ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

বাংলাবর্ষ গণনা ‘মুজিবাব্দ’ এবং নববর্ষ উৎসব পহেলা ফাল্গুন প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাণ বলিদানে আমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি বাঙালি। পৃথিবীতে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বাঙালি সভ্যতা বিনির্মাণের জন্য আমাদের মাঝে তাগাদা ও প্রত্যয় সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে একটি বর্ষপঞ্জি। তাই আমাদের পূর্বপুরুষদের ঘাম ও রক্তের সুঘ্রাণে মিশ্রিত ইতহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক একটি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন ও প্রস্তাব করছি।
বর্ষপঞ্জিটির নাম ‘বাংলা বর্ষপঞ্জি’ এবং বছর বা অব্দ গণনার নাম ‘মুজিবাব্দ’ (মুজিব+অব্দ)। মুজিবাব্দের প্রধান ভিত্তি ৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। অব্দ গণনা কার্যকর করা হয়েছে বাংলাভাষা ও বাঙালি জাতির অঙ্কুরোদগম এবং বিকাশ পর্ব ৪০০ খ্রিস্ট অব্দ থেকে। ৭ মার্চকে প্রধান ভিত্তিগণ্য করে মুজিবাব্দের বর্ষগণনা শুরু- ফাল্গুন মাস ও ঋতুরাজ বসন্তকালের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুন। প্রধান ভিত্তি ৭ মার্চের সাথে সহযোগী ভিত্তি গণ্য করা হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২, ৩, ১১, ১৭ ও ২৬ মার্চ, ১০ এপ্রিল, ১৭ এপ্রিল এবং ১৬ ডিসেম্বর। মুজিবাব্দ গণনাপঞ্জিটি- উক্ত ঘটনাগুলোর সংগঠক ও অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ এবং উৎসর্গ সেইসব গর্বিত উত্তরাধিকারীকে যাদের পূর্বপুরুষদের ত্যাগে-শ্রমে জন্মেছে বাংলাভাষা-বাঙালি জাতিসত্তা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আরো উৎসর্গ বর্তমান ও অনাগত দিনের সেইসব বাঙালিকে যাদের হাতে গড়ে উঠবে বাঙালি সভ্যতা।
একটি বর্ষপঞ্জি প্রচলন করতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যেমন-

১. বর্ষপঞ্জিটির গণনা অব্দের নাম কি হবে? ২. বর্ষপঞ্জিটির ভিত্তি কি হবে? ৩. কখন থেকে বর্ষপঞ্জিটির অব্দ গণনা কার্যকর করা হবে? ৪. বর্ষপঞ্জিটির বর্ষশুরুর মাস কি হবে? ৫. বর্ষবরণ উৎসব কবে এবং কেমন হবে? ৬. বর্ষপঞ্জিটির গণনা পদ্ধতি কি হবে? ৭.বর্ষপঞ্জিটির মাস ও সপ্তাহের দিনের নাম কি হবে? ৮. বর্ষপঞ্জিটির মাস সপ্তাহ ও দিনের সংখ্যা কত হবে।

নতুন এ বর্ষপঞ্জিটির মাস-দিন-সপ্তাহ
এখানে আলোচিত চারটি (খ্রিস্টাব্দ, হিজরি, বাংলা ও শকাব্দ) বর্ষপঞ্জিসহ যতগুলো বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে জানা যায় তাদের মাস ১২টি এবং চন্দ্র বর্ষ হলে দিন ৩৫৪-৩৫৫ এবং সৌর বছর হলে দিন ৩৬৫ এবং অধিবর্ষে ৩৬৬ দিন। যদিও পৃথিবীর আদি ক্যালেন্ডার রোমানদের প্রথম ক্যালেন্ডারে মাস ছিল ১০টি। কিন্তু সেটি তারা নিজেরাই সংশোধন করে ১২টি মাস নির্ধারণ করেছে। আমাদের অঞ্চলেরই অধিবাসী, বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহি’র জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তেও বছরে ৩৬৫ দিন, অধিবর্ষ ৩৬৬ দিনে, বছরে ১২ মাস, মাসে ২৯-৩২ দিন, সপ্তাহে ৭ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষ তারার অবস্থান ও গ্রহ-উপগ্রহের নামানুসারে ১২ মাস ও ৭ দিনের নামকরণ করা হয়েছে।
সপ্তাহে ৭ দিনের নাম : শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার।
এই নতুন বর্ষপঞ্জিটিতে সূর্যসিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং বর্তমানে আমাদের প্রচলিত নিয়মে বছরে ৩৬৫ দিন, অধিবর্ষে ৩৬৬ দিন, বছরে ১২ মাস, সপ্তাহে ৭ দিন এবং মাস ও সপ্তাহে দিনের নামগুলো একই থাকবে। অর্থাৎ মাসের নাম : ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ।
তবে মাসের দিনের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সর্বশেষ সংশোধনী গ্রহণ করা হবে- অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে হবে; তবে অধিবর্ষে (লিপইয়ার) ফাল্গুন মাস ৩০ দিনে হবে। বছরের দ্বিতীয় মাস চৈত্র মাস ৩০ দিনে; বছরের তৃতীয় মাস বৈশাখ থেকে আশ্বিন এই ছয়টি মাস ৩১ দিন এবং কার্তিক থেকে মাঘ এই ৪টি মাস আবার ৩০ দিনে হবে।
বর্ষপঞ্জিটি গণনা পদ্ধতি :
সূর্যসিদ্ধান্ত মোতাবেক আগে ভারতের জাতীয় সন শকাব্দ এবং আমাদের বাংলা বর্ষ নিরায়ন পদ্ধতিতে গণনা করা হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৯৫৭ সালে শকাব্দ এবং ১৯৬৬ সালের প্রস্তাব মতে বাংলাবর্ষ মাস ভিত্তিক ঋতুবৈচিত্র্য ধারণ করতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং গৃহীত গ্রেগোরীয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বর্ষগণনায় সংক্রান্ত বা সায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। এই বর্ষপঞ্জিটি বর্ষগণনার পদ্ধতি সায়ন পদ্ধতি হোক।

বর্ষপঞ্জির গণনা অব্দের ভিত্তি :
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে এই নতুন বর্ষপঞ্জিটির ভিত্তি কি হবে? বর্তমানে প্রচলিত কোন মৌলিক ভিত্তিহীন বর্ষপঞ্জির পরিবর্তে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করার ক্ষেত্রে আমি চোখ ফেরাতে চাই আমাদের পরিচয়ের অর্থাৎ আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মৌলিক জায়গাগুলোতে। আর সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সাল হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময় (বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরিতে খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ করা হচ্ছে এই জন্য যে, আমাদের মাঝে বর্তমানে এটাই প্রচলিত)। প্রায় দেড় হাজার বছরের নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে, অসংখ্য ভিনদেশী, ভিনভাষী শাসকদের শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ভার নিজেদের হাতে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই বছরের মার্চ মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ২, ৩, ৭ ও ২৬ মার্চ, ১০ এপ্রিল, ১৭ এপ্রিল এবং ১৬ ডিসেম্বর অন্যতম। এগুলোর মধ্যে ‘২৬ মার্চ : স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ হিসেবে এবং ‘১৬ ডিসেম্বর : বিজয় দিবস’ হিসেবে পরিপূর্ণ মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। ১০ ও ১৭ এপ্রিল সরকার বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকার মোটামুটি পালন করলেও সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন কোন প্রভাব বোঝা যায় না। ২ ও ৩ মার্চ এর গুরুত্ব আজ মানুষ তেমনভাবে বুঝতে চায় না বা বোঝানোও কষ্ট। এই দুটি দিনের গুরুত্ব কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, অন্য নেতৃবর্গ এবং সেই সময়টি বুঝতে পেরেছে। ইতিহাস এগুলোকে ধারণ করে আছে কিন্তু গুরুত্বটুকুকে হয়তো সেইভাবে বহন করে আনতে পারেনি। এমনকি এই দুটি দিনের যেসব লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী ছাত্র-জনতা তারা সকলেও হয়তো বুঝতে পারেননি যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতার ইশারায় একদল তরুণ ছাত্র নেতাদের নেতৃত্বে কোনো ইতিহাস আগমনের পথ তৈরি করেছেন। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি দিনও কেবল ক’জন ব্যক্তি, ক’টি সভা-সেমিনার, কিছু পোস্টার আর পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের কিছু খবরের মধ্যে সীমিত।
ইতিহাসের আরেকটি দিন ৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। এই দিনটির গুরুত্ব এতই বেশি, দিনটি এতই তাৎপর্যবহ যে, কোন দল বা ব্যক্তি, কোন কমান্ডার, দিনটিকে গুরুত্ব দিতে চায় বা না চায়, কেউ সেখানে থাকতে পেরেছিল কি পেরেছিল না, কেউ কোনো কথা বেশি বা কম শুনেছিল, কেউ দিনটিকে পালন বা মূল্যায়ন করতে অস্বীকার বা অপারগতা দেখাক না কেন …. কোন কিছুই দিনটির কাছে বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় বরং যে বা যারা এমনটি করতে চাইবে তারাই দিনটির গুরুত্বের গভীরতার অতল গহ্বরে পড়ে থাকবে। তারা এত নিচে চাপা পড়ে থাকবে যে, তাদের পঁচা দুর্গন্ধটুকুও কোন কালে উপরে ভেসে আসবে না। ইতোমধ্যে ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীর ইতিহাসে তিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ একশত রাজনৈতিক ভাষণের মধ্যে গণ্য হয়েছে। ভাষণটির মধ্যে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যসহ ভবিষ্যৎ পথ চলার নির্দেশনা রয়েছে। ভাষণটির মধ্যে একটি রাষ্ট্র ও জাতির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর ইঙ্গিত ও নির্দেশনা রয়েছে। এই ভাষণটিতে এত মানুষ উপস্থিত হয়েছিল সেটা হয়তো জনসংখ্যার অনুপাতে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্ববৃহত্তম জনসভা। ভাষণটি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে যে আবেগ ও আগ্রহ ধরে রেখেছে, হয়তো অন্য কোনো রাজনৈতিক ভাষণে এতটা হয়নি। সময় ও জনসংখ্যা অনুপাতে এখন পর্যন্ত ভাষণটি এত মানুষ এত বেশিবার শুনেছে সেটা হয়তো অন্য কোন ভাষণের ক্ষেত্রে হয়নি। আমার মনে হয়- সময় প্রেক্ষাপট এবং প্রভাব বিচার করলে ভাষণটি কেবল তিন হাজার বছরের ইতিহাসে সেরা একশটি ভাষণের তালিকায় স্থান নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জিটির জন্য প্রধান ভিত্তি বিবেচনা করছি- ৭ মার্চ ১৯৭১ সাল।
বর্ষপঞ্জিটির অব্দ গণনা কখন থেকে কার্যকর করা হবে :
এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, বর্ষপঞ্জিটির গণনা কখন থেকে কার্যকর করা হবে। বর্ষপঞ্জিটি নিয়ে প্রথম যখন ভাবি তখন মনে হতো ৭ মার্চ অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে গণনা কার্যকরের কথা। কিন্তু তাতে মন সায় দেয় না। কেননা এতে করে বর্তমানে এই বর্ষপঞ্জিটির বয়স দাঁড়াবে মাত্র ৪৫ বছর। সেটি একেবারেই শিশু পর্যায়ের বর্ষপঞ্জি হয়। যেটি আমাদের হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে বেড়ে ওঠা জাতিসত্তার পূর্ণ পরিচয় ধারণ করতে পারবে না। সুতরাং বিচার-বিশ্লেষণ পূর্বক এমন একটি সময় থেকে বর্ষপঞ্জিটির গণনা কার্যকর করতে হবে যাতে করে মূলত ভাষা ভিত্তিক ভূখণ্ডে গঠিত রাষ্ট্রে বাঙালি জাতিসত্তা ও বাংলাদেশের একটি পরিচয় ফুটে ওঠে। সেজন্য তেমন একটি সময় খুঁজতে পেছনের দিকে চোখ ফেরাই। আমরা মূলত প্রাচীন ভারতীয় বা ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসী। আমরাও সিন্ধু ও মৌর্য সভ্যতার গর্বিত অংশীদার এবং বঙ্গ অঞ্চলের অধিবাসী। আমরা প্রায় একই রকম সামাজিক রীতিনীতি এবং ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় রূপ পেয়েছি। কিন্তু সেটি সর্বশেষ ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মধ্য দিয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। আমাদের যেতে হয় অন্য একটি জাতি গোষ্ঠীর সাথে। কিন্তু মূলত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করা আমাদের গর্বের ভাষাটিই সেখান থেকে পৃথক হয়ে একটি স্বাধীন ও মর্যাদাশীল রূপ নিয়েছে।
নতুন বর্ষপঞ্জিটির বর্তমান কত অব্দ বা বর্ষ :
আমাদের ভিত্তি যেহেতু গ্রেগোরীয়ান বর্ষপঞ্জির ৭ মার্চ ১৯৭১ সাল এবং বর্ষগণণা শুরু জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি বা সংষ্কারকৃত গ্রেগোরীয়ান বর্ষপঞ্জির ৪০০ সাল থেকে। সুতরাং নতুন বর্ষপঞ্জিটির বতর্মান বর্ষ হবে- গ্রেগোরীয়ান বর্ষপঞ্জির ভিত্তি বছর সংখ্যা (১৯৭১, ৭ মার্চ থেকে ৪০০ বছর বিয়োগ করে উক্ত বিয়োগ ফলের সাথে ভিত্তি বছরের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত (অর্থাৎ ৭ মার্চ, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ) যতগুলো বছর অতিবাহিত হয়েছে সেটি যোগ করে উক্ত যোগ ফলের বছর সংখ্যা হচ্ছে নতুন বর্ষপঞ্জিটির বর্ষসংখ্যা। অর্থাৎ

৭ মার্চ (২৪ ফাল্গুন) ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ
(বিয়োগ) ৪০০ খ্রিস্টাব্দ
অতএব, (৭ মার্চ) ২৪ ফাল্গুন ১৫৭১ বাংলা অব্দ … ০১

আবার, গ্রেগোরীয়ান ক্যালেন্ডার
৭ মার্চ (২৪ ফাল্গুন) ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ
৭ মার্চ (২৪ ফাল্গুন) ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ
বিয়োগ করে ৪৫ বছর …. ০২

১ নং থেকে- ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১৫৭১ বাংলা অব্দ
২ নং থেকে- ১৯৭১ সালের পর ৪৫ বছর
সুতরাং বর্তমানে হবে ১৬১৬ বাংলা অব্দ বা বছর
সে মোতাবেক ২০২২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাবর্ষ হবে ১৬২২ মুজিবাব্দ।

নতুন বর্ষপঞ্জিটির বছর বা অব্দ গণনার নাম :
বর্তমানে প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জিটি সংস্কারপূর্বক যে নতুন রূপটি নিবে সেখানে বছর বা অব্দ গণনার নাম কি হবে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমানের ‘বঙ্গাব্দ’ নামটির নামকরণের কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও নামটি প্রাসঙ্গিক যদিও সেই ‘বঙ্গ’ অঞ্চলটি বিভক্ত হয়ে গেছে। তারপরও ‘বঙ্গ’ শব্দটির সাথে আমাদের ভালোলাগার একটি অনুভব জড়িয়ে থাকে। কিন্তু তারপরও বছর বা অব্দ গণনার জন্য ‘বঙ্গাব্দ’ নামটি পরিবর্তন করতে চাই। নামকরণের জন্য আমি ফিরে যেতে চাই সাধারণ মানুষের ভিড়ে। হাজার বছরেরও অধিক সময় ধরে অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে যাদের ত্যাগে-মহিমায় এই অঞ্চলটি একটি সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে অঞ্চলটির নামে একটি ভাষা সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে কেবল এই অঞ্চলটির নামে একটি স্বাধীন সার্বভোম রাষ্ট্রের নাম হয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে সেটিকে দেয়া হয়েছে একটি স্বতন্ত্র স্থান। দেয়া হয়েছে একটি নিজস্ব পতাকা। আর যুগে যুগে যেসব মহান বীরদের কল্যাণে এসব হয়েছে তাঁদের নামে অব্দ গণনার নামকরণ করা হলে ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’ অঞ্চল, ‘বাংলা ভাষা’ এবং ‘বাঙালিত্ব’ বা ‘বাঙালি জাতিসত্তা’ এক সাথে ফুটে উঠবে। সেক্ষেত্রে অসংখ্য মহান বীরদের ভিড় থেকে এমন একটি নাম নিতে চাই যে নামের মাঝে সব বীরদের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। তেমন একটি নাম চাইলে চোখে ভেসে ওঠে হিমালয়সম উচ্চতা, গাম্ভীর্য্য-বীরত্ব, দৃঢ়-অবিচল একটি নাম- মহান মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক, বাংলা ও বাঙালিত্বের প্রতিনিধি, ৭ মার্চের মহাকবি, মহাকালের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। আসলে, আমাদের জন্য শেখ মুজিব এখন আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। এটা একটা চেতনা ও আদর্শের নাম। এটা আমাদের প্রত্যয় ও প্রত্যাশার নাম। এটা আমাদের স্বপ্ন ও শপথের নাম। তাঁর জন্ম কেবল একটি দম্পতি থেকে নয়- বাঙালি জাতির হাজার বছরের মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকে। অসংখ্য বীরের ত্যাগ ও মহিমা থেকে। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রার্থনা ও আশীর্বাদ থেকে। তেমনিভাবে তিনি কেবল শেখ হাসিনা থেকে শেখ রাসেল এই পাঁচ জন সন্তানের জনকই নন তিনি একটি আদর্শের ধারক-বাহক, একটি জাতিসত্তা ও একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জনক। তিনি অসংখ্য বীরের জনক। কালের নাম না জানা সেইসব বীরপুরুষ থেকে শুরু করে হাজী শরীয়ত উল্লাহ্, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, প্রীতিলতা-ইলামিত্র, সূর্যসেন, জগদীশ, রবী-নজরুল, জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী হয়ে যেমন ‘শেখ মুজিব’ তেমনিভাবে শেখ মুজিব হয়ে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর, কামারুজ্জামান, সিরাজুল আলম, শেখ মনি, রাজ্জাক, তোফায়েল, নূরে আলম, রব, সিরাজ-মাখন, মনুমিয়া-আসাদ-মতিউর, বীরশ্রেষ্ঠ, বীর সংগ্রামী বীর যোদ্ধা, শেখ হাসিনা (নামটি এখানে জাতীয় চেতনা, অগ্রগতি ও অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত) যত বিজ্ঞানী যত গবেষক এবং অনাগত দিনের সব মহান ব্যক্তিত্ব। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে শুরু হওয়া বাঙালি জাতি ভবিষ্যতে পৃথিবীতে যতদিন টিকে থাকবে, অর্ধাৎ বাংলা ভাষা ও জাতির জন্ম থেকে শেষ মুহূর্ত এই পুরো সময়ের জন্য ৭ মার্চের শেখ মুজিব হচ্ছেন কেন্দ্রবিন্দু- বিজয়মঞ্চ। তিনি যেমন দেড় হাজার বছরের বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি; মুখপাত্র তেমনিভাবে ভবিষ্যৎ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ দিক নির্দেশক- অনুপ্রেরণা। কোন জাতি যদি তার ইতিহাস ঐতিহ্যকে নিবিড় মমতার সাথে প্রতিমুহূর্ত ধারণ করে রাখতে পারে তাহলে তাদের জয়রথ থামিয়ে রাখা যায় না। আমাদের সমস্ত বীরত্ব আর ইতিহাস-ঐতিহ্য এই নামটির সাথে মিশে গেছে। তাই এই একটি

নামকে ধারণ করে রাখলে আমাদের কোনো বীরদেরই আমরা ভুলে যেতে পারব না। কেননা এই নামটি আসলেই সেই সূত্রধরে আমরা সব যুগের সব বীর এবং সব ইতিহাস ঐতিহ্যের কাছে পৌঁছে যাবো। তাই বাংলা বর্ষপঞ্জিটির বছর বা অব্দ গণনার জন্য ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এই নামটিই বেছে নিলাম।
সংস্কারকৃত এই নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জির গণনা অব্দের নাম হতে পারে ‘মুজিবাব্দ’ (মুজিব অব্দ/মুজিব+অব্দ)। এবার প্রশ্ন আসে যে, ‘মুজিবাব্দ’ নামক বাংলা বর্ষপঞ্জিটির অধিবর্ষ এবং বর্ষশুরু মাস কোনটি হবে?
মুজিবাব্দের অধিবর্ষ :
খ্রিস্টাব্দের সাথে মুজিবাব্দ বিয়োগ করে বিয়োগফল মুজিবাব্দের বর্ষের সাথে যোগ বা মুজিবাব্দের বর্ষের সংখ্যাটির সাথে ৪০০ যোগ করে প্রাপ্ত ফলকে ৪ (চার) দ্বারা ভাগ করলে ভাগশেষ যদি ০ (শূন্য) থাকে তাহলে মুজিব অব্দের ঐ বর্ষ বা বছরটি অধিবর্ষ হবে। কিন্তু মুজিব অব্দের সাথে ৪০০ যোগ করে প্রাপ্ত ফল যদি ১০০ এর গুণিতক হয় তাহলে সেটিকে ৪০০ দ্বারা ভাগ করলে ভাগফল যদি শূন্য হয় তবে মুজিবাব্দের সেই বছরটি অধিবর্ষ।

মুজিবাব্দের বর্ষশুরু মাস ও নববর্ষ কবে হবে :
কেবল পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের নয় বরং পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিরই বিভিন্ন রকম উৎসব রয়েছে। তবে পৃথিবীব্যাপী যতগুলো সার্বজননীন উৎসব পালন করা হয়, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো উৎসব হলো ইংরেজি বর্ষবরণ উৎসব। এই উৎসবের সূচনা হয় আজ থেকে প্রায় ৪০০০ (চার হাজার) বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমিয়া যুগের মধ্যে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় বর্ষবরণ উৎসব পালন শুরু হয়। বেশ জাঁকজমকের সাথে পালন করা হতো বর্ষবরণ উৎসব। তবে সে উৎসব ১ জানুয়ারি বা ৩১ংঃ হরমযঃ এ পালন করা হতো না। তখন বর্ষবরণ উৎসব পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে।
বসন্তকাল, শীতকালের রুক্ষতাকে ঝেরে ফেলে প্রকৃতিকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলে। এই সময়ে গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা দেয়। এ সময় ফুলের কলিরা যেন হেসে ওঠে। নতুন দিনে পাখিরাও যেন গান গেয়ে ওঠে পরম ভালোবাসায়। প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকে তারা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিল। তখন তারা বছর গণনা করত চাঁদ দেখে। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব। চলতো টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের আবার ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য ছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন শুরু করে রোমানরা। রোমানরাও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মতো বর্ষবরণ উৎসব করতো বসন্তের প্রথম দিনে। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৭৩৮ অব্দে রোমান স¤্রাট রোমুলাসই কর্তৃক প্রবর্তিত ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন করা হয়েছিল তাদের ঐতিহ্য মতে বসন্তের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা মার্চ। পরে আরেক রোমান স¤্রাট নুমা পন্টিলাস বিশেষ করে ইতিহাসখ্যাত রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজারের একটি আদেশে বর্ষশুরু এবং নববর্ষ উৎসব ১ মার্চ থেকে চলে আসে ১ জানুয়ারি বা ৩১ংঃ হরমযঃ । দুই হাজারের অধিক সময় ধরে নানান আয়োজনে পালিত হওয়া ৩১ংঃ হরমযঃ আজ পৃথিবীব্যাপী নিজেই একটি ঐতিহ্য।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন বর্ষপঞ্জি ও নববর্ষ উৎসব হলেও ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি শকাব্দের বর্ষশুরু ২২ মার্চ ও অধিবর্ষে ২১ মার্চ এবং তাদের বর্ষবরণ উৎসবও সেইদিন। ইংরেজি নববর্ষের মতো বিশাল জনবহুল ও উৎসব পাগল ভারতবাসীদের নানা আয়োজনে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পালিত হওয়া শকাব্দের বর্ষবরণ উৎসবটি নিজেই একটি ঐতিহ্য। এখানে নববর্ষের দিন সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি পালিত না হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহব্যাপী ছুটি ভোগ করে।
ভারতবাসীর মতো ২১ মার্চের ২/১ দিন আগে পরে ব্যাপক আয়োজনে ৬ দিনব্যাপী নওরোজ পালন করে পারস্যবাসী। ‘নওরোজ’ ফার্সি ভাষার একটি যৌগিক শব্দ। ‘নও’ অর্থ ‘নতুন’ আর ‘রোজ’ অর্থ ‘দিন’ মিলে হয়েছে এটি। এদের উৎসবের ভিত্তিও বসন্তের আগমন। দক্ষিণায়ন থেকে সূর্য যেদিন বিষুব রেখায় আসে, নানা আয়োজনে মানুষ বরণ করে নেয় আরেকটি নতুন বছরকে। ফুলে ফুলে আবার সেজে ওঠে প্রকৃতি। ৩০০০ (তিন হাজার) বছরের জরথুস্ত্রিয়ান ঐতিহ্য মতে সূর্যের উত্তরায়ণে যেদিন দিন-রাত সমান থাকে সেদিনই পালিত হয় নওরোজ বা নবদিন উৎসব। নওরোজ উপলক্ষে ইরানের রেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রথম সপ্তাহে চলে ছুটির আমেজ। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ আমেজ চলে আরো এক সপ্তাহ।
নওরোজ উৎসবের মতো বসন্তের প্রথম দিন ব্যাপক আয়োজনে বর্ষবরণ উৎসব পালন করে প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী এবং পৃথিবীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ চীন। এদের বর্ষবরণের আয়োজনেও তাদের ঐতিহ্য-পৌরাণিক বিশ্বাস।
প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ক’টি নববর্ষ ও বর্ষবরণ উৎসবের আলোচনাপূর্বক এবার আসা যাক আমাদের নববর্ষ এবং বর্ষবরণ উৎসবের দিকে। পূর্বেই আলোচনা হয়েছে বর্তমান প্রচলিত আমাদের বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ এবং সেদিনই হচ্ছে বর্ষবরণ উৎসব। এদিন সরকারিভাবে আমাদের সাধারণ ছুটি পালন করা হয়। বিগত কয়েকটি বছর ধরে নানা আয়োজনে জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সার্বজনীনভাবে পালিত হচ্ছে আমাদের বর্ষবরণ উৎসব। এইদিন শুধু আমাদের দেশে বা বাংলা বর্ষেরই উৎসব পালিত হয়না। পৃথিবীর আরো কয়েকটি দেশ ও জাতি তাদের নববর্ষ উৎসব পালন করে থাকে পহেলা বৈশাখে। কিন্তু তাদের উৎসবের উৎস আর আমাদের উৎসবের উৎস এক নয়। তারা পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উৎসব পালন করে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের ভিত্তিতে। এবার আসা যাক আমাদের নববর্ষ উৎসবের ইতি কথায়।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম খবর পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর ষাটের দশকে পাকিস্তানি সরকার বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা গানে নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ি আরোপ করলে তার প্রতিবাদস্বরূপ সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব পালন শুরু করে। সেই উৎসবটিই স্বাধীনতার পরে আমাদের বিভিন্ন বিজয়ের আমেজ ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে এমন ব্যাপকতা পেয়েছে। মূলত এটি আমাদের উৎসব নয়। স্বাধীনতার পর এটিকে আমরা উৎসব করেছি এবং ব্যাপকতা পেয়েছে। এই উৎসবের উল্টোপিঠ অর্থাৎ শুরু বা পূর্বের ইতিহাস ভিন্ন রকম। এটি আসলে আমাদের উৎসবের নয় বরং শোষণ ও নির্যাতনের দিন গণনার শুরুর দিন। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে- ভারত বর্ষে মুঘল স¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর স¤্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। কিন্তু অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। পরে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল স¤্রাট প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার করার কথা বলেন। তখন ইরান থেকে আগত জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী ভারত বর্ষের ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে মিল রেখে কয়েকটি আঞ্চলিক সৌর পঞ্জিকার প্রস্তাব দেন। তারই একটি হচ্ছে আমাদের বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জি যা মূলত মুঘলদের ফসলি সন। এই ফসলি সনকে হিসাব করা হয়েছিল হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে এবং সেটি কার্যকর করা হয়েছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ৯৬৩ হিজরিতে স¤্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছর থেকে। অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সনে ৯৬৩ ফসলি সন হলো। আর বর্ষ শুরুর মাস করা হলো ৯৬৩ হিজরি সনে, হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম এবং বৈশাখ মাস এক সাথে ছিল বলে অথবা ৯৬৪ হিজরির ১/২ মহররম তারিখে স¤্রাট আকবর পানি পথের ২য় যুদ্ধে জয় লাভ করেন সেই বিজয়কে চিরস্মরণীয় করে রাখতে, সেই মহররম মাসেও বাংলা বৈশাখ মাস ছিল বলে। ফলে বৈশাখ মাসকেই নতুন প্রবর্তিত ফসলি সনের বর্ষশুরু মাস করা হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। ধীরে ধীরে এই উৎসবটি একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমান এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময়ে এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর ও বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখন ব্যাপকভাবে প্রচলিত না থাকলেও কিছু রয়েছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে। স¤্রাট আকবরের আগে আমাদের নববর্ষ উৎযাপনের কোন খবর পাওয়া না গেলেও তখন প্রচলিত শকাব্দের বর্ষশুরু মাস ছিল চৈত্র মাস। তবে প্রাথমিকভাবে বাংলা সনের প্রথম মাস কোনটি ছিল সে বিষয়ে কিছু মতানৈক্য রয়েছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেন যে, অগ্রহায়ণ হলো অগ্রাধিকার বিধায়, অতীতে আমাদের নববর্ষের দিন ছিল ১ অগ্রহায়ণ। অর্থাৎ হায়ণ বা বৎসরের প্রারম্ভে যায় যে মাস তার প্রথম দিন ছিল আমাদের নববর্ষের দিন। সে সময়ে নববর্ষ উদযাপন হতো কিনা বা কেমন আয়োজনে উদযাপন করা হতো সে বিষয়ে জানতে না পারলেও স¤্রাট আকবরের নববর্ষের যে উদযাপন সেগুলো মোটেও আমাদের জন্য নয়। সেগুলো কেবল আকবরের সিংহাসনে আরোহন ও যুদ্ধজয়কে উদযাপন করা। খাজনা তোলার সুবিধা তৈরি করা। নববর্ষের ঐ উৎসব আমাদের কোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে শুরু হয়নি। এমনকি তাদের আমলে বাংলা ও বাঙালিকে কোনো আলাদা মর্যাদা বা গুরুত্বও দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পরে আমরা আমাদের ইতিহাসের গৌরব আর ঐতিহ্যের মহিমা দিয়ে ভিনদেশী শাসকের শোষণ পদ্ধতি ১ বৈশাখকে মহিমান্বিত করেছি। কিন্তু আমাদের কোনো মহিমান্বিত দিনকে কেন্দ্র করে নতুন বছরের শুরুর দিনটা যদি নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের আবহে বর্ষবরণ উৎসব পালনের মাধ্যমে করতে পারি বা করি তাহলে সেই উৎসবটি কেবল বিনোদনের মাঝে সীমিত না থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদের চেতনাকে কার্যকরীভাবে বিকশিত করবে। আমাদের অগ্রযাত্রায় উদ্দীপনা শক্তি যোগাবে।
সেক্ষেত্রে বছরের দিন গণনার শুরুর ভিত্তি হিসেবে আমার প্রথম পছন্দ বাঙালি জাতির জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন ৭ মার্চ। এই ৭ মার্চ থেকে নতুন বছরের দিন গণনা শুরু করতে পারলে খুব ভালো লাগত। কিন্তু এতে করে দেড় হাজার বছর ধরে চলে আসা মাসগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। তাই সেটা না করে বরং ৭ মার্চের ১৯৭১ সালকে যেমন বছর গণনার ভিত্তি ধরা হয়েছে তেমনিভাবে ৭ মার্চ বাংলা যে মাসে পড়েছে সেই মাসের প্রথম দিনটিই হতে পারে বাংলাবর্ষের নতুন বছরের দিন গণনা শুরু এবং বর্ষবরণ উৎসব। আবার আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জির মাসগুলো ঋতুভিত্তিক। তাই শুধু মাস নয় বরং ঋতুর হিসাবটিও গুনতে চাই। সে ক্ষেত্রে বাংলা মাসটি হচ্ছে ফাল্গুন মাস এবং ঋতুটি হচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত (পৃথিবীর প্রথম বর্ষবরণ উৎসব এবং এখন পর্যন্ত ইরান-চীনসহ অনেক দেশ ও জাতির বর্ষশুরু ও নববর্ষ উৎসব শুরু হয় বসন্তের প্রথম দিন)। বর্ষশুরু এবং বর্ষবরণের জন্য ৭ মার্চকে প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি ধরে আরো কতগুলো সহযোগী ভিত্তি বিবেচনা করতে চাই যেগুলো আমাদের স্বাধীনতা ও জাতিসত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো :

প্রধান ভিত্তি :
১। ৭ মার্চ- ২৪ ফাল্গুন এবং বসন্তকাল।

সহযোগী ভিত্তি :
২। ২১ ফেব্রুয়ারি—- ৮/৯ ফাল্গুন এবং বসন্তকাল
৩। ২৬ মার্চ —— ১২ চৈত্র এবং বসন্তকাল
৪। ২ মার্চ —- ১৯ ফাল্গুন এবং বসন্তকাল
৫। ৩ মার্চ —— ২০ ফাল্গুন এবং বসন্তকাল
৬। ১১ মার্চ —— ২৮ ফাল্গুন এবং বসন্তকাল
৭। ১৭ মার্চ —- ০৩ চৈত্র এবং বসন্তকাল
শুধু এগুলোই নয়, ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিসহ অনেক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে এই সময়টা অর্থাৎ বসন্তকালে। এই সময়টা কেবল প্রকৃতি, ব্যক্তিজীবন আর কবি মনেরই বসন্তকাল নয় বরং আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জাতীয় অর্জনেরও পরম এক বসন্ত সময়। তাই বাংলাবর্ষ গণনার শুরুর দিন হিসেবে আমি বেছে নিতে চাই অনেক তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার বসন্তকাল এবং ৭ মার্চের ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুনকে।
তাই পহেলা ফাল্গুনকে বর্ষগণনার শুরুর দিন হিসেবে গণ্য করে ইতিহাসের এইসব তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যারা সংঘটিত করেছিলেন, যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যারা অংশগ্রহণ করে ছিলেন এবং যে মহান ব্যক্তির পরিকল্পনা ও নির্দেশনা এবং সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তাঁদের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা এবং তাদের সবার প্রতি আজীবনের জন্য সম্মান প্রদর্শন করার সুবর্ণ সুযোগ ও সময় আমাদের জন্য।
বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়’সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন- সুমহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, সুমহান স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে, ৭ মার্চকে প্রধান ভিত্তিগণ্য করে এবং বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার উৎপত্তিকালকে ভিত্তিগণ্য করে অব্দ গণনা বাংলাবর্ষ ‘মুজিবাব্দ’, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বসন্ত মসয়ের সাথে প্রকৃতির বসন্তকালের প্রথম দিন ১ ফাল্গুন-এ বাংলা নববর্ষ উৎসব পালন এবং বাংলাবর্ষ গণনা শুরু ৪০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে (সে মোতাবেক বর্তমান বাংলাবর্ষ ১৬২২ মুজিবাব্দ) প্রস্তাবটি যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক একটু ভেবে দেখুন এবং সম্ভব হলে কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
বাংলাদেশ ও পুরো পৃথিবীর বাঙালি’সহ বিশ্ববাসীকে ১ ফাল্গুন ১৬২২ মুজিবাব্দ(প্রস্তাবিত)(১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়