয়ে বড় কথা বাংলার নদীমাতৃক ভৌগোলিক প্রকৃতি! শশাঙ্ক ধর্মপালের সঙ্গে যারা একদা বহু যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তারা কিভাবে মুষ্টিমেয় মুসলমান ফৌজের কাছে পর্যদুস্ত হলো? এমনটি যে কখনো হয় না তা নয়! নজির হাতের নাগালে আছে! পলাশীতে মুষ্টিমেয় ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে নবাবের বিশাল বাহিনী কিভাবে হেরে গেল? নবাব বাহিনীর বৃহত্তর অংশ যুদ্ধ করেনি বলেই তো ক্লাইভ অত সহজে বিজয়ী হন! ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ও অনুরূপ ব্যাপার ঘটেছিল! ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্গীয়দের অত্যাচারের নিম্নবর্ণীয় ও নিম্নবর্গীয়দের মনের অবস্থা কি দাঁড়িয়ে ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় ধর্মমঙ্গল প্রভৃতি কাব্যে! বাংলার সাধারণ মানুষের এক উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলমানদের পরিত্রাতা হিসেবে দেখেছিল! শ্রীচৈতন্যদেবের আমলেও যে পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন হয়েছিল এমন মনে করার কারণ নেই! ব্রাহ্মণরাজ যে চৈতন্যকে হত্যা করার ও বহুবার চেষ্টা করেছিলেন এবং চৈতন্য যে ব্রাহ্মণদের ‘পাষণ্ড’ বলে উল্লেখ করতেন এ কথা সর্বজনবিদিত! অর্থাৎ স্থানীয় অধিবাসীদের এই অংশের নিষ্ক্রিয় সহযোগিতা মুসলমান ফৌজ পেয়েছিল, যে অংশ তাদের প্রতিরোধ করতে পারত! এই নিষ্ক্রিয় সহযোগীদের এক বিরাট অংশ পর্যায়ক্রমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের অন্তর্গত সহজ মানবিকতার টানে!
‘তরাইনের যুদ্ধে জয় থেকে মুসলমানদের গৌঢ় জয় করতে সময় লেগেছিল মাত্র দশ বছর! কিন্তু গৌঢ় থেকে চট্টগ্রাম জয় করতে প্রায় দেড়শ বছর লাগলো! দেখা যাচ্ছে, যে গতিতে মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গ জয় করে, সেই গতিতে পূর্ববঙ্গ জয় করতে পারেনি! পূর্ববঙ্গের নদী-নালার জটাজাল এক ধরনের নৈসর্গিক প্রতিরোধ দিয়েছিল মরুভূমি ও পাহাড়ের দেশ থেকে আগত বিজেতাদের! এখানে প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক প্রসঙ্গটি বিশেষ বিবেচ্য! বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো যে, ফখরুদ্দিনের চট্টগ্রাম বিজয়ের ৬০০ বছর পরে দেখা গেল চট্টগ্রামের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী! শুধু চট্টগ্রামে নয় বাখরগঞ্জ, বরিশাল, নোয়াখালী প্রভৃতি সমুদ্রবর্তী পূর্ববঙ্গের সমস্ত অঞ্চলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে! তাছাড়া শ্রীহট্ট, ঢাকা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে যে মুসলমানরাও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়, তা ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনাতে দেখা যায়! আধুনিক প্রথায় ভারতবর্ষে জনগণনা শুরু হয় ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে! জনগণনার হিসাবগুলো থেকে দেখা যায়, যে কলকাতাকে ভিত্তি করে হিন্দু ধর্ম যখন পৃথিবীর দেশে দেশে জয়যাত্রা করে বেড়াচ্ছে তখন- সেই হিন্দু ধর্মের বিশ্বজয়ের সমান্তরালেই গ্রামবাংলা জয় করে নিচ্ছিল ইসলাম ধর্ম এবং ১৮৯১ সালে বাংলায় মুসলমানদের প্রান্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ১৯১১ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পর্যবসিত! মুসলমান বিজয়ের বা মুসলমান শাসনের যুগে নয়, হিন্দুর বিশ্বজয়ের তথা ব্রিটিশ শাসনের যুগেই বাংলার জনবিন্যাসের চক্র সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে আবর্তিত হয়!’
নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায় ইসলাম ধর্ম বাংলা তথা ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ এসেছিল, অভিশাপ হিসাবে নয়, তা সুরজিৎ দাশগুপ্ত স্পষ্ট করে বলেছেন- ‘সামগ্রিক বিচারে মানতে হবে যে, ইসলাম স্বাতন্ত্র্যে গৌরবান্বিত বাংলার জনসাধারণকে অজ্ঞাতপূর্ব মুক্তির স্বাদ দিল। বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণির তথা শ্রমজীবী জনসাধারণকে দিল ব্রাহ্মণ্য নির্যাতন ও কঠোর অনুশাসনাদির থেকে মুক্তি, প্রতি পদে সামাজিক অপমানের থেকে মুক্তি, পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গের সমুদ্রস্পৃহ জনসাধারণকে দিল ভৌগোলিক বিধিনিষেধের বন্দিদশা থেকে মুক্তি, বহু আয়াসসাধ্য সংস্কৃত ভাষার বন্ধন কেটে জনসাধারণকে দিল মাতৃভাষাতে আত্মপ্রকাশের অধিকার!’
ইসলাম বাংলায় প্রবেশ করার পর ইসলাম থেকে বাংলার মানুষ মানুষের প্রাপ্তি সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্তের মূল্যায়ন : ‘১. ইসলাম স্বাতন্ত্র্যে গৌরবান্বিত বাংলার জনসাধারণকে অজ্ঞাতপূর্ব মুক্তির স্বাদ দিল। ২. বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণির তথা শ্রমজীবী জনসাধারণকে দিল ব্রাহ্মণ্য নির্যাতন ও কঠোর অনুশাসনাদি থেকে মুক্তি। ৩. প্রতি পদে সামাজিক অপমান থেকে মুক্তি। ৪. পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গের সমুদ্রস্পৃহ জনসাধারণকে দিল ভৌগোলিক বিধিনিষেধের বন্দিদশা থকে মুক্তি। ৫. বহু আয়াসসাধ্য সংস্কৃত ভাষার বন্ধন কেটে জনসাধারণকে দিল মাতৃভাষায় আত্মপ্রকাশের অধিকার। ৬. সাহিত্যের বাহনের মতোই প্রসঙ্গ বা বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও দিল ধর্মীয় বন্ধন থেকে মানবিক প্রসঙ্গে মুক্তি। ৭. বাংলার বহু সাধনাত্মক ইতিহাসকে ইসলাম যে ধ্রæবপদে বেঁধে দিল তার নাম স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা!’
প্রকৃতপক্ষে বাংলায় মুসলিম নাম বিশিষ্ট কোনো শাসকের সাম্রাজ্য বিস্তারের আগেই এ দেশে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় ইসলাম নিজস্ব মর্যাদায় সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটি মুহাম্মদ সা.-এর জীবদ্দশা থেকে শুরু হয়ে বারো শতক পর্যন্ত তুর্কিদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত কোনোরূপ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সমাজ-মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও গ্রহণীয় হয়ে ওঠে।
‘ভারতের বাঙালি মুসলমান’ নামক প্রবন্ধে সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে বিস্তর বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছে। এসব বৃত্তান্তে যাঁদের কথা পড়ি তাদের ধর্মীয় পরিচয় খুঁজলে দেখব তারা সকলেই হয় হিন্দু, নয় ব্রাহ্মণ, নয় খ্রিস্টান। এটা লক্ষণীয় যে যখন স্বামী বিবেকান্দের অভিযানে হিন্দু ধর্ম আমেরিকা ইউরোপ জয় করে বেড়াচ্ছে তখনই ইসলাম ধর্ম নীরবে গ্রাম বাংলা জয় করে নিয়েছে। তাই বিংশ শতাব্দীর প্রথম জনগণনাতেই দেখা গেল বাংলায় মুসলমানের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তারপর বিহার-ওড়িশা বাংলা থেকে বাদ দেয়ার ফলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল বাঙালি মুসলমান। অথচ বাংলার রেনেসাঁসের লিখিত ইতিহাসে এই বাঙালি মুসলমান একেবারে গরহাজির। তাই কোনো ঐতিহাসিক ইউরোপীয় রেনেসাঁসের তুলনায় বাংলার রেনেসাঁসকে মুষ্টিমেয় হিন্দু ভদ্রলোকের কাণ্ড বলে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। এই ঐতিহাসিকরা খোঁজ করে দেখেননি ইউরোপের মহান রেনেসাঁ আসলে ছিল শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান মুষ্টিমেয় ধনী বণিক পরিবারের পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তুলনায় বাংলার রেনেসাঁ কত বিস্তৃত ছিল বাস্তবে। যেমন বাংলায় নারীর অধিকার ও আত্মপ্রকাশের যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল তার তুলনা অন্যত্র পাই না, এমনকি শহর কলকাতা থেকে অনেক দূরে কুমিল্লায় সেই ১৮৭৩ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নামে ৩৯ বছর বয়স্ক এক জমিদার-কন্যা দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ১৯১৫ সালে তিনি পশ্চিমগাঁও গ্রামে এমন একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যা ইংরেজি শিক্ষাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে ও পরবর্তীকালে উন্নীত হয় ডিগ্রি কলেজে। নারীশিক্ষার জন্য তার ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া তাকে নবাব খেতাব দিয়েছিলেন। বাংলার রেনেসাঁর ইতিহাসে কেন তার নাম থাকবে না? কিংবা খুজিস্তা আখতার বানুর (যিনি ১৯০৯-এ সুহরাবর্দিয়া বেগম মুসলিম গার্লস স্কুলে মুসলিম তামাদ্দুনের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন) অথবা রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের নাম কেন নেই? বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা জবাব দেবেন কি? শিক্ষাই ছিল বাংলার রেনেসাঁর মূল কারণ। শিক্ষা ব্যাপারটা যে কত জরুরি তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরুর পর্বেই যিনি বুঝেছিলেন তিনি হাজী মুহম্মদ মহসিন। শিক্ষার জন্য তিনি সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অগেই মহসিন তহবিল গড়েছিলেন যার পরিচালনের জন্য ট্রাস্টের সদস্যদের মৃত্যুর পর সেই তহবিল চলে যায় সরকার বাহাদুরের হাতে। ঠিক কথা যে-শিক্ষার জন্য তিনি ওই তহবিল গড়েছিলেন তা আধুনিক শিক্ষা নয়! আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে আধুনিক শিক্ষার আলো ভারতের কোনো খানেই ফোটেনি। তবে শিক্ষা শিক্ষাই। চলতি শিক্ষা থেকেই জাগে নতুন শিক্ষার জন্য আগ্রহ। রামমোহন তো ফারসি শেখার জন্য পাটনা সাহেবে গিয়েছিলেন! ফারসির সঙ্গে তিনি আরবিও শিখলেন! তারপর বারানসীতে গিয়ে শিখলেন সংস্কৃত! ডিগবির কাছে চাকরি করতে করতে শিখে ফেললেন ইংরেজিও! অবশেষে আধুনিক শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলেন! কিন্তু তার রূপায়নে হিন্দু রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে বাধা পেয়ে তিনি নিজেই সরে আসেন প্রকল্পটি থেকে। কিন্তু আধুনিক তথা ইংরেজি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই হিন্দু কলেজে মুসলমানদের প্রবেশধিকার ছিল না। যখন ১৮৩৮ সালে ফারসির বদলে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা করা হল তখন অনিবার্যভাবেই হিন্দু কলেজে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের সামনে যেমন খুলে গেল সৌভাগ্যের দরজা তেমনই ইংরেজি শিক্ষাহীন মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল। অতঃপর মুসলমান সমাজের মধ্যেই জাগল আধুনিক শিক্ষার জন্য আগ্রহ। নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলি, মৌলানা ওবায়েদুল্লাহ সুহরাবর্দী, নবাব খাজা আবদুল গনি প্রমুখ মফস্বল বাংলায় এমন বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যেগুলির শিক্ষাক্রমের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাও ছিল। সৈয়দ আমির আলি তো মাদ্রাসা শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আধুনিক শিক্ষার একজন প্রধান বক্তা ছিলেন। তবে এঁদের শিক্ষা প্রসারের মূল ক্ষেত্র ছিল কলকাতা শহরের বাইরে বিস্তৃত মফস্বল বাংলা। এখানে একটা ব্যাপার বোঝা প্রয়োজন। গ্রামবাংলা মানে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা কৃষিজীবী। তারা আধুনিক শিক্ষা অর্জন করে কি হাতের কাজ ছেড়ে শহরে গিয়ে খাতার কাজ খুঁজবে? এখানে গ্রাম ও শহরের পার্থক্যের প্রশ্ন এসে যায়। ব্যাপার এই রকমই দাঁড়ায় যে, বাসস্থানের ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, জীবিকার ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রেই বিভেদ দেখা যায়। শহরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে দেখা যায় ইংরেজিতে অশিক্ষিত মুসলমান কৃষকের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং তাদের শোষণ করার মানসিকতা। অনেক সমাবিজ্ঞানী বলেন যে, ইংরেজরা মুসলমানের হুকুমত কেড়ে নিয়েছে বলে তাদের ভাষা মুসলমানরা শিখতে চায়নি। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে ইংরেজি শিক্ষা তাদের কৃষিভিত্তিক জীবিকার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হবে বলেই গ্রামের কৃষিজীবী মুসলমান ইংরেজি শেখার তাগিদ বোধ করেনি।
‘ভারতীয় মুসলমানদের সংকট’ পুস্তকের ভূমিকায় সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘আজকের পাঠকের কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে একদা মুসলমানরা বিখ্যাত ছিল উদারতা ও সহিষ্ণুতার জন্য! মহান ইতালীয় রেনেসাঁসের ধ্রæপদী ঐতিহাসিক তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডের ‘ধর্ম ও রেনেসাঁসের আত্মা’ শীর্ষক অংশে মুসলমানদের উদারতা সহিষ্ণুতা ও মানবিকতা কীভাবে রেনেসাঁস কে অনুপ্রাণিত করেছিল তার কথা লিখেছেন! ইউরোপীয় ইতিহাসের অন্যতম প্রধান প্রণেতা ফিশার তাঁর মহাগ্রন্থের প্রথম ভাগে ইসলাম প্রসঙ্গে ১২শ অধ্যায়ে এবং পুনরায় মধ্যযুগীয় স্পেন প্রসঙ্গে ৩১শ অধ্যায়ে আরব মুসলিমদের উদারতা ও পরমত গ্রহণ শীলতা ও সভ্যতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন! এই সব গ্রন্থ লেখা হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে! সেকালে খুব কম মনীষী ভেবেছিলেন যে এমন দিন আসবে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমাবর্ষণ করে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার নিদর্শন গুলি ধ্বংস করবে অথবা আফগানিস্তানের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করবে! ধর্মীয় মৌলবাদের উদ্ভব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে! মার্কিন মুলুকে মৌলবাদের উদ্ভবের সমকালেই ভারতেও আর্যধর্ম চেতনার প্রচ্ছদে গুজরাটি পাঞ্জাবি মারাঠি সমাজে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম! আমি ‘আধুনিকতার আরেক রূপ হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ নামক প্রবন্ধে যা বলেছি তা সংক্ষেপে এই যে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই হচ্ছে মৌলবাদ! যা আপাতদৃষ্টিতে অতীতের অভিমুখী হলেও আসলে ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থারই পরিণাম! অধুনাতন সংগঠনে সংগঠনে প্রতিযোগিতায় মত্ত, ধার্মিকতার আড়ম্বরে উৎসবে আপ্লুত, পার্থিব ও সাফল্যের নেশায় উত্তেজিত, ভোগবাদে নিমজ্জিত, সামরিকতায় দর্পিত, নিজে গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে অন্ধসমাজ সর্বপ্রকার প্রতিযোগী, সুবিধার অংশীদার, ভিন্নমতাবলম্বীর ও স্বতন্ত্র সত্তার নির্মূলীকরণে উদ্যত এবং এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কাছে দারিদ্র্য নিবারণ, সমস্ত মানুষের বিকাশ ও সাম্য, স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে অহিংসা, শান্তি ও সম্প্রীতি, প্রাতিস্বিক মর্যাদা, স্বতন্ত্রতা ও সৃষ্টিশীলতা অর্থহীন! স্বভাবতই এই পরিবেশে সংখ্যায় লঘু, বৃত্তে লঘু, পেশিতে লঘু পরিশীলিত বুদ্ধিজীবী যুক্তিবাদী নির্বিরোধ শান্তিপ্রিয় কোনো মানুষই নিরাপদ নয়!-অপরাধী, অপরাধের সহযোগী ও অপরাধের মানসিক সমর্থক এবং হত্যায় হিংস্রতায় বিশ্বাসী এক বিশাল ভারতীয় সমাজ গড়ে উঠেছে! এই পরিস্থিতিতে সংকট শুধু ভারতীয় মুসলমানদের নয়, সংকট সমস্ত ধর্মের দুর্বলদের, সমস্ত ধর্মের মননশীল ও মানবিকতাবাদী, যুক্তিবাদী, শান্তিবাদী, সম্প্রীতিতে ও সত্যাগ্রহী মানুষের! এমনকি অপরাধীদেরও সংকট! কারণ অপরাধীদের কাছে কোনো রকম প্রতিদ্ব›দ্বী বা সমকক্ষ অসহ্য! এই হিংস্র বাতাবরণে নিরপরাধ ও অপরাধী প্রত্যেক নাগরিক বিপন্ন! অপরাধীরা অর্থ ও অস্ত্রের আত্মরক্ষায় সমর্থ, পক্ষান্তরে নিরস্ত্র ও অধিকাংশই নির্ধন এবং প্রেম ও বিশ্বাস, সত্য ও সাহসই তার সম্বল! এটা সর্বজন বিদিত যে সমস্ত উত্তেজনার শেষে ক্লান্তি অনিবার্য! বিশেষত উত্তেজনা করে যদি প্রত্যাশিত সুফল না আসে! তাতে যদি দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়! সাধারণ জীবন বিপর্যস্ত হয়! প্রশাসন ও সরকার অবান্তর প্রতিপন্ন হয় এবং তাতে যদি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিপোষক রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্ব জনমত তথা সভ্যজগতের হয়! সুতরাং আমাদের কর্তব্য এখন অহিংসা শান্তি সম্প্রীতি ও সৎ ভাবে বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখা অন্ধ রাত্রির ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে প্রাণের কম্পিত আলোক শিখাটিকে রক্ষা করা! সুরজিৎ দাশগুপ্ত এ দেশের বিরল এক ইতিহাসবিদ, যিনি ইতিহাসের ঘটনাগুলো নির্মোহ ও নিরাবেগ এক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ পুস্তকের শেষ সংস্করণের ভূমিকায় লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত আশা প্রকাশ করেছেন, “হিংসা ও প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র অবিরাম আবর্তিত হচ্ছে! মরছে নিরপরাধ, নির্দোষ ও নিরীহ মানুষ! রাষ্ট্রীয় নেতাদের, কি ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে প্রতিকারের আশা নেই! সাধারণ মানুষকেই ভাবতে হবে কি করে তারা ও তাদের সন্তান-সন্ততি বাঁচবে! তার জন্য বিদ্বেষ ও হিংসা পরিহার করে তাদের অতীতকে অনুধাবন করতে হবে! বর্তমানকে পরিবর্তন করতে হবে এবং ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে হবে!”
মুক্তমনের উদারচেতা যুক্তিবাদী ইতিহাসবিদ হিসেবে সুরজিৎ দাশগুপ্ত সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে হেঁটে সত্য ইতিহাসের সন্ধানে ইতিহাসের বিকৃতি সংশোধন করতে লেখনীর মাধ্যমে লড়াই করেছেন! মানবতাবাদী এই মানুষটি ইতিহাসের বিকৃতিই আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অন্যতম অন্তরায় বলে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে দেশের মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন! কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর সেই আন্তরিক ও মানবিক আহ্বান দেশের তথাকথিত শিক্ষিত পণ্ডিত মানুষজনের চিন্তা ও চেতনার জগতে এখনও সেভাবে পৌঁছায়নি!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়