সোনারগাঁওয়ে বিদেশি পিস্তল ও ইয়াবাসহ ডাকাত গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

যেভাবে খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : প্রতিদিন চারটি করে ক্লাস > নতুন কারিকুলাম > সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন > প্রাথমিকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দুই সপ্তাহ পর

পরের সংবাদ

প্রাণীদের খাবারেও সিন্ডিকেট : মিরপুর চিড়িয়াখানায় তিন দশক ধরে ওরা ৯ জন, চাপে কমল গরুর মাংসের দাম

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কামরুজ্জামান খান : রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের খাবার সরবরাহে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দরপত্রে সব ধরনের খাবার টাটকা ও পরিচ্ছন্ন দেয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদাররা অনেক সময় সরবরাহ করছেন মজুত করা খাবার। গুণগত মানের ব্যাপারে দরপত্রে উল্লেখ থাকলেও হচ্ছে হেরফের। মাছ, মুরগি, মেটেসাপ, খরগোশ ও গরুর মাংস সরবরাহে ব্যত্যয় ঘটছে শর্তের। শুকনো খাবার, শাকসবজি ও ফল সরবরাহেও হচ্ছে নয়ছয়। নির্দিষ্ট ঠিকাদার সিন্ডিকেটের বিকল্প লোক না থাকায় শর্তে উল্লিখিত খাবার সরবরাহ ও পরিবেশনে মান রক্ষা হচ্ছে না। এমনকি প্রতিদিন সঠিক সময়ে খাবার না দেয়ায় বেকায়দায় পড়ছেন সংশ্লিষ্ট স্টাফরা। সব ধরনের প্রাণীর খাবার সরবরাহের কাজ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আছে ৯ জনের কব্জায়। নিয়মিত ৫৭ ধরনের খাবার সরবরাহ করে থাকেন চিড়িয়াখানার পাশের নবাবের বাগ ও গড়ান চটবাড়ীর এই ৯ জন। মূলত সিন্ডিকেট করে তারাই একেক বছর একেকজন একেক ধরনের খাবার সরবরাহ করে আসছেন। বিমল চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তি এই সিন্ডিকেটের নাটেরগুরু হিসেবে পরিচিত। অবশ্য বিমলের দাবি, কেউ আগ্রহী না হওয়ায় তারাই যুগ যুগ ধরে প্রাণীদের খাবার সরবরাহ করে আসছেন! তাদের জমিতেই চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আবদুল লতিফ ভোরের কাগজকে বলেন, এক বছর আগে যোগ দেয়ার পরই খাবার সরবরাহ সিন্ডিকেটের খবরদারি তার নজরে আসে। এরপর দরপত্র আহ্বানে ঠিকাদারদের অংশ নেয়া বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হয়। এবার গরুর মাংসের দর কমানো হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, র‌্যাব-পুলিশের কড়া প্রহরায় দরপত্র দাখিল হওয়ায় গেট ও ফল ইজারার দর অনেক বেড়েছে। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী যেদিন চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করেন সেদিন ঠিকাদাররা

খাবার সরবরাহে বিলম্ব করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ৩০ শতাংশ সিন্ডিকেট ভাঙা গেছে। দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট অল্প সময়ে ভাঙা সম্ভব নয় উল্লেখ করে মো. আবদুল লতিফ বলেন, এখানে রাজনৈতিক ও বিভিন্ন প্রভাব জড়িত থাকলেও সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে এবার হরিণ ও ময়ূর বিক্রি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত প্রাণীপুষ্টি কর্মকর্তা এম এ জলিল জানান, প্রাণীর খাবার সরবরাহে প্রতি বছর চিড়িয়াখানার পরিচালকের কার্যালয় থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার, খাবার সরবরাহে এক বছরের অভিজ্ঞতা, ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা থাকাসহ বেশ কিছু শর্ত মানতে হয়। সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শর্ত মেনে যারা যোগ্য তারাই এ কাজ করেন। সবাই এ কাজ করতে পারেন না জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে কোনো প্রাণীর খাদ্য ঘাটতি বা সংকট নেই। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে সব প্রাণীর খাঁচায় খাবার সরবরাহ করা হয়।
প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন আসে দাবি করে তিনি বলেন, যে প্রাণীর জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই সরবরাহ করা হয়। এর সবই সুষম খাবার। সপ্তাহে ৬ দিন প্রতিদিন প্রতিটি বাঘ ৮-৯ কেজি ও সিংহ ৯-১২ কেজি গরুর মাংস খায়। আর একদিন বাঘ ও সিংহ জীবন্ত মুরগি খায়। কুমির সপ্তাহে দুই দিন গরুর মাংস খায়। এছাড়া হায়েনা, মেছো বিড়াল, শকুন, বাজপাখি, চিল ও কুড়া গরুর মাংস খায়।
চিড়িয়াখানার তথ্য কর্মকর্তা অলিউর রহমান জানান, চিড়িয়াখানায় প্রাণীর খাবার সরবরাহ করতে নির্ধারিত শর্ত মেনে দরপত্রে অংশ নিতে হয়। এজন্য মূল্যায়ন বোর্ড রয়েছে, অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি হাসপাতালে জনবল সংকট তীব্র। এর একমাত্র চিকিৎসক ভেটেরিনারি সার্জন নাজমুল হুদা অবশ্য বলেছেন, প্রাণীর খাবার নিয়ে কোনো সমস্যা বা সংকট নেই।
ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানাটি প্রায় ১৮৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন এটি দর্শনার্থীদের জন্য প্রথম উন্মুক্ত করা হয়। এখানে বিভিন্ন জাতের ৩ হাজার ১০০টি প্রাণী রয়েছে। এর একটি বড় অংশ বিপুল ব্যয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে কিনে আনা হয়েছে। যার মধ্যে একেকটি বাঘ কিনতে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এখন দিনে গড়ে ১০-১২ হাজার দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুরের ১২৭, নবাবের বাগের জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন মেসার্স সাগর এন্টারপ্রাইজ ১ কোটি ৯৯ লাখ ৩ হাজার ৪৫০ টাকায় স্বাস্থ্যবান ও নিরোগ ষাঁড় গরুর মাংস সরবরাহের কাজ পেয়েছেন। সেখানে গরুর বয়স ৩-৫ বছর হতে হবে এবং বলদ/গাভি/বকনা গরু দেয়া যাবে না উল্লেখ রয়েছে। সাভার কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে প্রসেসিং করে মিরপুর চিড়িয়াখানায় বিতরণ করার কথা বলা হয়েছে। ১৮৮, নবাবের বাগের আজমের মালিকানাধীন মেসার্স নবাব ইন্টারন্যাশনাল ৭৩ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ টাকায় নলা/মৃগেল মাছ, ছোট মাছ (পুঁটি, ঢেলা, মলা, চাপিলা, চেওয়া, বাইলা), শিং, টাকি ও চিংড়ি মাছ সরবরাহের কাজ পেয়েছেন। এতে মাছের সাইজ, পানি ও বরফমুক্ত এবং জীবিত থাকতে হবে এমন উল্লেখ রয়েছে। মিরপুরের ১৫৬/১ নবাবের বাগের তমিজ উদ্দিনের মালিকানাধীন মেসার্স মাহাবুব এন্টারপ্রাইজ ১ কোটি ৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯০০ টাকায় টাটকা ফল (আপেল, কমলা লেবু/মাল্টা, পাকা পেঁপে, পাকা চিনি চাম্পা কলা, পাকা সাগর কলা, আঙ্গুর, পাকা আম, পাকা তরমুজ, সফেদা, পাকা আনারস ও পাকা লিচু) সরবরাহের কাজ পেয়েছেন। শর্ত আছে, এগুলো কোনোভাবেই পচা বা থেতলানো হলে গ্রহণযোগ্য হবে না।
১২/৩, নবাবের বাগের সিরাজ উদ্দিনের মালিকানাধীন মেসার্স সুমন ট্রেডার্স ৯৮ লাখ ৩ হাজার ৩৫০ টাকায় পেয়েছে শসা/ক্ষিরা, গাজর, লাউ, মিষ্টি কুমড়া সরবরাহের কাজ। শর্তমতে, এর সবই তরতাজা, টাটকা হতে হবে এবং পচা ও থেঁতলানো হলে হবে না। ৫নং গড়ান চটবাড়ী এলাকার বিমল চন্দ্র দাসের মালিকানাধীন মেসার্স শিখা ট্রেডার্স ১ কোটি ৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় ভুট্টা/জাম্বো ঘাস, আটি কলাগাছ, আখ সরবরাহের কাজ পেয়েছেন। ঘাস সবুজ, টাটকা, তরতাজা, পরিচ্ছন্ন এবং কোনো রকম ভিজা হবে না, নরম কাণ্ড ও ফুল আসার পূর্বাবস্থা হতে হবে। আটি কলাগাছ মোথাবিহীন কাচাপাতাসহ ১৮ ইঞ্চি পরিধির হতে হবে। আখ ৫ ফুটের উপরে হতে হবে, পচা, থেঁতলানো হলে হবে না। ভুট্টা/জাম্বো ঘাস সাভার কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে প্রসেসিং করে মিরপুর চিয়াখানায় বিতরণ করার কথা বলা হয়েছে। একই প্রতিষ্ঠান ৫৯ লাখ ৫৫ হাজার ৬৮০ টাকায় অ্যাকুরিয়াম ফিস, ভিটামিন প্রিমিক্স (পোল্ট্রি), ভিটামিন প্রিমিক্স (গবাদিপশু), টক্সিন বাইডার, গুড়, আয়োডিনযুক্ত লবণ, গমের ভুসি ও ডিসিসি সরবরাহের কাজ পেয়েছে।
৭/৩ বসতি প্রোপার্টি মিরপুর বড়বাগের মাসুদের মালিকানাধীন মেসার্স সামীর ইন্টারন্যাশনাল ৬৯ লাখ ৮১ হাজার ১০০ টাকায় পেয়েছে শুকনা ধান, সিদ্ধ চাল, চিনা, সরিষা, সূর্যমুখী ফুলের বীজ, ছোলা, সয়াবিন মিল, আস্ত শুকনা গম ও পোল্ট্রি ফিড সরবরাহের কাজ। এগুলোর আদ্রর্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলা আছে। ৬৯/১, নবাবের বাগের নজরুল ইসলামের মালিকানার মেসার্স সুবর্ণা ট্রেডার্স ২৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকায় পেয়েছে পাউরুটি, চীনাবাদাম, পাস্তুরিত তরল দুধ, মুরগির ডিম সরবরাহের কাজ। ২৭ গড়ান চটবাড়ীর সুমনের মালিকানার মেসার্স সুমী এন্টারপ্রাইজ ১৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকায় জীবন্ত খরগোশ, জীবন্ত ব্রয়লার মুরগি, জীবন্ত মেটেসাপ ও মুরগির বাচ্চা সরবরাহের কাজ পেয়েছে। ১৫৪, নবাবের বাগের লিটনের মালিকানার মেসার্স নাহার কনস্ট্রাকশন ৪৮ লাখ ৯ হাজার ৩০০ টাকায় লালশাক, ডাটাশাক, কলমিশাক ও বাঁধাকপি সরবরাহের কাজ করে।
চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাওয়া একাধিক দর্শনার্থী অভিযোগ করে বলেছেন, সকালে বা দুপুরে গিয়ে দেখা যায় নির্দিষ্ট সময়ে খাবার না পেয়ে অনেক প্রাণী হাঁসফাঁস করছে। আবার দেয়া হলেও অধিকাংশ প্রাণীর খাঁচার ভেতরকার খাবারই টাটকা নয়। অনেক খাঁচায় পচা মাছে মাছি উড়তে দেখা যায়। বাঘ ও সিংহের খাঁচার মাংস দেখে ষাঁড়ের মাংস মনে হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঠিক তদারকির অভাবে চিড়িয়াখানার ভেতরে স্টাফ ও ঠিকাদারদের নিয়োজিত লোক চিহ্নিত করাও দুষ্কর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিড়িয়াখানার একাধিক স্টাফ জানিয়েছেন, সবই সিন্ডিকেট করে হয়, ঘুরেফিরে তারাই। চিড়িয়াখানা প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন! তাই অনিয়ম ও শর্তের ব্যত্যয় হলেও তা প্রকাশ পায় না।
এ প্রসঙ্গে মেসার্স শিখা ট্রেডার্সের কর্ণধার বিমল চন্দ্র দাস মোবাইল ফোনে দাবি করেছেন, চিড়িয়াখানায় ঠিকাদারি কাজে প্রতিদিন খাবার সরবরাহ করতে হয়। এজন্য কেউ এতে অংশ নিতে চায় না। স্থানীয়রাই এতে অংশ নিয়ে আসছে। ৩৫ বছরের অধিক সময় ধরে নবাবের বাগ ও গড়ান চটবাড়ীর লোকজন সব ধরনের সরবরাহের কাজ করে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, গেটে টিকেটের ডাকও তারাই পর্যায়ক্রমে করে থাকেন। তবে এবার গাবতলী পশুর হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান গেটের টিকেটের কাজ পেয়েছেন। করোনা মহামারির মধ্যেও প্রাণীর খাবার সরবরাহ অব্যাহত জানিয়ে তিনি বলেন, এতে লাভের পাশাপাশি অনেক সময় লোকসানও হয়। তবুও আগ্রহী না থাকায় তারাই এই ব্যবসা করেন!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়