প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
১৯৭১ সালে রক্তের আখরে লেখা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উপাখ্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ এবং ভারতের জনগণ ও সরকারের কাছ থেকে পাওয়া অন্যান্য সমর্থনে গড়ে উঠা এই পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে উভয় দেশই গর্বিত। এই সম্পর্কের ভিত্তি নিয়ে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে কলকাতার ঐতিহাসিক ‘ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে উপস্থিত ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘…ভারতীয় জনগণ এবং ভারত সরকার এগিয়ে এসেছিল (মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করতে)। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসামের আমাদের ভাইরাও এগিয়ে এসেছিল। আমি বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।’ [এ এইচ খান (সম্পাদিত), ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ’, খণ্ড ০২, পৃষ্ঠা ১৬৯, একাত্তর প্রকাশনী, ২০১১]। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বন্ধুত্ব সময়ের সাথে আরো দৃঢ় হয়েছে। আমরা একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ইতিহাস ধারণ করি বলেই সেটি সম্ভব হয়েছে। দুই বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার প্রধানের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক ও কৌশলগত বোঝাপড়ার কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন এক নতুন উচ্চতায়। আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের স্বাগত জানানোর জন্য বাংলাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছিল। এটি প্রতিবেশীদের মধ্যে আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো উন্নত করার নয়া শক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। একসাথে আমরা অভিন্ন শত্রæ অর্থাৎ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একে অপরের সাফল্যের গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ার সংকল্প গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে এই আঞ্চলিক রাষ্ট্রনায়কদের বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে। সর্বশেষ গত ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করেছে।
এটি খুবই আনন্দের যে বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ সুবিধা কাজে লাগাতে আগ্রহী। তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক সীমানা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে (বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে) কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।’ (ইউএনবি নিউজ, ০৯ মার্চ ২০২১)। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ভারতকে কানেক্টিভিটি দেয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করছি। আমরা এমন একটি অঞ্চলে আছি যেখানে কানেক্টিভিটি চালুর বিষয়ে রক্ষণশীলতা ছিল এবং যেখানে সম্ভাবনার চেয়ে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য অনেক কম।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মৈত্রী সেতু (বন্ধুত্ব সেতু) উদ্বোধন করার সময় এই কথাগুলো বলেন। সেই শুভক্ষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সেতুটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। তিনি বলেন, ‘কানেক্টিভিটি শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বই মজবুত করছে না, এটি ব্যবসায়ের একটি শক্তিশালী সংযোগ হিসেবেও প্রমাণিত হচ্ছে।’ (দ্য ডেইলি সান, ১০ মার্চ ২০২১)। দুই প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তাগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের প্রধান দিক। প্রকৃতপক্ষে, গত এক দশকে বা তারও বেশি সময় ধরে উভয় দেশেরই সরকারি এবং অসরকারি অংশীজনরা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আমরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জায়গা থেকে উন্নয়ন সমন্বয় ভারতের কাটস ইন্টারন্যাশনালের সাথে সহযোগিতামূলক গবেষণা এবং সম্পর্কিত নীতি সমর্থনে গভীরভাবে জড়িত রয়েছি। সাধারণভাবে বিবিআইএন উপ-অঞ্চলে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে ঘনিষ্ঠ সংযোগের বিষয়ে কোন পথে অগ্রসর হওয়া যায় সেসব বিষয়েই আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করছি। আমরা ভারত (মেঘালয়), ভুটান এবং নেপালের অন্যান্য অসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথেও কাজ করছি। উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সাথে উপ-আঞ্চলিক এই সম্পর্কের প্রসার ঘটানো।
বাণিজ্য উন্নয়নে বাংলাদেশ ও ভারত দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করে আসছে। এই প্রচেষ্টার পেছনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে ভৌগোলিকভাবে সমন্বিত অঞ্চলের অর্থনীতিকে নানা পরিপূরকতার সাথে পুনঃসংহত করার আকাক্সক্ষা, সমন্বিত উন্নয়নের প্রবেশপথ হিসেবে সীমানা উন্নয়নের রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং এই অঞ্চলের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাগত উপযোগিতার সর্বোত্তম ব্যবহারকে পৃষ্ঠপোষকতা করার উচ্চাকাক্সক্ষা। এই দুই দেশ এবং তাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীরা বাণিজ্য সহযোগিতায় ‘আসিয়ান’ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ‘আসিয়ান’ মডেলটি শুরুতে আন্তঃআঞ্চলিক শুল্ক কমানোর লক্ষ্যে প্রবর্তিত হয়েছিল। পরবর্তীতে, ‘কানেক্টিভিটি’ বা যোগাযোগ বাড়ানোর দিকে অগ্রসর হয়েছিল। ‘আসিয়ান’ সহযোগিতা মডেলটি পরিপক্ব হওয়ার সাথে সাথে ব্যবসায় ‘ইনকিউবেশন’ বা উদ্ভাবন, টেলি-কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং ‘আসিয়ান পাওয়ার গ্রিড’ এর মতো উন্নত ধারণাগুলো বাস্তবায়িত হতে শুরু করে। প্রশংসনীয়ভাবে, বাংলাদেশ এবং ভারত বাণিজ্য সহযোগিতায় নিজস্ব বাস্তবতার নিরিখেই ‘আসিয়ান মডেল’ অনুসরণ করছে। এই দুটি দেশ বাণিজ্য সহযোগিতামূলক আলোচনায় আরো দুটি প্রতিবেশী দেশ, ভুটান এবং নেপালকে সঙ্গে নিতে অনেকটাই সফল হয়েছে।
১৫ জুন ২০১৫ তারিখে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল ‘মোটর যানবাহন চুক্তি’ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের যানবাহন উপ-অঞ্চল জুড়ে পরিবহন এবং যাত্রীদের জন্য চলাচলের অনুমতি দেয়। উল্লিখিত চুক্তির সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার এখনো সুযোগ-সুবিধা এবং বিধিনিয়মের উন্নতির ওপর নির্ভর করে। তাই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে সঠিক পথে অগ্রসরের এটি একটি বড় ধাপ। অংশীজনরা এর সম্ভাব্য ফলাফলের বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। এছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার প্রোটোকলে ‘অভ্যন্তরীণ ওয়াটার ট্রানজিট এন্ড ট্রেড’ সংক্রান্ত চুক্তিটি নৌপথের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন ও জনগণের যাতায়াতের অনুমতি দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথ সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করা গেলে ভ্রমণ/পরিবহন ব্যয় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এর জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোর ওপর আরো আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। দুই দেশের সরকার রেল যোগাযোগ পুনরুজ্জীবিত করার জন্যও কাজ করছে। এক্ষেত্রে ভারতের ‘লাইন অব ক্রেডিট’ খুবই কাজে লাগবে। বিদ্যমান ছয়টি কিন্তু বিলুপ্ত হওয়া রেলপথের মধ্যে পাঁচটি ইতোমধ্যেই পুনরুজ্জীবিত করা গেছে। আরো দুটি নতুন সংযোগসহ ষষ্ঠটি চালু করার কাজ চলছে। ঢাকা ও গুয়াহাটির মধ্যে বিমান যোগাযোগ পরীক্ষামূলকভাবে পুনরায় চালু করা হয়েছে। শীঘ্রই, সিলেট এবং চট্টগ্রামের মতো বাংলাদেশের আরো অনেক শহর পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট শহর/শহরগুলোর সাথে আকাশপথে সংযুক্ত হবে। তবে করোনা সংকট এই আকাশ সংযোগের গতি বেশ খানিকটা থামিয়ে দিয়েছে। আশা করা যায় এই সাময়িক সংকট নিশ্চয় কেটে যাবে। এটি সত্যিই উৎসাহজনক যে দুই দেশের সরকার সড়ক যোগাযোগের বাইরেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য পরিবহনের সমস্ত উপায়কে অন্তর্ভুক্ত করছে (দেখুন, বিপুল চ্যাটার্জি, দ্যা ইকোনমিক টাইমস, ২০ মার্চ ২০২১)।
ভারত ও বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জ্বালানি সহযোগিতা কার্যক্রমের সুফল পাচ্ছে। ভারত এখন বাংলাদেশে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে। সম্প্রতি বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ায় আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ স্থানান্তরের উদ্যাগ নেয়া হয়েছে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে সেই দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করতে বাংলাদেশ ‘পাওয়ার করিডোরের’ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, জ্বালানি বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যতে ‘বিবিআইএন পাওয়ার মার্কেট’ তৈরি হতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও দুই দেশের মধ্যকার জ্বালানি সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথা ভাবা হচ্ছে। ‘মুজিব সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’য় এই সম্ভাবনার ক্ষেত্র স্পষ্ট করেই চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরসেচসহ গৃহনির্ভর সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতার কথা সারা বিশ্বই জানে। ভারতেরও বৃহৎ পরিসরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প পরিচালনার প্রশংসনীয় অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্পষ্টতই এই দুই দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণে একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে এবং সে অভিপ্রায় বিভিন্ন সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। কানেক্টিভিটির উন্নতির পাশাপাশি দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিআইডিএ) এর সাথে নিবন্ধিত মোট ভারতীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আওতায় মোংলা, ভেড়ামারা এবং মিরসরাইয়ের তিনটি ভারতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) বিনিয়োগ করা হবে। তবুও এই কথা মানতেই হবে যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রকৃত সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরিভাবে কাজে লাগানো যায়নি।। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর-পূর্ব ভারত কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে শক্তিশালী সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের দারুণ সুনাম আছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রসারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পালাক্রমে উত্তর-পূর্ব ভারত বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাবারের বাজার হিসেবেও কাজ করতে পারে। নিশ্চিতভাবেই, ভারত-বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সহযোগিতা উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। ‘পূর্বের দিকে তাকাও’- ভারতের এই পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে এই সহযোগিতা উদ্যাগ খুবই কার্যকর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা হ্রাস করা এবং শুল্ক ব্যবস্থার দক্ষতা নিশ্চিত করা এই মডেলের সাফল্যের পূর্বশর্ত। ব্রডব্যান্ডের সহজলভ্যতার মাধ্যমে উভয় দেশের মানুষকে কাছে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ডিজিটাল কানেক্টিভিটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ত্রিপুরা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের ডিজিটাল কানেক্টিভিটির সুবিধা পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আরো ডিজিটাল সুবিধা নিতে পারে। এতে দুই দেশেরই লাভ হবে।
ডিজিটাল কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে উভয় দেশই পরিষেবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা দূর করতে পারে যা সাধারণ পণ্য বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। এটি নারীসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে প্রবৃদ্ধিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সাহায্য করবে। নিশ্চয়, পরিষেবা বাণিজ্যের প্রসারে দুই দেশের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ডিজিটাল পরিষেবাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মহামারির সময়ে ডিজিটালভাবে নিজেদের রূপান্তরিত করছে। ডিজিটাল ব্যবসার প্রসারে এই বিষয়ে, দুই দেশের বা উপ-অঞ্চলের নিয়ন্ত্রকদের বসতে হবে। মিলেমিশেই পরিষেবা সহজীকরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক মান এবং ব্যবসায়িক শর্তসমূহ তৈরি করতে হবে। সাবেক আর্থিক নিয়ন্ত্রক হিসাবে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পাঠকদের বলতে পারি যে উভয় দেশ যদি এই অঞ্চলে ব্যবসায়ের প্রসারে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয় তবে এই আধুনিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়ানোর পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। সীমান্তে বাণিজ্য ও পরিষেবার ডিজিটাইজেশন একটি স্মার্ট পদক্ষেপ হবে যা সবুজ ব্যবসায়ের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে অনেকাংশে দূর করতে পারে।
যেমনটি আমরা ইতোমধ্যেই দেখিয়েছি যে সহযোগিতা এবং/অথবা সুবিধা সবসময় খুব বড় হতে হবে এমন নয়। ছোট উদ্যোগুলোও খুব ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারে বিশেষ করে যখন মানুষে মানুষে যোগাযোগের বিষয়টি দৃষ্টি দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, চারটি ‘বর্ডার হাট’ বর্তমানে চালু রয়েছে (সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, ছাগলনাইয়া এবং কসবা)। মৌলভীবাজারে আরেকটি সীমান্ত বাজার সম্প্রতি চালু হয়েছে। এমন আরো সীমান্তহাট চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সীমান্ত হাটে ক্ষুদ্র ব্যবসা সহজ করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ শর্তগুলো সরল ও কার্যকর করতে কৌশলগত ভূমিকা পালন করেছে। প্রকৃতপক্ষে, দেশগুলোকে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে এবং তাদের উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে। সীমান্ত বাণিজ্যকে বিধিবদ্ধ করার এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ জনগণের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে। এর মাধ্যমে মাদক ও অস্ত্রসহ অবৈধ বাণিজ্যের ফলে উদ্ভূত নিরাপত্তাহীনতার হুমকি অনেকটাই কমানো গেছে। এসব ফলাফল বিবেচনা করে উভয় দেশই এখন এ ধরনের সীমান্ত হাটের সংখ্যা আরো বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। নিশ্চিতভাবেই, এই অভিজ্ঞতার আলোকে সমগ্র সীমান্তকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। দুই দেশের পক্ষেই এমন উদ্যোগ অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দুয়ার খুলে দেয়ার সম্ভাবনা রাখে। এর ফলে উভয় দেশই লাভবান হবে।
যদিও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে, এখনো অনেক কিছু করা বাকি রয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য তার মোট বাণিজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ। ভারতের জন্য অনুপাত আরো ছোট (মাত্র ১ শতাংশ)। এই অনুপাতকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে (মোট বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ) অবশ্যই এই অঙ্ক খুবই নগণ্য মনে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ১৮২ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১২৬ শতাংশ বাড়তে পারে। কানেক্টিভিটি উন্নত হলে এই হার আরো বাড়তে পারে। তখন ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ২৯৭ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৭২ শতাংশ বাড়তে পারে। এই পরিসংখ্যান বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু যদি কেউ কানেক্টিভিটি সুবিধার ফলাফলের দিকে নজর দেন তাহলে তিনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে এর প্রসারের মাধ্যমে বাণিজ্য কতটা বাড়ানো যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, করিডর/ট্রানজিট সুবিধার অনুপস্থিতিতে একজন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ব্যবসায়ীকে আগরতলা থেকে কলকাতা পৌঁছুতে (শিলিগুড়ি হয়ে) ষোলোশ কিলোমিটার যেতে হবে। কিন্তু তিনি যদি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে এই দূরত্ব হতো ছয়শ কিলোমিটারেরও কম। এই দূরত্ব আরো কমানো যেতে পারে যদি সেই ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম বন্দর (আগরতলা থেকে মাত্র দুশ কিলোমিটার) ব্যবহার করতে পারেন। আশার কথা হলো সংযোগ উদ্যোগগুলো সেই দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। তবে আমাদের অবশ্যই লজিস্টিক বাধাসমূহ অপসারণ এবং স্থানীয় বাজারগুলোকে আঞ্চলিক করিডরের সাথে সংযুক্ত করার ওপর আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
খুবই লক্ষণীয় যে, গত দুই দশকে, স্থির গড় প্রবৃদ্ধির হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আর ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ১২ শতাংশ। পাশাপাশি নেপালের সাথে গড় রপ্তানি বৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশ। ভুটানের সাথে তা ১১ শতাংশ বেড়েছে। এসব তথ্যই বলে দিচ্ছে যে বাণিজ্য বাড়াতে কানেক্টিভিটি উন্নত করা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই সত্যিকারের ‘উইন-উইন’ হতে পারে। ‘কানেক্টিং টু থ্রাইভ : চ্যালেঞ্জস এন্ড অপরচুনিটিস অব ট্রান্সপোর্ট ইন্টিগ্রেশন ইন ইস্টার্ন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরামবিহীন সংযোগ (স্থল বন্দরে ট্রান্সশিপমেন্ট ছাড়া) স্থাপন করা গেলে বাংলাদেশের প্রকৃত আয় ১৭ শতাংশ এবং ভারতের ৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। সুতরাং বিবিআইএন এমভিএ বাস্তবায়ন এবং এ উপ-অঞ্চলে মাল্টিমোডাল যোগাযোগ প্রটোকলের বিষয়ে আলোচনা শুরুর মাধ্যমে এ বিশাল বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আরো বাণিজ্য সহযোগিতার অনুকূলে তিনটি চালিকাশক্তি রয়েছে। এক. পর্যটন এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা উভয়ের জন্য ভিসা ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্য আরো সহজ করার জন্য অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সহযোগিতা ও সদিচ্ছা বিদ্যমান আছে। সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিনিময়ও দ্রুত গতিতে বিকশিত হচ্ছে। দুই. বর্তমানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত অর্থনীতি। ভারতের অর্থনীতি বৃহত্তম। উভয়ই কানেক্টিভিটি সুবিধার সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের আয় বাড়াতে পারে। তাদের অর্থনীতিকে আরো গতিময় করতে পারে। করোনাকালে দুই দেশের বাণিজ্য বহুলাংশেই বেড়েছে। এই অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে যে এক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা বাস্তবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিশেষে, মহামারি পরবর্তী বিশ্বে যখন সব বৈশ্বিক শক্তি তাদের ‘মূল্য সরবরাহ চেইন’ পুনর্বিবেচনা করছে, তখন বাংলাদেশ, ভারত এবং তাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশীদেরও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা আরো বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে। বাণিজ্যের বাইরেও মহামারির সময় উভয় দেশই ভ্যাকসিনসহ মানবিক সহযোগিতার অসাধারণ পারস্পরিক সমর্থন প্রদর্শন করেছে। শুরুতে এত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি সহজলভ্য করার জন্য ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন আগামী বছরগুলোতেও স্মরণ করা হবে। তবে বাস্তব কারণেই ভারত ঐ সরবরাহ চেইন অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্যান্য সেবার সরবরাহের গতি বেড়েছে এই দুঃসময়েও। এখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমাদের সম্ভাবনাময় উপ-আঞ্চলিক মাল্টি-মোডাল কানেক্টিভিটির সুযোগগুলো আরো প্রসারিত করে যেতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। অভাব আছে প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং সক্ষমতার। সেদিকে এখন নজর দেয়ার সময় এসে গেছে। সব অংশীজনকেই এজন্য তৎপর হতে হবে।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।