ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

শেখ মুজিবই প্রথম ভাষাশহীদদের হত্যার বিচার চাইলেন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পুরাতন বাংলা সাময়িকপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে আজ অনেকেই বিস্মিত হবেন যখন দেখবেন, বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা কি- এই প্রশ্নে এক সময় এ দেশের বিতর্ক হয়েছে। বিতর্কে এক পক্ষ মত প্রকাশ করেছে যে, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু এবং অপর পক্ষ মত প্রকাশ করেছে, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল তার সঙ্গে ওই পুরাতন বিতর্কের সম্পর্ক আছে। উর্দু ভাষার এবং উর্দুভাষী পরিবারসমূহের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে এবং উত্তরকালের ঘটনাবলি লক্ষ করলে এটা বোঝা যায়।
ইতিহাসে দেখা যায় উর্দু ভাষার উদ্ভব ঘটেছে ভারতবর্ষে, মোগল আমলে। উর্দু শব্দের অর্থ সম্ভবত সৈন্য কিংবা তাঁবু। মোগল আমলে ভারতবর্ষের শাসক শ্রেণি গঠিত হয়েছিল তুর্কি-মোগল, ইরানি, আফগান প্রভৃতি বিদেশিদের দ্বারা; বিদেশিদের সহযোগী কিছু দেশি লোকও শাসক শ্রেণিতে ছিল। মোগল প্রশাসনে ও সেনাবাহিনীতে নি¤œস্তরের সরকারি কর্মচারীরা ও সিপাইরা ছিল দেশি লোক। পাইক-পেয়াদা ও নি¤œ স্তরের কর্মচারীরা দেশি লোক হলেও সকল স্তরের আমলারা ছিল বিদেশি। সেনাবাহিনীতে সিপাই-সান্ত্রিরা দেশি লোক হলেও সকল স্তরের কমান্ডে ছিল বিদেশিরা। নায়েব-গোমস্তা দেশি হলেও জমিদার-জায়গীরদার, মনসুবাদার-সুবাদার বিদেশি। বাংলার রাজনীতিতে বিদেশি শাসকরা এসেছিলেন আক্রমণকারী বিজয়ী রূপে। তুর্কি-মাগল, ইরানি ও আফগানদের মাতৃভাষা ছিল তাদের নিজ নিজ দেশের ভাষা; আর সিপাই ও নি¤œস্তরের কর্মচারীদের আর জনসাধারণের ভাষা ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা : প্রধানত হিন্দি ভাষা। শাসনকার্যে, রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় এবং বিভিন্ন ভাষার লোকদের পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানে বহু ভাষার স্থলে এক ভাষা ব্যবহারের তাগিদ অনুভূত হত। মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই তুর্কি আমলে এই প্রক্রিয়া সূচিত হয় এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ক্রমে একটি স্বতন্ত্র ভাষারূপে উর্দু ভাষার উদ্ভব ঘটে। তবে এটাও সত্য যে, বহিরাগত অনেক লোক দেশের সাধারণ লোকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে দেশি ভাষা গ্রহণ করেছে এবং নিজের স্বাতন্ত্র্য বিলীন করে দিয়েছে।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের ওইসব পরিবারেরই মাতৃভাষা উর্দু যেসব পরিবার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে এসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে। উক্ত বিদেশিদের ভাষার সঙ্গে ভারতীয়দের ভাষার মিশ্রণের মধ্যদিয়ে খোট্টা ভাষা, কুট্টি ভাষা, মুসলমানি বাংলা (দোভাষী পুঁথির ভাষা, মিশ্র ভাষা) ইত্যাদি গড়ে ওঠে। বহিরাগতদের ধর্ম ও মতাদর্শের সঙ্গে দেশী ধর্ম ও মতাদর্শের সংশ্লেষণের ফলে গড়ে ওঠে শ্রীচৈতন্য, নানক, কবির, আকবর, দারাশিকো প্রমুখের মতাদর্শ। মধ্য যুগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতবর্ষে আগত এবং শাসক, কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও ভাগ্যান্বেষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু লোক শত শত বছর ধরে পূর্বতন ভারতবাসীদের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে। ভারতবর্ষের জনসমুদ্রে তারা বিলীন হতে চায়নি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষকে তারা মাতৃভূমি রূপেও গ্রহণ করতে চায়নি, শত শত বৎসরব্যাপী তারা ভারতবর্সে বসবাস করেছে প্রবাসী মন নিয়ে। হিন্দুদের থেকে যেমন তেমনি ধর্মান্তরিত স্থানীয় মুসলমানদের থেকেও তারা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। তাদের বিয়ে-শাদি তারা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে : তারা বংশমর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে, দেশি মুসলমানদের সঙ্গে বহিরাগত মুসলমানরা বৈবাহিক সম্পর্কে যায়নি। তবে উর্দুভাষীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকদের রক্তমিশ্রণ যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। বহিরাগতরা নিজেদের পরিচয় দিয়েছে আশরাফ বা অভিজাত বলে এবং স্থানীয় মুসলমানদের তারা অভিহিত করেছে আতরাফ না নীচজাত বলে। নানা কারণে ‘জাতে তোলা’র এবং ‘জাতে ওঠা’র ব্যাপারও এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। দেশি লোকদের মধ্য থেকে শক্তিমান ও বিত্তবানেরা নানা উপায়ে জাতে উঠেছে।
ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাভাষী ভূভাগে প্রায় আট শো বছর ধরে বহিরাগত ‘আশরাফ’ মুসলমানেরা স্থানীয় ‘আতরাফ’ মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করেছে। নানা ঐতিহাসিক কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অর্থ-বিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা ও ক্ষমতার দিক দিয়ে স্থানীয় বাংলাভাষী মুসলমানেরা বহিরাগত উর্দুভাষী মুসলমানদের চেয়ে অনেক পশ্চাৎবর্তী ছিল। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলেও অবস্থা অনেকটা এরকমই ছিল। বাংলাভাষী মুসলমানরাও যখন শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হলো তখন, প্রথম পর্যায়ে, বাংলার শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে বাংলাভাষীদের চেয়ে উর্দুভাষীরা প্রবল ছিল; তারপর ধীরে ধীরে তারা দুর্বল হয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলার উর্দুভাষী মুসলমানরা নিতান্তই স্বল্প ছিল; কিন্তু তারাই ছিল এখানে শাসক, বাংলাভাষীরা ছিল শাসিত। সামাজিক নেতৃত্বও আশরাফদের হাতে ছিল। তারা এ দেশের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে চাইত না, আভিজাত্যবাদী কায়েমি স্বার্থবাদী মন নিয়ে চলত। মধ্যযুগে তুর্কি, পাঠান, মোগল আমল জুড়েই অবস্থা ছিল এই রকম। তবে পাঠানদের আচরণ ছিল ভিন্ন। তারা দেশি সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করতে চাইত এবং ক্রমে তারা দেশি লোকদের সঙ্গে মিশে গেছে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি প্রবন্ধ আছে ‘হিন্দু পাঠান’ নামে। তাতে তিনি দেখিয়েছেন, হিন্দু পাঠানও আছে। পাঠানদের বাসভূমি আফগানিস্তান ভারতবর্ষের সংলগ্ন। উর্দুভাষী মুসলমানেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেই তাদের স্বদেশ ভেবেছে এবং ভারতবর্ষকে ভেবেছে প্রবাসস্থল। এইসব ঐতিহাসিক ব্যাপার ধারাবাহিকভাবে লক্ষ করলে বুঝতে কোনোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কি কারণে এক সময় এ দেশে প্রশ্ন উঠত ‘বাঙলার মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু?’
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশক এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকব্যাপী বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষার প্রশ্নে ধারাবাহিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মধ্যযুগেও বাংলা ভাষার প্রতি আশরাফদের মনোভাব বিরূপ ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর স›দ্বীপের কবি আব্দুল হাকিমের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে :
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী।
সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি \
মধ্যযুগের বাংলা ভাষার মুসলিম কবিদের এই রকম উক্তি আরও অনেক আছে।
তুর্কি, মোঘল, ইরানিরা এদেশে এসে রাতারাতি ভারতীয় কিংবা বাঙালি হয়ে যায়নি। আসলে তারা বাঙালি হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ধীরে ধীরে। ১৯৬০-এর দশকে বদরুদ্দীন উমর প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ নামে। আইয়ুব খান তাঁর প্রভু নয় বন্ধু বইতে উল্লেখ করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা আরব-ইরান থেকে আগত। ১৯৪৮ সনে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানের যে জনসভায় বলেছিলেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ওই জনসভাতেই তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা আরব-ইরান থেকে আগত। আসলে শাসক শ্রেণির ইতিহাসকেই এঁরা জনসাধারণের ইতিহাস মনে করেছিলেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি থেকে মিরজাফর পর্যন্ত শাসকদের ইতিহাস আর ঢাকার নবাব পরিবারের ইতিহাস দিয়ে কি বাংলার মুসলমান জনসাধারণের ইতিহাস বোঝা যাবে? মুহম্মদ আলি জিন্নাহ থেকে মুহম্মদ আইয়ুব খান পর্যন্ত সকলেই ওই শাসকদের ইতিহাস দিয়েই পূর্ব বাংলার গণমনকে বুঝতে চেয়েছেন। বাংলার বহিরাগত মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি বিচার করতে গেলে দেখা যাবে, তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া এখনও চলছে, সম্পূর্ণ হয়ে যায়নি। ঢাকার নবাব পরিবারের লোকেরা কি আজও ‘বাঙালি’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’ হতে পেরেছে? উনিশ শতকের শেষে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান ফজলে রাব্বি হকিকতে মুসলমানানে বাঙ্গালাহ গ্রন্থে যেসব মুসলমান পরিবারের বিবরণ দিয়েছেন সেগুলো ‘আশরাফ পরিবার, বাঙালি মুসলমানদের পরিবার নয়, আক্রমণকারী, অভিযানকারী, পররাজ্য-গ্রাসকারী বহিরাগত শাসক মুসলমানদের (তুর্কি, মোগল, ইরানি) কারণে বাংলার এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতি হয়েছে জটিলতার। শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকালে এসে বাঙালির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; তার আগে পর্যন্ত এ দেশের মুসলমান সমাজে উর্দুভাষীদেরই নেতৃত্ব ছিল। জননেতা হিসেবে শেরে বাংলার উত্থানের সময় থেকেই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে থাকে, যদিও তখনও নওয়াব সলিমুল্লাহ থেকে খাজা শাহাবুদ্দিন পর্যন্ত অনেকের প্রভাবই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথাও ভারতীয় সমাজের উন্নতির পথে মৌলিক অন্তরায়।
ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের অবনতি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, পাকিস্তান আন্দোলন ইত্যাদি সব ঘটনাতেই বহিরাগত মুসলমানদের প্রবাসী মানসিকতা আর দেশীয় মুসলমানদের আত্মবিস্মৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শুধু ধর্মের পার্থক্য এবং ধর্মকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক ব্যবধান এত সব জটিল ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে পারত না। একটা এথনিক বৈষম্যের ব্যাপার ছিল। ব্রিটিশ-ভারতে এবং ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় এই এথনিক ব্যবধান- একদিকে বহিরাগত মুসলমানদের প্রবাসী কর্তৃত্ববাদী আভিজাত্যবাদী মানসিকতা এবং অপরদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা হিন্দু-মুসলিম বিরোধকে তীব্র করেছে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে রাষ্ট্রভাষা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের এই জটিলতার কারণেই ব্রিটিশ শাসন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারাকে ব্যবহার করা হয়েছে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টির ধারালো হাতিয়ার রূপে। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুকে মুসলমানদের ওপর বিজয়ী করার কথা ভাবেনি; তিনি ভেবেছিলেন ভারতবাসীকে বিদেশি অভিযানকারী, আক্রমণকারী ও উপনিবেশকারীদের ওপর জয়ী করে স্বাধীনতার যোগ্য করতে। তাঁর চোখে ছিল ইংরেজদের উপনিবেশবাদী শাসন থেকে মুক্তির স্বপ্ন; ‘ভারতবাসী’ এবং ‘হিন্দু’ কথা দুটোকে হয়তো তিনি সমার্থক মনে করতেন। ইংরেজ শাসকদের যেমন তিনি ভারতবাসী মনে করেননি তেমনি মনে করেননি তুর্কি-মোগল শাসকদেরও।
পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বেলায় মাতৃভাষা বিতর্ক ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর রূপান্তরিত হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্কে। বাংলাদেশে এমন লোক হয়তো আজো আছেন যাঁরা মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি থেকে মিরজাফর পর্যন্ত কিংবা কুতুবুদ্দিন আইবেক থেকে বাহাদুর শাহ পর্যন্ত শাসক আমলা, সৈনিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিজেদের রক্ত সম্পর্ক প্রমাণ করতে তৎপর। মধ্যযুগের আধিপত্যবাদী মানসিকতার অবশেষ আজো আছে। হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা হিন্দু জনসাধারণের বিকাশের সম্ভাবনাকে দলন করছে।
ইতিহাসের এসব জটিল বিষয় আমাদের দেশে সবচেয়ে অবহেলিত ও অনালোচিত থাকছে। গত পনের বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিদ্ব›দ্বী গোষ্ঠী একে অন্যের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ তুলে চিৎকার করছে এবং অভিযোগকারীরা নিজেরাও স্বকপোলকল্পিত ইতিহাস প্রচার করছে। সকলেই দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখছে ১৯৭১ সনের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক কিছু ঘটনাতে। পেছনে গেলে তারা বড়জোর ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গিয়ে থাকে। আমাদের জাতির ইতিহাস এত অল্প সময়ের নয়। অতীতে বিভিন্ন ঐতিহাসিককালে এই জাতির জীবনে ভালো-মন্দ বহু রকম ঘটনা ঘটেছে। সেই সমস্ত ঘটনাকে বাদ দিয়ে কেবল একটি ঘটনাতে সমস্ত মনোযোগ সীমাবদ্ধ রাখা একটি জনগোষ্ঠীর পক্ষে আত্মঘাতী ব্যাপার। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে ইতিহাস অনুশীলনে অগ্রসর না হয়ে আমরা ইতিহাসচেতনাহীন মনের পরিচয় দিচ্ছি। ১৯৭১-এর ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতি বছর আনাড়ি লেখকদের আন্তরিকতাহীন যে বিপুলসংখ্যক পুস্তকাদি প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলো দ্বারা আমাদের কি কল্যাণ হচ্ছে? আজকের পরিস্থিতিতে বঙ্কিমচন্দ্রের শতাধিক বৎসর আগের আহ্বান স্মরণ হয় :
বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালি কখনো মানুষ হইবে না। যাহার মনে থাকে যে, এ বংশ হইতে কখনো মানুষের কাজ হয় নাই তাহা হইতে কখনো মানুষের কাজ হয় না। তাহার মনে হয় বংশে রক্তের দোষ আছে। তিক্ত নিম্ববৃক্ষের বীজে তিক্ত নিম্বই জন্মে, মাকালের বীজে মাকালই ফলে। যে বাঙ্গালিরা মনে জানে যে, আমাদিগের পূর্বপুরুষ চিরকাল দুর্বল- অসার, আমাদিগের পূর্বপুরুষদিগের কখনো গৌরব ছিল না, তাহারা দুর্বল অসার গৌরবশূন্য ভিন্ন অন্য অবস্থা প্রাপ্তির ভরসা করে না, চেষ্টাও করে না। চেষ্টা ভিন্ন সিদ্ধিও হয় না।….
বাঙ্গালার ইতিহাস নাই, যাহা আছে তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙ্গালার বিদেশি বিধর্মী অসার পরপীড়কদিগের জীবনচরিত মাত্র। বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালি তাহাকেই লিখিতে হইবে। ….
আইস, আমরা সকলে মিলিয়া বাঙ্গালার ইতিহাসের অনুসন্ধান করি। যাহার যতদূর সাধ্য সে ততদূর করুক; ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে। একের কাজ নয়, সকলে মিলিয়া করিতে হইবে।
গত একশ বছরে বাঙালির ইতিহাসের চর্চা অনেকখানি হয়েছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চার নামে চলছে অতীতচারিতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। ইতিহাসে অতীতের বিষয় নাড়াচাড়া করা হলেও প্রকৃত ঐতিহাসিকের থাকে সুদূরপ্রসারী প্রখর ভবিষ্যৎদৃষ্টি। বাংলাদেশে আজকাল ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রচিত হচ্ছে প্রচুর পুস্তকাদি। এইসব ব্যবসায়িক সামগ্রী দিয়ে ইতিহাসের প্রয়োজন একটু মেটে না। এগুলো দ্বারা জাতির আত্মা বিকারপ্রাপ্ত এবং পরিবেশ কলুষিত হয় মাত্র।
পৃথিবীব্যাপী এখন গণবিরোধী শক্তির প্রবলতর অভিযাত্রা চলছে। এতে গণজাগরণের ধারা শেষ হয়ে গেছে। এই অভিযাত্রার বিরুদ্ধে গণজাগরণের ও জনগণের জয়যাত্রার সূচনা করতে হবে। এর জন্য ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন আছে। সৃষ্টিশীল কর্মমুখী ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন অন্তহীন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়