ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধ ও তরুণ প্রজন্ম

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন; হানাদারদের লজ্জায় ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন; সারাদেশে রাজাকারদের নিত্য হামলার কবল থেকে শহর-গ্রামগঞ্জের নিরীহ মানুষকে বাঁচিয়েছেন; আলবদর-আলশামসের নৃশংস অত্যাচার আর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বধ্যভূমিতে হাত-পা বেঁধে ফেলে দেয়ার বর্বরতা থেকে রেহাই দিয়েছেন। বিজয়ের মাসটি আরো কয়েকটি কারণে আনন্দের। যে রেসকোর্স ময়দানের কালীমন্দিরে হানাদাররা অগণিত নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সে মন্দিরের পাশেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তখনকার সময়ে বিশ্বের চৌকশ সেনাবাহিনী হিসেবে পরিচিত হানাদার বাহিনীর পঁচানব্বই হাজার সেনা অসম্মানজনকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে; মাথা নিচু করে ব্যারাকে ফিরে গিয়েছে; ধুলায় ভূলুণ্ঠিত হয়েছে দম্ভ। আর দেশের শ্রেষ্ঠ সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল উঁচিয়ে দম্ভভরে ঢুকেছে তাদের অহংকার নিজেদেরই তৈরি নতুন রাষ্ট্রের রাজধানীতে। বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে একটি নতুন পতাকা, একটি পরিবর্তিত বিশ্বমানচিত্র।
বিজয় এমনি এমনি অর্জিত হয়নি। আজকের তরুণ প্রজন্মের জানা দরকার বিজয়ের পেছনের রক্তক্ষরা দিনগুলোতে কী ঘটানো হয়েছিল সারা বাংলার বুকে। পাকিস্তানি সামরিক সরকার চেয়েছিল কতভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) শোষণ করা যায়, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়, পূর্বের সম্পদ পশ্চিমে নিয়ে নেয়া যায়, সিভিল সার্ভিস থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন সরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এমনকি বাঙালিদের মুখের ভাষা, প্রিয় বাংলা ভাষাকে বিলীন করে দিয়ে তার স্থলে পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্তে মেতে ওঠে। এমন সব ফন্দি আঁটা হয়েছিল যাতে রাজনীতিও বাংলার মানুষের নাগালের বাইরে থাকে। বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে হাল না ধরলে এবং দিকনির্দেশনা না দিলে এ দেশের রাজনীতি কোথায় যে হারিয়ে যেত তা ভাবতেও ভয় হয়। পাকিস্তানি শাসকরা চক্রান্ত করেই সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়নি। ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে তারা টালবাহানা করতে করতে শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের রুখতে না পেরে শাসকরা হঠাৎ করেই একাত্তরের ২৫ মার্চের রাত ১২টার পর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে ঢাকাসহ সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে। প্রথম আক্রমণ চালায় বাঙালি পুলিশ অধ্যুষিত রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে; নির্মমভাবে হত্যা করে ঘুমন্ত পুলিশদের। একই সঙ্গে আক্রমণ চালায় জ্ঞানচর্চার রাজ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কয়টা আবাসিক হলে। উপাসনালয়কেও বাদ দেয়নি। সারা ঢাকা শহরে যাকে সামনে পেয়েছে, যাকে পেয়েছে বাড়িতে-দোকানে কিংবা অফিস-আদালতে তাকেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। তাণ্ডব চালিয়েছে সারাদেশে। সে রাতে অপারেশনস সার্চলাইট নামক অভিযানে সমগ্র দেশে এক লাখেরও বেশি মানুষকে তারা হত্যা করে। পরবর্তী দিনগুলোতে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী আর আলশামস বাহিনী গঠন করে নারী নির্যাতন, নির্যাতন-পরবর্তী হত্যা, বাঙালিদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া, ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দেয়া, রেললাইন ধ্বংস করে দেয়া, রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে যাতায়াত কঠিন করে ফেলা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনাসহ সব বড় নদীতে টহল বোট দিয়ে নদীপথে যাতায়াতে বিঘœ সৃষ্টি, বাঙালিদের দোকানপাট-বাড়িঘর লুট, যুবকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলা, তরুণীদের হানাদারদের ক্যাম্পে নিয়ে সেনাদের হাতে তুলে দেয়াসহ অনেক অকথিত অত্যাচার চালিয়ে দেশটাকে আমাদের কাছে পরদেশি করে তোলা হয়। পুরো নয় মাস ধরে চালানো গণহত্যা বাংলাদেশে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করে। দেশ স্বাধীন না করতে পারলে তাদের হাত থেকে মুক্তির কোনো উপায় থাকবে না- এই অনুভূতি যখন সব বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গেল, তখন তরুণরা কেউ সশস্ত্র যুদ্ধে, কেউ কেউ গেরিলা যুদ্ধে আবার কেউ বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকায় নেমে পড়লেন। শুরু হয়ে গেল আধুনিক সমরাস্ত্রসমৃদ্ধ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র বাঙালির অসম যুদ্ধ।
স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর পার হয়ে গেল। মনে শঙ্কা অনেক। অনেক দামে কেনা স্বাধীনতা কি একাত্তরের অপশক্তির হাতে লাঞ্ছিত হবে? তখনকার কুচক্রী আর তাদের পরবর্তী বংশধররা চুপচাপ বসে নেই। জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস, পুলিশের ওপর আচমকা আক্রমণ, শহরের এখানে-সেখানে হঠাৎ বোমা ফাটানো ইত্যাদি ঘটনা শঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। এদের হাত থেকে দেশটাকে রক্ষা করতে পারে তরুণ প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তরুণ প্রজন্মকে বলি, তোমরা কখনো কল্পনাও করতে পারবে না কী রকম অচিন্তনীয় মানবতা-বিধ্বংসী নৃশংসতার মধ্য দিয়ে তোমাদের বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন এবং দেশবাসী দিনাতিপাত করেছে। আর এ নৃশংসতা ঘটিয়েছিল যতটা না হানাদার বাহিনী, তার চেয়ে বেশি করেছিল এ দেশীয় বেইমান জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীরা। এসব ঘৃণ্য নরকীটরা নিজ দেশের এত বড় ক্ষতি করেছে, যা তোমাদের কল্পনারও বাইরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা সদম্ভে অহংকারের সঙ্গে ‘তারা যা করেছে তাতে কোনো ভুল ছিল না’ ধরনের মন্তব্যই শুধু করেনি, তারা কৌশলে পঁচাত্তর-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ করেছে, দেশের মানচিত্র খচিত পতাকা গাড়িতে ব্যবহার করে পতাকার সম্মান ভূলুণ্ঠিত করেছে, মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে লুটপাট করে অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটিয়েছে, বঙ্গভবন আর গণভবনকে অপবিত্র করেছে। সর্বোপরি, দেশটাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের মতো অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি টিকে থাকার মতো রাষ্ট্র নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ় নেতৃত্ব আর প্রজ্ঞার সঙ্গে দেশ পরিচালনার ভার স্কন্ধে না তুলে নিলে এ দেশটি হয়তো কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না।
তোমরা ভেবে দেখ, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেঁচে থাকা মানুষগুলো চলে যাওয়ার পর কেউ তোমাদের স্বচক্ষে দেখা আর নিজ কানে শোনা অভিজ্ঞতা শোনাতে আসবে না। তোমরা জামায়াতে ইসলামীর নৃশংসতার কথা ভুলে যেও না, বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যার কথা বিস্মৃতির অতলে ঢেকে দিও না, তোমাদের পূর্বপুরুষদের উদোম গায়ে নির্যাতন করে হত্যার বিষয়টি শুধু বইপত্রের পাতায় আটকে রেখো না, তাদের আস্ফালনের বিকট হাসি অবহেলার চাদরে ঢেকে রেখো না। কালের বিবর্তনে মানুষ অনেক দুঃসহ যন্ত্রণা-বঞ্চনা-দুঃখ-কান্না-বেদনার কথা ভুলে যায়। তোমরা তেমন হয়ো না। সবকিছু তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে নিজকে সত্যিকারের দেশপ্রমিক সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যেয়ো। স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় অর্ধশতক পরে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে এমনটি প্রত্যাশা করা কি বেশি কিছু?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়