ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

সাংস্কৃতিক জাগরণ ও আমাদের বাঙালিয়ানা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল, বাঙালিদের দেশীয় সংস্কৃতি পাকিস্তান অঞ্চলের সাথে মানানসই নয়। অথচ ‘বাংলা ভাষা’ ও ‘বাঙালি জাতি’ দুটি একই আভিজাত্য সত্তার মননশীলতার বহিঃপ্রকাশ। যদিও তাদের আঘাতে আমাদের বাংলা ভাষা হারায়নি কিংবা বাঙালিয়ানা এতটুকু লীন হয়ে যায়নি। বরং বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পেরেছে এবং আমরা এখনো ষোলো আনাই বাঙালি। বাঙালির সুপ্ত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠেছিল বাংলা ভাষাকে ঘিরে। সেখান থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি ক্ষীণ জলধারা তৈরি হয় এবং ক্রমেই তা ব্যাপ্তি লাভ করে। তাই প্রাণের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য বাঙালিরা প্রাণ বিসর্জন দিতেও কার্পণ্য করেনি। এটা যেমন বীর বাঙালি ইতিহাসে গৌরাগাঁথা সাফল্য তেমনি ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক জাগরণও বটে। এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস’ বইতে লিখেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে দেখা হতো। অন্যদিকে ব্রিটিশ সমাজ বিজ্ঞানী, জেনিফার কোটস পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লিখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির অনেক অমিল এবং বাঙালি তাদের সংস্কৃতি রক্ষা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল।’ তিনি আরো লিখেন, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে ভিন্ন খাতে- তারা বলত সঠিক খাতে পরিবর্তনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাতে মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চাপ দেয়া।
সে উদ্দেশ্যেই তারা বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর হামলে পড়ে। এদেশের দেশীয় সংস্কৃতিকে পাল্টে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা করেই পাকিস্তানিরা থেমে থাকেনি। তাদের পরিকল্পনায় এমনও ষড়যন্ত্র ছিল, আরবি হরফে বাংলা লেখার সূ² বিভাজন অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে আরবি ভাষায় রূপান্তরিত করবে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ পালনে পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে প্রবল বাধা দেয়া হয়। বাঙালিরা তাদের শত বাধা উপেক্ষা করে বাংলা নববর্ষ পালন করে। তবে সংস্কৃতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ১৯৬৭ সালের ২৪ জুন। সেদিন পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলো, রেডিও পাকিস্তান থেকে কোন রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করা হবে না! এ ষড়যন্ত্রে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ ৭০-এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে শহীদ মিনারে যে সব গান গাওয়া হতো মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক গানও ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না’- এসব গান আমাদের প্রাণের মাঝে নতুনভাবে উচ্ছ¡াস জাগিয়ে রাখত। মূলত তাদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায় বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের ফলে।
পাকিস্তানের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা অনেক বুদ্ধিজীবী করেছিলেন। ১৮ জন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষèতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।’
মানুষ কিংবা জাতি ধ্বংসকারী ব্যক্তিরা সব সময়ই প্রতিপক্ষের চেতনায় আঘাত করে। ইতিহাসও সেরকম সাক্ষ্য দেয়। জার্মানির হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা সংস্কৃতি সংহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই এক রাতেই প্রায় হাজার বিশেক বই পুড়িয়ে ফেলে। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মানব সংহারে রূপ নেয়া। পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রেও আমরা সেরকমই দেখতে পাই। সংস্কৃতি বিষয়ে বর্বর দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তা মুছে দিতে চেয়েছিল। প্রথমে সংস্কৃতি সংহার করে ক্রমেই তা মানব সংহারে রূপ নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। সেজন্যই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন ‘সার্চ লাইট’- এর সময় বিভিন্ন গুণীজনদের পাশাপাশি সংস্কৃতি কর্মীদেরও হায়েনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হয়। ফলে আমাদের হারাতে হয়েছে অসংখ্য সংস্কৃতি ব্যক্তিদের। ‘সার্চ লাইট’- এর পরিকল্পনার চতুর্থ ধারায় উল্লেখ করা হয়, ‘গ্রেপ্তার করতে হবে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের এবং শিক্ষকমণ্ডলী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যকার চরমপন্থিদের’। তাতে বলা যায়, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা পাকিস্তানি দোসরদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল। কি পার্থক্য রইল জার্মানির হিটলারের নাৎসি বাহিনী এবং পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীদের মাঝে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী আগুনে দগ্ধ করেছিল বই অপরদিকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল বইয়ের রচয়িতাদের! পাকিস্তানিরা বাজেয়াপ্ত করেছিল কিছু সংখ্যক বই- যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সত্যেন বসু, কামরুদ্দিন আহমদ, আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
শিল্প সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে এক ধরনের আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়। শিল্পীত মনের ব্যক্তিরা মনের উৎকর্ষ সাধনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আবিষ্কার করে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। সেই নতুন পথ ধরে এগিয়ে যায় সমাজ। সেক্ষেত্রে সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজের ক্যানভাস স্বরূপ। মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ যথার্থই বলেছেন, ‘মানুষের মননশীলতার সামগ্রিক ও সুন্দরতম প্রকাশ হচ্ছে সংস্কৃতি। শিল্প, সাহিত্য, কাব্য প্রভৃতি এই সংস্কৃতির বাহন।’ মননশীলতা গড়ে ওঠে বুদ্ধি এবং হৃদয় বৃত্তির যথার্থ সম্মিলনে। অথচ পাকিস্তানিরা সে জায়গাটাতেও বাঙালিদের আঘাত করেছিল।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে অনেকটা চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে দেশ আজ এগিয়ে চলেছে। যে বাংলা ভাষার জন্য অনেককেই প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে তা আজ বিশ্বদরবারে আসীন হয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর স্বীকৃতি নিয়ে অমর একুশের আত্মবলিদান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে জ¦লজ¦ল করছে।
একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে সে জাতি আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। অথচ বাঙালি জাতির হাজার বছরের পথচলাকে আরো ঋদ্ধ শাণিত করে বৈশাখের বর্ণিল আয়োজন, দেশীয় সব উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতা। তবে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুত তার সাধনার মধ্য দিয়েই ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালিদের পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি রচিত হয়। রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন ভাষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়