ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই ও এন্ডারসন রিপোর্ট

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইউনাইটেড ফিচার সিন্ডিকেটের প্র্রতিবেদক ও কলাম লেখক জ্যাক এন্ডারসনকে যে প্র্রতিবেদনগুলো সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার এনে দিয়েছে সেগুলো মূলত ১৯৭১-এর ডিসেম্বর যুদ্ধ নিয়ে, যে যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। জ্যাক নর্থম্যান এন্ডারসন (১৯ অক্টোবর ১৯২২- ৭ ডিসেম্বর ২০০৫) আমেরিকার অনুসন্ধানী-প্র্রতিবেদকদের গুরু। জ্যাক এন্ডারসনের সাড়া জাগানো বাংলাদেশ অভ্যুদয় প্র্রতিবেদনের কিছু নমুনা অনূদিত ও উপস্থাপন করা হলো।

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ও সোভিয়েত রণতরী
বঙ্গোপসাগরে সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মুখোমুখি হওয়ার পরিণতি হবে ভয়ংকর। ভারতকে নিরস্ত্র করার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন নৌ টাস্কফোর্সকে ঝামেলার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বিমানবাহী জলযান এন্টারপ্র্রাইজ বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে, সঙ্গে আছে উভচর যান ত্রিপোলি, গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট কিং, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার তিনটি-পার্সন, ডেকাটুর এবং টার্টার স্যাম। একইসঙ্গে স্পষ্টতই ভারতকে সাহায্য করার জন্য বঙ্গোপসাগরের দিকে সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। গোয়েন্দা প্র্রতিবেদন থেকে আরো অমঙ্গলজনক খবর পাওয়া গেছে-ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে সোভিয়েত টেকনিশিয়ান রয়েছে, সে জাহাজ পাকিস্তানি বন্দর এবং সংলগ্ন স্থাপনার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক জাহাজও আক্রান্ত হয়েছে, সমুদ্রতল থেকে উৎক্ষিপ্ত রকেটও শনাক্ত হয়েছে। সোভিয়েত সাবমেরিন থেকে রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে কি না তা জানতে যুক্তরাষ্ট্র আশু সাহায্য চেয়েছে। এদিকে হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পক্ষপাত লুকোবার আর কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না। পাকিস্তানের ‘ডিনামিক’ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। (১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১)

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের গোপন ক্রোধ
৩ ডিসেম্বর বৈঠকে বিরক্তিভরে কিসিঞ্জার বললেন, প্র্রতি আধঘণ্টা পরপর প্রেসিডেন্ট একবার করে আমাকে এক হাত নিচ্ছেন যে, আমরা ভারতের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর ভূমিকা পালন করছি না। কিছুক্ষণ আগেও তিনি আমাকে আবার সে কথা বলেছেন। আমরা তার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করছি-এটা তিনি বিশ্বাস করছেন না। তিনি চান আমরা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ি। তিনি মনে করেন আমরা যা করতে চাই ঠিক তার উল্টোটাই ঘটছে।
জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল টমাস মুরার বৈঠকে সামরিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সিআইয়ের প্র্রতিনিধির পাঠানো প্র্রতিবেদন তুলে ধরেন সিআইএ প্রধান রিচার্ড হেল্মস। তারপর কিসিঞ্জার জাতিসংঘের বিষয় উপস্থাপন করেন। তিনি ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ যদি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে এর উপযোগিতা ফুরিয়ে গেছে, কাজেই মধ্যপ্র্রাচ্যে জাতিসংঘ যে গ্যারান্টি দিচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করা অর্থহীন।
কিসিঞ্জার জোর দিয়ে বললেন, আমাদের অ্যাকশনে যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট আমাকে দোষারোপ করছেন আর আপনারা হাত-পা ঝেরে বসে আছেন। সিসকো বললেন, একটি কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আমরা ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারি, সেক্ষেত্রে এটাও ঘোষণা দিতে হবে পাকিস্তানের ব্যাপারে অনুরূপ পদক্ষেপ বিবেচনাধীন। এই কথা শুনে গুমরে উঠে কিসিঞ্জার বললেন, ভারতীয় পদক্ষেপের সাথে পাকিস্তানি পদক্ষেপ মেলাতে হলে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়া খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
পরদিন ৪ ডিসেম্বরের বৈঠকে কিসিঞ্জার বললেন, আমাদের মুখপাত্ররা ভারত নিয়ে যা বলেছেন তাতে প্রেসিডেন্ট তো রাগে ফুঁসে উঠছেন। তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট একটা মোহগ্রস্ততার মধ্যে আছেন, তিনি মনে করছেন যে তিনি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন, আসলে কী ঘটছে কেবল তাই আমরা তাকে জানাচ্ছি। নিক্সনের মধ্যেই ক’টি গোপন জরুরি আপিল নাকচ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে নয়াদিল্লিতে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অনুরোধ ছিল ভারতকে দূরে সরিয়ে দেয়ার প্র্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক হতে হবে। তিনি জানিয়েছেন যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং তাকে আশ্বস্ত করেছেন তাদের হাতে দখলকৃত বাংলাদেশকে ভারতের অংশ হিসেবে যোগ করার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে জনগণ স্বাগত জানাবে, যদি বাংলাদেশ নিজেদের প্র্রশাসন চালাতে সমর্থ হয় তাহলে ভারতের কোনো প্র্রশাসক পাঠানোর ইচ্ছেও নেই। ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে হোয়াইট হাউসের মনগড়া এক প্র্রতিবেদনের প্র্রতিবাদ জানিয়ে তিনি একটি গোপন বার্তা পাঠান। তিনি বলেন, যেহেতু এই ট্র্যাজেডির প্র্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, হোয়াইট হাউসের প্র্রতিবেদনে যা লিখা হয়েছে তা আমি বিশ্বাস করি না, তা আমাদের অবস্থান কিংবা বিশ্বাসযোগ্যতাকে কোনোভাবেই দৃঢ় করবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে সোভিয়েত কব্জায় তুলে দিচ্ছে
আরো প্র্রমাণ আমরা পেয়েছি দৃশ্যত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই ভারতকে সোভিয়েত বলয়ের অধীনে চলে যেতে বাধ্য করছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত কেবল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশই নয় এ দেশের গণতান্ত্রিক সরকার স্বাভাবিক কারণেই দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রে পরিণত করছিল, কিন্তু নিক্সন যা করছেন তাতে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় ঢুকে পড়ার যে রুশ-স্বপ্ন তা বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
পেছনমঞ্চে যা কিছু ঘটছে নিক্সন প্র্রশাসন তার ওপর সেন্সরশিপ পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে সেন্সরশিপ সহ্য করা হবে না হোয়াইট হাউস গোপনীয়তার লেবেল সেটে বিব্রতকর অনেক কিছু সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমরা সেন্সরশিপ ভেঙে ফেলেছি, নিক্সনের দ্বৈত চেহারা আমরা তুলে ধরতে পারি।
নিক্সনের ব্যক্তিগত নীতিপ্র্রণেতা হেনরি কিসিঞ্জার গত সপ্তাহের একটি প্র্রস্তুতিমূলক বৈঠকে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন যে, নিক্সন প্র্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধাচারী নয়। প্র্রশাসন ভারতবিরোধী বলে কোথাও কোথাও মন্তব্য করা হয়েছে যা মোটেও যথার্থ নয়। হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুমের কঠিন প্র্রহরাধীন দরজার অন্তরালে অবশ্য কিসিঞ্জারের ভিন্ন চেহারা আর ভিন্ন সুর। ৩ ডিসেম্বর যেসব ঊর্ধ্বতন পরিকল্পনাকারী বৈঠকে যোগ দিয়েছেন তিনি তাদের কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে বলেছেন ‘প্র্রতি আধঘণ্টা পরপর প্রেসিডেন্ট একবার করে আমাকে এক হাত নিচ্ছেন যে আমরা ভারতের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর ভূমিকা পালন করছি না।’
গোপন ও ফিসফিসে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ পরদিন তাদের কর্মকৌশল প্র্রণয়ন বৈঠকে একই কথা আবার শোনেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশ যে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সব সমালোচনা ভারতের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি স্যামুয়েল ডিপামা তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্র্রশ্ন তোলেন। কিসিঞ্জার বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিয়েছেন হয় আমাদের আমলারা সঠিক বিবৃতি দেবেন নতুবা হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি দেয়া হবে।
ডিপামা সতর্ক করে দেন, জাতিসংঘে আমরা সমস্যায় পড়ে যাব কারণ যেসব দেশ আমাদের সঙ্গে আছে তাদের কেউ-ই চায় না পাকিস্তানের দিকে আমরা যতটা ঝুঁকে যাচ্ছি ততটা ঝুঁকে থাকি। কিসিঞ্জার ক্ষুব্ধ হয়ে সতর্ক করলেন, এখানে পেছনে যারাই কলকাঠি নাড়ছেন তারা প্র্রেসিডেন্টকে ক্ষিপ্ত করে তুলছেন। দয়া করে আপনারা প্র্রেসিডেন্টের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করুন।
৪ ডিসেম্বর সিচুয়েশন রুমের বৈঠকে কর্মকৌশল প্র্রণেতাদের ভিন্ন কথা বলে থাকলেও কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সহায়তা প্র্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানকে একইভাবে বিবেচনা করে। প্র্রেসিডেন্টকে উদ্ধৃত করে কিসিঞ্জার তাদের বলেছিলেন, আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ভারতের বিরুদ্ধে যেতে বলেছেন। আর কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের বললেন, শরণার্থীদের ভোগান্তি নিয়ে নিক্সন প্র্রশাসন গভীর উদ্বিগ্ন, ভারতে এমনিতেই সীমিত সম্পদের ওপর শরণার্থীদের চাপ পড়ে গেছে। (১৫ ডিসেম্বর)

পাকিস্তানের জন্য ফাইটার যুদ্ধজাহাজ
৬ ডিসেম্বর গোপনীয় বৈঠকে পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওয়া জরুরি সামরিক সহায়তার প্র্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তান পরাজিত হোক প্রেসিডেন্ট তা দেখতে চান না। তিনি জানতে চেয়েছেন জর্ডান বা সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাকিস্তানে পাঠাবার কথা বলার বৈধ অধিকার আমাদের আছে কি না? স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিশেষ দূত ক্রিস ভ্যান হোলেন সাফ জানিয়ে দিলেন, যে আমরাই পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের বৈধতা মেনে নিচ্ছি না সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাকিস্তানে পাঠাবার কথা আমরা তৃতীয় কোনো দেশকে বলতে পারি না। তারপর ও জর্ডানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এল ডিন ব্রাউনের কাছে একটি স্টেট ডিপার্টমেন্ট হুকুম পৌঁছল, বার্তায় বলা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা এফ-১০৪ ফাইটার উড়োজাহাজ পাকিস্তানে পাঠানোর প্র্রস্তাবে জর্ডানের বাদশাহ হোসেনকে ক্ষমতা প্র্রদানের বিষয়টি যেন উন্মুক্ত রাখা হয়। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে নিবিড় পর্যালোচনায় রয়েছে- এটি রাষ্ট্রদূত ব্রাউনকে জানানো হলো। কিসিঞ্জার অত্যন্ত সতর্কভাবে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করলেন যে দ্ব›েদ্বর (ভারত-পাকিস্তান ) প্র্রক্রিয়াটি পাকিস্তানই শুরু করেছে।
সত্যটা অবশ্যই আরো রূঢ়। গত মার্চে পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় সামরিক শাসন বহাল করেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের যেভাবে সন্ত্রস্ত করেছে তাতে লাখ লাখ নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্পষ্টতই স্বাধীনতা চায়, পাকিস্তানের শাসন চায় না। আক্রমণকারী ভারতীয়রা যদিও যুদ্ধে প্র্রথম সামরিক অভিযান চালিয়েছে, মুক্তিদাতা হিসেবে তাদেরই স্বাগতম জানানো হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সমরশক্তি প্র্রদর্শন
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের গোটা সময় ধরে আমেরিকার জনগণ তাদের নেতাদের দ্বারা ভুলভাবে পরিচালিত হয়েছে। গোপন দলিল সরকারি ভাষ্যের বিরোধিতা করে, যেমন বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর টাস্কফোর্স পাঠানো নিয়ে সরকারি মুখপাত্র হোয়াইট হাউসের ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন- যুদ্ধরত ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের তুলে আনাই টাস্কফোর্সের প্রধান মিশন।
দুসপ্তাহব্যাপী যুদ্ধ নিয়ে গোপনীয় হোয়াইট হাউস পেপার্স আমাদের পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়েছে। এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে উড়োজাহাজ বহনকারী জলযান এন্টারপ্র্রাইজকে টাস্কফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়- এটাই আমেরিকার নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজ, শক্তির মহড়া দেখানোর জন্য ভারত মহাসাগরে পাঠানো হয়েছে।

প্র্ররোচনামূলক এই নৌ-মোতায়নের উদ্দেশ্যে
(১) টাস্কফোর্সকে অনুসরণকারী দুই জাহাজ ও উড়োজাহাজ ফিরিয়ে নিতে ভারতকে বাধ্য করা,
(২) পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন দিক থেকে দেয়া ভারতীয় অবরোধ দুর্বল করে দেয়া
(৩) সম্ভবত ভারতীয় উড়োজাহাজবাহী নৌযান বিক্রমকে তার সামরিক মিশন থেকে সরিয়ে আনা এবং
(৪) ভারতকে এমনভাবে চাপ দেয়া যেন নিজেদের উড়োজাহাজ প্র্রতিরক্ষা সতর্কতায় নিয়োজিত থাকে এবং তাতে পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর ওপর কম অপারেশন চালাবে।

এত দিন হোয়াইট হাউসের অজ্ঞাতনামা যেসব সদস্য সাংবাদিকের কাছে ফিসফিস করে খবর দিতেন, টাস্কফোর্স যে আটকেপড়া মার্কিন নাগরিকদের তুলে আনতে গেছে তারা এরকম ভান করা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন তারা ভেতরের কথা ফাঁস করে দিচ্ছেন : প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কানে এসেছে যে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার নয়, পশ্চিম পাকিস্তানকেও খণ্ড-বিখণ্ড করার পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনা ঠেকাতেই ভারত মহাসাগরে টাস্কফোর্স পাঠানো হয়েছে।
হোয়াইট হাউস সম্পর্কে যা লেখা আছে, এখানে তারও বিকৃতি ঘটেছে। সেখান থেকে উদ্ধৃতি : বঙ্গোপসাগরে ভয় দেখানো টাস্কফোর্স প্র্রেরণের অল্পক্ষণ আগে হোয়াইট হাউসের গল্পকথার সিচুয়েশন রুমে সংবেদনশীল কর্মকৌশল প্র্রণয়নের বৈঠক বসে। বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে সিআইএ প্রধান মিস্টার হেল্মস আলোচনার সূত্রপাত করেন। বলা হয় বর্তমান যুদ্ধ শুরু করার আগেই মিসেস গান্ধী পাকিস্তানের গোলন্দাজ ও বিমানবাহিনীর সক্ষমতা গুড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
পশ্চিম রণাঙ্গনের পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে জেনারেল রায়ান (বিমানবাহিনীর প্রধান) জানান, ভারতকে এখন খুব কঠোর মনে হচ্ছে না, কেবল আক্রমণটা ধরে রেখেই তারা সন্তুষ্ট।…
কিসিঞ্জার (প্র্রেসিডেন্টের প্রধান বিদেশ নীতিমালা প্র্রণেতা) বলেন, ভারত যদি সশস্ত্র স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে তাহলে পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়ার পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে পারে। দুটো বাহিনী অপসারিত হলে পাকিস্তানের আর প্র্রতিরক্ষা শক্তি থাকবে না।

সপ্তম নৌবহরের একটি উড়োজাহাজবাহী জলযান এন্টারপ্র্রাইজ একাত্তরে বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়েছিল
মার্কিন টাস্কফোর্স ভয় দেখাতে পারেনি
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের প্র্রাক্কালে বঙ্গোপসাগরে নাটকীয়ভাবে উপস্থিত মার্কিন নৌ টাস্কফোর্স ভারতকে আদৌ ভয় দেখাতে পারেনি বরং রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধনকে দৃঢ় করেছে বলে এখন মনে হচ্ছে। নয়াদিল্লিতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত নিকোলাই এম পেগভ গোপনে ভারতকে আশ্বাস দিয়েছেন যে সোভিয়েত নৌবহর এখন ভারত মহাসাগরে এবং তারা সপ্তম নৌবহরকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। যদি হিমালয় পেরিয়ে চীন ভারতকে আক্রমণ করে সে ক্ষেত্রে তিনি প্র্রতিশ্রæতি দিয়েছেন রাশিয়া সিঙ্গকিয়াঙ্গে আক্রমণ চালাবে যাতে চীনা বাহিনীকে সেদিকে ফিরিয়ে নিতে হয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে তাহলে, পেগভ প্র্রতিশ্রæতি দিলেন তখন সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটবে।
কী ঘটতে যাচ্ছে মার্কিন জনগণের আঁচ করার আগেই এ ধরনের গোপন পত্র চালাচালির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে ন্যক্কারজনকভাবে জড়িয়ে যায়। আমরা মনে করি জনস্বার্থে এসব গোপন দলিলের অংশবিশেষ প্র্রকাশ করা দরকার।
আগের লেখায় আমরা বলেছি প্র্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতবিরোধী নয়, একইসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি সরকারের নীতিনির্ধারকদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিসিঞ্জার জোর দিয়ে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট চান না আমরা ভারসাম্য রক্ষা করে চলি, তিনি বিশ্বাস করেন ‘ভারত হচ্ছে আক্রমণকারী’।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের পেশাজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, নৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিদের সঙ্গে অবস্থান নেয়া দরকার, তারা পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা চাইছে। তারা আরো বলেছেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাকিস্তানপন্থি পররাষ্ট্রনীতি ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্র্রসারিত বাহুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পেশাজীবীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে কথা বলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন জাতিসংঘে ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সপ্তম নৌবহর ভারতে দিকে পাঠাতে টাস্কফোর্সকে বলেছিলেন। এটা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা দেখাবার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে যদিও বাড়তি একটি মিশন যোগ করা হয়েছিল- প্র্রয়োজন হলে যুদ্ধে আক্রান্ত ঢাকা থেকে আটকেপড়া মার্কিনিদের উদ্ধার। এমনভাবে সপ্তম নৌবহরের যাত্রাপথে জাকার্তা, ম্যানিলা ও সিঙ্গাপুরে এর ভারতমুখী গমনের সংবাদ ‘লিক’ করা হয়েছে যেন তা ভারতের জন্য প্র্ররোচনামূলক হয়। নৌবহর যখন মালাক্কা প্র্রণালীতে সমবেত হয় ভারত ততক্ষণে ভালোভাবেই জেনে গেছে সপ্তম নৌবহর আসছে।

জ্যাক এন্ডারসন জানুয়ারি ১৯৭২
সোভিয়েত হুমকি
সোভিয়েত ইউনিয়ন জানায়, চীন যদি হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সিনকিয়াঙ্গ-এ পাল্টা অপারেশন চালাবে এবং ঢাকা স্বাধীন হওয়ার পর যখন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবে তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে এবং বর্তমান সংকট নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে।
অপর একটি গোয়েন্দা প্র্রতিবেদন সোভিয়েত উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাসিলি কুজনেতসভের ভারত মিশন থেকে জানতে পেরেছে ভারতের আকস্মিক আক্রমণের পর সাফল্য লাভে বিলম্বের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন অসন্তোষ প্র্রকাশ করেছে। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭২ কুজনেতসভ নয়াদিল্লি পৌঁছে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বলেন, আগে বেঁধে দেয়া ১০ দিন সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ব্যর্থতায় ক্রেমলিন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ যদি আরো দীর্ঘসময় ধরে চলে অস্ত্রবিরতির প্র্রস্তাবে সোভিয়েত ভেটো গুরুত্ব হারাবে।
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধবিরতির যে-কোনো প্র্রস্তাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্র্রয়োগ করতে থাকবে, তবে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। কুজনেতসভ তার মস্কো প্র্রত্যাবর্তনের সময় পিছিয়ে দেন কারণ তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব লিওনিদ ব্রেজনেভের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। কারণ ভারত অনুরোধ জানিয়েছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে। কুজনেতসভ জানিয়েছেন এ বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য তিনি মস্কোতে বার্তা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ব্রেজনেভ মস্কোতে না থাকায় হুকুম পেতে দেরি হচ্ছে। (৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১)

এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অবিবেচনাপ্রসূত সমর্থন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশকে বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে আসতে প্ররোচিত করেছে, যা কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়