ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

সবার আগে ইনসানিয়াৎ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পরিবর্তনে হয় স্রেফ রদবদল, রূপান্তরে হয় মৌলিক পরিবর্তন। সাপকে সাধারণত প্রতি তিন মাসের ব্যবধানে খোলস পরিবর্তন করতে হয়। খোলস পরিবর্তনে সাপ অধিকতর মসৃণ ও আকর্ষক হয়। অন্যদিকে, খোলস ছেড়ে শুয়োপোকা যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে হয়ে যায় একটি অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি। সাপেরটা পরিবর্তন, আর প্রজাপতিরটা রূপান্তর। আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। ভারত, পাকিস্তান এবং আমেরিকায়ও এমন ব্যবস্থা। প্রশ্ন হলো, পরিবর্তন হলেই কি সবসময় সুদিন আসে? পরিবর্তন কি শুধু ভালোকেই চিহ্নিত করে? ভালো থেকে খারাপ হয়ে যাওয়াও তো পরিবর্তন। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে একটি বক্তব্য বড় চেনা হয়ে গিয়েছে আমাদের- ‘যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ’। বিদ্যালয়ের সংস্কার, চকচকে রঙ, নতুন নতুন ভবন ইত্যাদি বাহ্যিক পরিকাঠামোগত পরিবর্তন করা সহজ। প্রয়োজন শুধু অর্থ আর ইচ্ছা। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রের কোমল পরিকাঠামোর রূপান্তর ঘটানো কিন্তু ততটা সহজ নয়। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের বিদ্যালয়টির মাস্টার সাহেবরাও বুঝে গিয়েছেন খেলার নিয়ম। বুঝে গিয়েছেন, সিঁড়ি কোনটা, লিফট কোনটা। শাসক শ্রেণির ভজন করতে পারলে উন্নতি, আর বিরোধিতা করলে শাস্তি।
মানুষ গড়ার কারিগরদের অনেকেই আজ পড়াশোনা শিকেয় তুলে দিয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সরকার পরিবর্তন হলেও মানুষ গড়ার কারিগরদের কোনো পরিবর্তন নেই। তারা শাসক শ্রেণির সঙ্গেই থাকেন। তাই সরকার পরিবর্তনে শিক্ষার কোমল অবকাঠামোতে কোনো পরিবর্তন নেই। শিল্পের কথা যদি ভাবা যায়, তাহলে ফলাফল সেরকমই দাঁড়ায়। আমাদের একটি বড় সমস্যা কর্মহীনতা। দ্রুত শিল্পায়ন না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সরকার পরিবর্তন হলেই কি শিল্প এবং বিনিয়োগ হই হই করে চলে আসবে? কস্মিনকালেও নয়। সমস্ত আমলাতান্ত্রিক জট ছাড়ালেই কি বিনিয়োগের প্লাবন ঘটে যাবে? তাহলে তো তেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং আইনের জাল শিথিল করে পোশাক শিল্প আর ভারি শিল্প খাতে পৃথিবীর বড় বড় বিনিয়োগ সোমালিয়া কিংবা বুরুন্ডির মতো দেশ ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারত চীন, ভারত, বাংলাদেশ থেকে। আইন সহজ হলে লগ্নিকারীরা হয়তো কিছুটা উৎসাহী হন, কিন্তু তাদের পাখির চোখ সেই সঙ্গে খুঁজে সেখানে বাজারের আয়তন, মুনাফার সুযোগ এবং দক্ষ শ্রমিক।
কাজেই শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন কাজটি সহজ, কিন্তু রূপান্তরের কাজটি সহজ নয়। ¯পর্শনসাধ্য শিক্ষার পরিকাঠামোর উন্নতি করার কাজটি বেশ সহজ হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভ্যাসগত ভেতরের পরিকাঠামো বদলিয়ে ফেলা সহজ নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের এবং নেতাদের আধিপত্যের অচলায়তন ভাঙা সহজসাধ্য নয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ থাকছে, মেধাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রসার ঘটতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উন্নতির স্বার্থে এখানে প্রয়োজন রূপান্তর, একেবারেই মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো।
শিল্পায়নের পথে রূপান্তর বিষয়টিও শিক্ষাক্ষেত্রের ন্যায় বেশ কঠিন উপলব্ধির একটি বিষয়। হার্ভার্ডের বিখ্যাত অধ্যাপক মাইকেল পোর্টার শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে এ বিষয়ে সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ধরা যাক তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে একটি অপূর্ব হোটেল নির্মাণ করা হলো। সারা বিশ্ব খুঁজে খুঁজে নামকরা শেফ ও বাবুর্চি নিয়োগ দেয়া হলো। হোটেল পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি সংস্থাকে। হোটেলটি সমস্ত মাপকাঠিতে হয়ে উঠল বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ পাঁচতারা হোটেল। হোটেলের দরজা উন্মুক্ত করতেই অতিথিরা বিজ্ঞাপন আর হোটেলের আলোকচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলেন। এবার গল্পের মোড় বদলানো। অতিথিরা বিমানবন্দরে পা দিয়েই দেখলেন, শুল্ক ও অভিবাসন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্ব্যবহার করছে, লাইনের অতিথিদের টপকে লাইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে কাউকে কাউকে অগ্রাধিকার দিয়ে বের করে আনছে। বিমানবন্দর পার হতেই তাদের চোখে পড়ল রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। খানাখন্দ, চারদিকে নোংরা আবর্জনার স্তূপ। গাড়ি চলতে চলতেই অতিথিরা টের পেলেন স্থানীয় মাস্তানদের দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজির জুলুম। হোটেলে অতিথিরা ঠিকই পেলেন অপূর্ব খানাপিনা। পাঁচতারা হোটেলের আতিথেয়তার কোনো ত্রæটি নেই। কিন্তু কিছুদিন পরই অতিথি আসা কমে গেল। তারপর হোটেলটি বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হলো। উদাহরণে স্পষ্ট যে, একটি সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে পারে। কিন্তু সফল হতে গেলে তার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের সাহায্য পেতে হবে। অতিথিদের সঠিক অভিজ্ঞতা নেতিবাচক হলে সেই সংস্থা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারবে না। যারা শিল্পে লগ্নি করতে আসবেন, তাদের বিচারে এমন মানদণ্ড বড় করে ধরা দেবে।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বিষয়টিও শিক্ষা ও শিল্পের মতো। টিকা দিতে টেকনিশিয়ান মেয়েটি কত দক্ষতার সঙ্গে টিকা পুশ করল, কিংবা ডাক্তার সাহেব কতটা যতœ করে রোগীকে দেখলেন তা-ই শুধু রোগীর একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হবে না। রোগীর বসার জায়গা, আলো-বাতাস এবং কাঠামোগত অবয়ব, যন্ত্রপাতির দক্ষতাসহ নানাবিধ বিষয়ও রোগী বিবেচনায় নেবেন। সবকিছু মিলিয়েই শেষ ফলটি হয়। একজন ডাক্তার খুব দক্ষ, কিন্তু তিনি যেখানে কাজ করবেন তার সবকিছুই অদক্ষ অবয়বে ঢাকা হলে সেই ডাক্তারের কাছে রোগী আসতে তিনবার চিন্তা করবে। বাংলাদেশের চিকিৎসা জগতে এ প্রশ্নই সবসময় সবার ওপরে ছিল। এখানে অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আছেন; কিন্তু বাংলাদেশের অসুস্থ মানুষগুলো সুযোগ এবং সামর্থ্য পেলেই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা চলে যায় চিকিৎসার জন্য। ক্লিনিক, হাসপাতাল, নার্স, সহযোগী, যন্ত্রপাতি কোনো কিছুকেই ঠিক ভরসার জায়গায় অনেকে নিতে পারে না।
যুগে যুগে দেশে দেশে গণবিপ্লব রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। সেখানে কোথাও ঘটেছে পরিবর্তন, আবার কোথাও ঘটেছে রূপান্তর। বিপ্লব কিন্তু ব্যাপক বিষয়। যদি বলি চাঁদ কোথায় কোথায় আলো দেয়, তাহলে প্রথম বুঝতে হবে চাঁদের আলো কোথায় কোথায় পড়ছে না। বিপ্লবের চরিত্র বুঝতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে কী কী বস্তু বিপ্লব নয়। বিপ্লব কোনো চিত্রকর্ম, নিবন্ধ রচনা, সূচিকর্ম, নৈশভোজ কিংবা সভার বক্তৃতা নয়। বিপ্লব পুরোটা জুড়েই আসে এবং ঝড়ের বেগেই আসে। বিপ্লব এক শ্রেণি দিয়ে অন্য শ্রেণিকে উৎখাত করে। সেখানে পরিবর্তন অবধারিত, কিন্তু রূপান্তর সবসময় অবধারিত নয়। মহাচীনের বিপ্লবের কথা তো মনে আছে? সেই বিপ্লবে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছিল গণচীনে। কিন্তু সেখানে রূপান্তর আসে আরও খানিকটা পরে। চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার আসে দেং জিয়াও পিং-এর নেতৃত্বে। দেং তাত্ত্বিক ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমার জানার দরকার নেই বিড়ালের রঙ কালো না সাদা- ইঁদুর ধরতে পারলেই হলো। তার আমলেই চীনে শুরু হয় বিশ্বায়ন এবং বাজার অর্থনীতির আরাধনা। সেই ব্যাপক রূপান্তরের ফলে চীন আজ গোটা বিশ্বের কারখানায় পরিণত হতে পেরেছে। আমেরিকানরা বিশ্বাস করে, গোটা পৃথিবীটা বানিয়েছিলেন ঈশ্বর, আর আজ পৃথিবীর সবকিছু বানায় চীন।
ভারতবর্ষের রূপান্তর ঘটেছিল। ভারত আর পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক রূপান্তরের মাধ্যমে। ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ ঠিক ভারত কিংবা পাকিস্তান কেউই ধারণ করে পথ চলেনি। একেবারেই রূপান্তরিত ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। বিপ্লব ঘটেছিল ব্রিটিশ ভারতে বহুদিন ধরে। সেই বিপ্লবের পথ গলে রূপান্তরিত ভারতের জন্ম হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু পাকিস্তান হেঁটেছিল ভিন্ন পথে। ধর্ম দিয়েই পরিচিত করতে চাইল পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেখানে বারবার রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেও পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে রূপান্তরের সুযোগ আসেনি। সেই সুযোগটাই এসে গেল একদিন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হাতে ১৯৭১ সালে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল- ভারত ও পাকিস্তান। ব্রিটিশ ভারতের দুটি প্রদেশ এ ভাগাভাগিতে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। পশ্চিমে পাঞ্জাব, পূর্বে বাংলা। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর পূর্ব বাংলা হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান, আর পশ্চিম বাংলা থেকে যায় ভারতে। সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাকিস্তানকে বলে এসেছিল, বাংলা ভাষাকে মূল্য দাও। যখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ঘোষণা দিয়ে বসে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তখন ভাষার জন্য গর্জে উঠেছিল বাঙালি সমাজ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এমন স্লোগানে ছেয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস। বিপ্লব জেগে উঠতে চাইল। ভাষার জন্যও প্রাণ দিতে হয়- এমন শিক্ষা বুঝি বাঙালিই প্রথমে জোরেসোরে বিশ্বকে জানিয়ে দিল। শাসকের বন্দুকের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেল কয়েকজন বাঙালির বুকের পাঁজর। তুষের আগুনের মতো ক্রমেই বাড়তে থাকল বাঙালির বিপ্লবের সুর।
বাঙালির প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান এগিয়ে এলেন। হুংকার দিয়ে জানিয়ে দিলেন পাকিস্তানের শাসকদের- পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরাও মানুষ। শেখ মুজিব একসময় হয়ে দাঁড়ালেন নিপীড়িত বাঙালির কণ্ঠস্বর। ছয় দফা দিয়ে তিনি পাকিস্তানকে জানিয়ে দিলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন চায়। পাকিস্তান শাসকশ্রেণি মেনে নিল না বাঙালিদের দাবি। শেখ মুজিব হয়ে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ঘোষণা দিলেন-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যার হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির বিপ্লব এক লাফে পৌঁছে গেল স্বাধীনতাযুদ্ধের পর্বে। সৃষ্টি হলো বাঙালির জন্য নতুন ইতিহাস। সৃষ্টি হলো বাঙালির নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ধর্ম দিয়ে পরিচয় নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা তুলে ধরল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র হয়ে দাঁড়াল নতুন দেশটির মূলমন্ত্র। রূপান্তর ঘটে গেল পাকিস্তানে। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ দুই মেরুর নতুন ভুবনে দুই পৃথক রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল। শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, রূপান্তর ঘটল বাঙালির রাজনীতিতে। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের বাঙালির পেশা, নেশা, ইতিহাস এবং জীবনকে বহন করে চলতে থাকল। একদিন পাকিস্তানি সেনা পরিবৃত পূর্ব পাকিস্তানে দাঁড়িয়ে এক সাহসী বাক্যে আত্মপরিচয় ঘোষণা করেছিলেন ভাষাপণ্ডিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এভাবে- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়েও বেশি সত্য আমরা বাঙালি’। শহীদুল্লার সেই অমর বাণী বাস্তবতা লাভ করল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশে। ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে গণতন্ত্রের নতুন পথে অগ্রসর হতে থাকল বাংলাদেশ। বিপ্লবে সবার আগে শত্রæ চিনতে হয়। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ তাই ভালোভাবেই তার শত্রæ চিনতে পেরেছিল। তাইতো সে ধর্মান্ধতার হাতছানি উপেক্ষা করতে পেরেছিল। নীলছোঁয়া ফাল্গুনী আকাশ খুঁজে পেয়েছিল বাঙালি। গ্রহণশীল আর গ্রহণযোগ্য চিরায়ত ভাবাবেগ এবং স্বচ্ছ অনুভূতির মতো উদার-অন্তহীন বিস্তৃতি নিয়ে মুজিবের বাংলাদেশ পাখা মেলতে সক্ষম হয়েছিল। যার দিগন্ত ছিল না, কালের মাত্রা ছিল না, সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতার নির্বোধ মানচিত্রায়ন ছিল না- সে হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোষ্ঠীহীন সমাজের প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ খুব বেশিদিন সে পথে হাঁটতে পারেনি স্বাচ্ছন্দ্যভাবে। হোঁচট খেয়েছে এরপর। বাঙালির আকাশকে, তার ভৌগোলিক বোধকে, সত্তার বিশিষ্ট রাজনৈতিক সংজ্ঞাকে বিভাজিত এবং কলুষিত করতে চেয়েছে বারবার। বহিরাগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বারবার আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে ভিন্ন মত। রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের পথ করে নিয়েছে সেই শক্তি। আমাদের প্রেমাসক্তি এক হয়ে একস্বরে তোড়ের মুখে তাকে ভাসিয়ে দিতে পারেনি অনেক সময়ই। কিন্তু তারপরও আমাদের ভাষাটুকু এখনো বেঁচে আছে। আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি, তার জোরে আমরা মন্দির নিয়ে, মসজিদ নিয়ে, গীর্জা নিয়ে লড়াই করি না। ধর্মস্থানকে আমরা রাজনীতির অঙ্গন ভাবি না। ইতিহাসস্পর্শী উৎসবের আবেগকে জড়িয়ে অন্ধ রাজনীতি, ভণ্ড রাজনীতি, কালিমাযুক্ত রাজনীতি আমরা সায় দিই না। আত্মচৈতন্যে আমরা মগ্ন হয়ে বলি- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। যতই চেষ্টা হোক- বাঙালি জাতির অখণ্ড সত্তাকে কখনো শ্রেণি কিংবা ধর্মীয় ভেদরেখায় আটকে রাখা যাবে না। যারা বাঙালিকে মানুষ ভাবে না, বাঙালি ভাবে না, ভাবে নিছক একটি সাম্প্রদায়িক জীব, তাদের প্রচেষ্টা যতটাই শক্ত হোক, তা বাংলাদেশে সফলতার মুখ দেখতে পাবে না- এ বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষের আছে।
রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে এখনো বাঙালি উদ্বেল হয়ে ওঠে। সত্তর দশকে বড় হয়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের বাঙালি একটি গান শুনলে এবং একটি বক্তৃতা শুনলে এখনো উদ্বেল হয়ে ওঠে। বক্তৃতাটি বেরিয়ে এসেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠ থেকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। পৃথিবীর কোণে কোণে যে ক’টি বক্তৃতা সাধারণ মানুষকে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয় উদ্বেল হওয়ার মন্ত্র, শেখ মুজিবের বক্তৃতাটি তাদের মধ্যে অন্যতম। একটি গান লিখেছিলেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার- ‘শোন, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল অন্যরকম। কিছুদিন আগেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ছোট্ট দেশ কিউবা। অন্য প্রান্তে স্পর্ধায় মাথা তুলেছে ভিয়েতনাম। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের। বাংলাদেশের পাশে ভারত। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন সমাজতন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ সারা দুনিয়াকে একটি শিক্ষাই দিয়েছিল। সবার আগে সেই শিক্ষা যে সত্যতা প্রকাশ করে তা হলো, ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ বোঝার বিপদ। ধর্মের নামে দেশ গড়ে দিলেও তা স্থায়ীভাবে ধরে রাখা যায় না। ভাষা এবং সংস্কৃতির টান ধর্মের বন্ধনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। ব্রিটিশ-ভারত ভাগের বেদনাও শৃঙ্খল ভেঙে ২৪ বছরের মধ্যেই বাংলা ভাষার এক স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নিয়ে বাংলাদেশ জানিয়ে দিল, ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র হয় না; ধর্মের চার দেয়ালের মধ্যে সংস্কৃতিকে ধরে রাখা যায় না। ইসলামাবাদ থেকে ছড়ি ঘুরিয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে বাংলাদেশকে ঢেকে রাখা যায়নি। সেদিনের সেই বাংলাদেশের জন্ম শিক্ষা দিয়েছিল- ভিন্ন ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের দেশে মহান মিলন গড়তে হলে বহুত্বকে সম্মান করতে শিখতে হবে; বৈচিত্র্যকেই ঐক্যের সূত্র হিসেবে ধরতে হবে।
ধর্মের নামে ভারতবর্ষের ভাগ থেকে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এমন দেশভাগের ব্যর্থতার প্রমাণ বাংলাদেশের জন্ম। আর সেখানেই বাংলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুজিবের বিশেষত্ব। এ কথা সত্যি যে, মুজিবের মতো নেতা ছাড়া বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সাহসী চেতনার বিস্তার হতো না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষদের স্বাধীনতাযুদ্ধে এগিয়ে যেতে পথ দেখিয়েছিল। মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছিল বীরদর্পে। শেখ মুজিবের এ শিক্ষা, বাংলাদেশ জন্মের এ শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়াবে অগ্নিশিখার আলোর মতো। স্বাধীনতার স্বপ্নে মানুষকে উজ্জীবিত করে বাঙালিকে লড়াকু জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তার হাত দিয়ে ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান- যার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ইতিহাসের পাতায় তাই বাংলাদেশের জন্ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি রূপান্তরিত বিপ্লব হিসেবে।
গল্পটি ঠিক গল্প নয়, কঠিন সত্য ছিল। শেষ ফাল্গুনের বেলায় অনেকক্ষণ পথ চলতে চলতে ছেলেটির তেষ্টা পেয়েছিল। বয়স তার ১৩ কি ১৪ বছর। রাস্তার ধারে বড়সড় একটি মন্দির। পানি খেতে সেখানে ঢোকে সে। বেধড়ক মার খায় ছেলেটি। তার অপরাধ, সে ধর্মে মুসলমান। মন্দিরের দরজায় পরিষ্কার লেখা আছে- হিন্দু ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের ঘটনা এটি। মারধরের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্দিরের কর্তারা সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, তাদের মন্দিরে ‘ওরা’ ঢুকবে না, ব্যাস! কিন্তু গল্পের এখানেই শেষ নয়। সংবাদপত্র এগিয়ে চলে, ক্যামেরার সামনে আসে মার-খাওয়া কিশোরের স্বজনরা। তার দিনমজুর বাবা নিচু গলায় ছেলেরই দোষ স্বীকার করে নিলেন- লেখাপড়া জানে না তো, তাই লেখাটা বুঝতে পারেনি। গাজিয়াবাদের ওই অসহায় শ্রমিক পিতার মিনতি যখন বাতাস ভারি করছিল, ঠিক তখনই তার পাশে কারা যেন একজন-দু’জন করে জড়ো হতে লাগল। পাশে এলো কিছু মেয়ে। কেউ পরিবারের, কেউ প্রতিবেশী, কেউ সমাজকর্মী। সংবাদমাধ্যমে বাবার মুখে মূর্খ ছেলের ভুল করে মন্দিরে ঢোকার কথা শুনতে শুনতে তারা অচিরেই অস্থির হয়ে পড়লেন এবং তাকে থামিয়ে দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘বাচ্চা কোনো ভুল করেনি। পানি তেষ্টা পেয়েছিল, পানি খাবে না! মন্দির হোক, মসজিদ হোক- কী আসে যায়?’ এই মেয়েদের কণ্ঠস্বরে কোনো সংশয় নেই; একফোঁটা ভয় নেই। গরিব ঘরের ওই সাধারণ মেয়েদের তীব্র এবং স্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, এই জোরটাই আজ আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজন। এই জোরটাই প্রয়োজন বাংলাদেশে, ভারতে এবং পাকিস্তানে। ভয় তো আজ ভয়ংকরভাবে আমাদের সাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাড় হিম করা ভয়। ভয়ের দাপটের চিহ্ন এতটাই স্পষ্ট যে, অসহায় মানুষগুলো নিজেরাই ভয় পেয়ে গুটিয়ে থাকে। আর এ গুটিয়ে থাকাই একসময় তাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়।
দেশজুড়ে এই ‘স্বাভাবিক ভয়’ সঞ্চারিত করে চলারই উৎকট অভিযান দেখছি আমরা। যারাই সাহসের সঙ্গে এই ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, তাদের ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে চায়- তাদেরকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য বেপরোয়া উদ্যমে সমস্ত রকমের ছল-বল ও কৌশলের প্রয়োগ জারি আছে। সুযোগ পেলেই তারা প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে হাতে ধারালো অস্ত্র তুলে নেয়। কিন্তু প্রতিবাদী ওই গাজিয়াবাদের মেয়েদের সাহসটুকু দেখে মনে হয়, ভয় পেয়ে সিটিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়তো এখনো হয়নি। দেশজুড়ে বিদ্বেষ দিয়ে মানুষকে ভাগ করার যে তৎপরতা, তার মোকাবিলায় ওই নির্ভীক প্রত্যয়ের কোনো বিকল্প নেই। যারা বিভেদ এবং বিদ্বেষকে তাদের মূলধন করে ক্ষমতার কারবার চালাতে চায়, প্রথম কাজ হলো তাদের খেলাটাকেই অস্বীকার করা। তাদের মুখের ওপর বলে দেয়া- ‘লোকের পানির তেষ্টা পেলে যেখানে পানি আছে সেখানেই পানি খাবে’। এটাই মনুষ্যত্ব। ওই মেয়েদের কথাগুলো কোনো শেখানো বুলি নয়, আন্তরিক বিশ্বাসের কথা। ওই মেয়েদের সেই বিশ্বাস আছে। তাই তারা এমনটা বলতে পারছেন। আমরা আজ অনেকেই হয়তো সেই বিশ্বাসের জোরটা হারিয়েছি। তাই নানা যুক্তির জাল বুনি, রকমারি তত্ত্ব খাড়া করি। কিন্তু ধর্মের নামে যারা চূড়ান্ত অধর্মের কারবার চালায়, তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে বলতে পারি না- আগে ইনসানিয়াৎ। যখন একটি মানুষের খিদে পায়, সেই খিদে তো আর ‘হিন্দু খিদে’ কিংবা ‘মুসলমান খিদে’ আলাদা করে হয় না। এসব কথা আমরা জানি; জেনেও আবার ভুলে যাই। ভুলিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু মনে রাখা আমাদের কাজ, আমাদের দায়িত্ব ও দায়। আর সেই দায় মেটাতে পারলে ওই গাজিয়াবাদের মেয়েদের মতো আমাদেরও ভয় কাটবে, সাহস ক্রমে আসবে। আর এটাই আজকের বিপ্লব; আজকের দিনের সামাজিক রূপান্তর। এটা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। এই রূপান্তরের পথ চেয়ে আছে আগামী দিনের সময়গুলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়