ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

বাঙালি সংস্কৃতির প্রবহমানতা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় বাঙালি জাতিসত্তা ও বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ তুলে ধরতে হলে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির অর্থ কী তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কিছু শব্দ আছে যাদের সংজ্ঞা অথবা ব্যাখ্যা নিরূপণ করা ভীষণ কঠিন। ‘সংস্কৃতি’ হচ্ছে ঠিক তেমন একটি শব্দ যার ব্যাপকতা এত বিস্তৃত যে এক কথায় এর ব্যাখ্যা অসম্ভব ব্যাপার। প্রবীর ঘোষ তাঁর ‘সংস্কৃতি : সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সংস্কৃতি শব্দটি আজ নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে বাংলা শব্দ জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। তবু এরপর সত্যের খাতিরে বলতেই হয় যতই ব্যবহারে ব্যবহারে ব্যবহৃত হতে হতে সংস্কৃতি শব্দটি প্রচলিত হয়ে উঠুক না কেন, শব্দটির প্রকৃত অর্থ আজও এক ঘেরাটোপে বন্দি হয়েই রয়েছে।’ তার মতে মানুষের সৃষ্টি সবকিছুই হলো সংস্কৃতি। তিনি এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘একটি জনগোষ্ঠী তৈরি জীবনযাত্রার প্রণালি, ছক, আচরণবিধি, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, ভাষা, শিক্ষা, ক্রীড়া, সংগীত, অবসর যাপনের পদ্ধতি, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান, শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম-বিশ্বাস, সামাজিক উৎসব, সমাজিক বন্ধন ও বিচার পদ্ধতি ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মধ্যে যুক্তিযুক্ত এবং যুক্তিবিরোধী, ভালো, খারাপ, জ্ঞান এবং অজ্ঞানতা সবই থাকতে পারে, মিলে মিশেই থাকতে পারে এবং থাকেও। ড. পবিত্র সরকার তার ‘লোক ভাষা লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলেন, ‘মানুষ আসার আগে পৃথিবী যে অবস্থায় ছিল, আর মানুষ আসার পর পৃথিবী যে অবস্থায় দাঁড়াল -এই দু’য়ের তফাৎ হলো সংস্কৃতি, বাকিটা হলো প্রকৃতি।’ সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রবীর ঘোষ এবং ড. পবিত্র সরকারের ধারণার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে। সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সন্জিদা খাতুন তার ‘সাংস্কৃতিক মুক্তি সংগ্রাম গ্রন্থে’ ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এ বিধৃত অতিরিক্ত অর্থটির উল্লেখ করেন। এ অভিধানে অতিরিক্ত আর এক অর্থ হলো- ‘সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ’। গোপাল হালদার তার ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ গ্রন্থে বলেন, ‘মানুষের জীবন-সংগ্রামের বা প্রকৃতির ওপর অধিকার বিস্তারের মোট প্রচেষ্টাই হচ্ছে সংস্কৃতি …. জীবিকার প্রয়াসে মানুষ যেমন অগ্রসর হয় সংস্কৃতিরও তেমনই পরিবর্ধন ঘটে, পরিমার্জনও হয়, অর্থাৎ তার পরিবর্তন চলে।’
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সব কর্মকাণ্ডই সংস্কৃতির উপাদান। এ প্রপঞ্চটি নদীর মতো বহমান। নদী যেমন তার আপন খেয়ালে এঁকে-বেঁকে বয়ে যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির অনেক উপাদানের পরিবর্তন ঘটে। ‘সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ’- এই শব্দগুচ্ছটির মধ্যে পরিবর্তনশীলতার একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। গোপাল হালদার তার গ্রন্থে সংস্কৃতির রূপান্তরের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সংস্কৃতির মূল উপাদানগুলো যা দ্বারা একটি জাতি-গোষ্ঠীর মূল কাঠামো গড়ে ওঠে তা সাধারণত পরিবর্তন হয় না। অথবা পরিবর্তন হলেও তা খুব ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়। এ প্রসঙ্গে হায়াত মাহমুদ ‘সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে বলেন, ‘মানুষ বা তার সমাজ যদি চলিষ্ণু থাকে, অনড় না হয়, তার ধর্ম যদি হয় পাল্টাতে পাল্টাতে বিকশিত হওয়া, তা হলে সংস্কৃতি নামক ব্যাপারটিও কখনো পরিবর্তনের অতীত হতে পারে না। এবং সত্যিই তা তো অপরিবর্তনীয় নয়- না বাঙালির সংস্কৃতি না অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। ব্যক্তিমানুষ বা তার গোষ্ঠীজীবন তথা সমাজজীবন কখনো এক জায়গায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকেনি। তাহলে সভ্যতার বিকাশ ঘটত না- কথা কে না জানে? তাই সংস্কৃতি প্রসঙ্গে শুধুই ওটুকু বললে বস্তুত কিছুই বলা হয় না, কিছু প্রমাণিতও হয় না, শুধুমাত্র নেতিপন্থা বা নৈরাজ্যবিশ্বাস ছাড়া। কেননা, সময়স্রোতে ক্রমপরিবর্তমান সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো কোনো জনগোষ্ঠী বা জাতির সংস্কৃতি বিচারে দৃষ্টিকোণ বা সূচক হতে পারে না। সভ্যতার অগ্রগতিতে ‘মানুষ’ ক্রমেই পাল্টেছে বললে আমরা যেমন বুঝি না যে মনুষ্য নামক প্রাণীর দেহে জীবাত্ত্বিক কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে , সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বুঝি ঠিক তেমনিভাবেই। অর্থাৎ মূল বিবেচ্য হলো শরীর কাঠামো বা গঠন বিন্যাস। কাফ্কা বর্ণিত মেটামরফসিস-জাতীয় ঘটনা ঘটলেই শুধু বলা যেতে পারত- এতদিন আগে মানুষ একরকম ছিল, এতদিন পর একরকম হয়েছে। তা তো হয়নি, মানুষ যা ছিল তাই আছে। অনুরূপভাবে সংস্কৃতি বিচারের ক্ষেত্রেও মৌল কাঠামোর ব্যাপারটিই জরুরি। যে কোনো সংস্কৃতির চিরস্থায়ী বা চিরায়ত রূপ চেনা যায় ওই মৌল কাঠামো দিয়েই।
গৌড়, রাঢ়, হরিকেল, সমতট এবং বঙ্গে আর্য-অনার্য, শক, হুন, দ্রাবিড়, হিন্দু, বৌদ্ধ-জৈন, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ গোত্র এবং নৃতাত্বিক গোষ্ঠী ও শাখা গোষ্ঠীর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় ও সংমিশ্রণের ফলে গড়ে ওঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি-বাঙালি সংস্কৃতি। ১৩৫০-এর দশকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দী ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও জয় করে ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ উপাধি ধারণ করে শাসনভার গ্রহণ করলে বৃহত্তর ‘বাঙ্গালা’র জন্ম হয় বলে ধারণা করা হয় এবং মোটামুটি ওই সময়ে বাংলা ভাষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করার পক্ষে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু এই অঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে হাজার হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে। বাংলা ভাষার মূল শেকড় প্রোথিত অনেক গভীরে। মাগধী প্রকৃত থেকে এ ভাষার উৎপত্তি। জীবন-জীবিকা সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ। পলি বিধৌত এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকে ধান চাষের প্রচলন ছিল। এ অঞ্চলে কৃষিনির্ভরতা ছিল অনেক আগে থেকেই। কৃষিকাজই ছিল মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম। বিভিন্ন ধর্মের আগমনে আদি বাঙালি সংস্কৃতি তার রূপ পরিবর্তন করেছে ঠিকই; কিন্তু এই সংস্কৃতি এতটাই শক্তিশালী যে, মিথস্ক্রিয়ার ফলে এর মূল উপাদান এবং কাঠামো কখনো বিনষ্ট হয়নি। বাঙালি সংস্কৃতি পরাজিত হয়নি।
বাঙালি সংস্কৃতি বিভিন্ন সময়ে আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছে কিন্তু বাঙালিদের বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং দেশাত্মবোধের কারণে সেই আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদীরা সফল হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠী এ জনপদের মানুষকে পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ করার অশুভ উদ্দেশ্যে বাঙালি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফা, ‘সংস্কৃতির জীয়নকাঠি’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ‘পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পদে পদে বাংলার সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত করেছে। ঐতিহ্যের কোল থেকে সবলে ছিনিয়ে এনেছে বাংলার সংস্কৃতি এবং সবসময় চেয়েছে একটি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক খাতে গোটা জাতির চেতনা প্রবাহিত হোক।’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় উৎপাটনের পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। পূর্ব-পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিম লীগ নেতা একই মত দিলেও কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি জানান, যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায় পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠী। এই পরিকল্পনার বিরূদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিশ প্রতিবাদ জানায়। গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম’ পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সে দিন সচিবালয়ের ছাত্র ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো তিনি গ্রেফতার হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাহসী উচ্চারণই ছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। সাংস্কৃতিক চেতনায় উজ্জীবিত হলেই সৃষ্টি হয় দেশাত্মবোধ।
বল প্রয়োগ করে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংস্কৃতির গতিপথকে কখনো পরিবর্তন করা যায় না। সংস্কৃতির বাহ্যিক যে রূপান্তর ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর উর্দু-বাংলা মিশিয়ে একটি ভাষা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব, ১৯৬৭ সালে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। শুধু তাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতিকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের এপ্রিল থেকে ‘মাসিক নও’ নামক একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো পাকিস্তানি সংস্কৃতি এবং সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে উৎসাহ জোগাতে। উর্দু, ফারসি, আরবি ও তুর্কি মিশ্রিত এক স্বতন্ত্র ধারার মুসলমানি বাংলা ভাষা প্রচলনের চেষ্টা হয় এই পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। সব বাধাকে উপেক্ষা করে বাঙালি সংস্কৃতি তার আপন মহিমায় হয়েছে ভাস্বর।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তনের ছাত্রসভায় তৎকালীন গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন, রক্তদিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা, ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পেছনে রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির চেতনাবোধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ‘সাংস্কৃতিক মুক্তি’র বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়