ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যে সকল দেশ এক সময়ে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল, সেখান থেকে ঔপনিবেশিক কর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পাততাড়ি গোটালেও স্থানীয় পর্যায়ে উত্তরাধিকার ও উত্তরাধিকারীরা থেকে যায়। উত্তরাধিকারটা হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের; উত্তরাধিকারীরা হচ্ছে রাষ্ট্রের স্থানীয় শাসক। উত্তরাধিকারের এই তৎপরতাটা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চালু থাকে, বাংলাদেশে যেমনটা রয়েছে। আগামীতেও থাকবে, যদি না মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়।
ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের দাপট রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রকট। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেল, আমরা ভাবলাম আপদটা নেমে গেছে ঘাড়ের ওপর থেকে। কিন্তু অচিরেই টের পাওয়া গেল যে গেছে বটে, তবু যায়নি। তাদের গড়া রাষ্ট্রব্যবস্থাটা ঠিকই রয়ে গেছে। পাকিস্তান নামের যে নতুন রাষ্ট্রটি আমরা পেলাম সেটি আয়তনে ছোট অবশ্যই, নামেও আনকোরা নতুন, কিন্তু চরিত্রে মোটেই পৃথক নয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে রাষ্ট্র ছিল পুরোপুরি ঔপনিবেশিক, স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় শাসনটা দাঁড়াল ছদ্ম ঔপনিবেশিক। তাকে নব্য-ঔপনিবেশিক বলাটা অন্যায্য নয়। রাষ্ট্রের ভেতরকার যন্ত্রপাতি, তার বিভিন্ন বাহিনী, আইনকানুন, শাসনপ্রণালী সব কিছুই আগের মতো রয়ে গেল। ব্রিটিশের দ্বারা প্রশিক্ষিত অসামরিক ও সামরিক আমলারা দেখা গেল আগের মতোই কর্তৃত্ব করছে। বিশেষভাবে দুরন্ত হয়ে উঠল সামরিক বাহিনী। ব্রিটিশের রাষ্ট্রের আদত শক্তিটা ছিল ওই সেনাবাহিনীতেই। সেনাবাহিনী রয়ে গেছে, এবং থেকে থেকে শাসন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সব কিছুর অন্তরালে শাসন ও শোষণ সমানে চললো, তবে যন্ত্রপাতিগুলো যেহেতু অতিরিক্ত ব্যবহারের দরুণ কিছুটা জীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং নতুন চালকেরা যেহেতু আগেরগুলোর মতো দক্ষ ছিল না, তাই শাসিত জনগণের যন্ত্রণা বরঞ্চ বেড়েই গেল। আওয়াজ উঠলো জাতিগঠনের ও রাষ্ট্রগঠনের, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যা চলতে থাকলো তা হলো শ্রেণি সংহতকরণ।
ব্রিটিশ শাসকেরা বিদেশি ছিল। পাকিস্তানি শাসকদেরকে আমরা দেশি মনে করেছিলাম, অনতিবিলম্বেই টের পাওয়া গেল যে তারা নামেই যা আপন, নইলে ভাষায় তো অবশ্যই আচরণেও বিদেশি ভিন্ন অন্যকিছু নয়। আমরা ঠিক করলাম এদেরকে তাড়াবো। এবং ঠিকই তাড়িয়ে দিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র তৈরি হলো। এখন আর দুর্বৃত্ত বিদেশিরা নেই, এখন আমরা এবং আমাদের মামারাই সর্বেসর্বা। তবে মামারা ছিলেন কিছুটা অগ্রসর, তাদের বিত্ত ছিল, হাতে ছিল নানাবিধ অস্ত্র; দেখা গেল অত্যাশ্চর্য দ্রুততায় তারা পরিত্যক্ত গদিগুলো সব দখল করে নিয়েছেন। মামারা শাসক হয়ে গেছেন, একটি শাসক শ্রেণি গড়ে তুলেছেন। দেশের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন এবং বিদেশে পাচারও করে দিচ্ছেন। পাকিস্তানি শাসকদের মতোই তারা নিঃসঙ্কোচে লুণ্ঠন ও অত্যাচার করছেন। এই মামারা দেশেরই সন্তান, কিন্তু তারা ক্রমাগত এবং আমাদের চোখের সামনে বিদেশি হয়ে উঠেছে। আগের দিনে জমিদারেরা ছিল, তারা ছিল সামন্তবাদী; এখানকার শাসকেরাও সামন্তবাদী আনুগত্য চায় ঠিকই, কিন্তু তাদের পুঁজিবাদী চোখ নগদ মুনাফা ও স্থায়ী ক্ষমতার দিকে।
আমরা আশা করেছিলাম স্বাধীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র পাবো। যা পাওয়া গেছে তা হলো বিভিন্ন পোশাকে স্বৈরতন্ত্র। নির্বাচিত সরকার আসে, অনির্বাচিত সরকার তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়, আবার দেখি নির্বাচিতরা এসে গেছে, কিন্তু এদের কারোরই বিন্দুমাত্র দায় থাকে না জবাবদিহিতার। ব্রিটিশের রেখে-যাওয়া রাষ্ট্রটি ছিল নির্ভুলরূপে আমলাতান্ত্রিক, বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রটিও তা-ই। আমলাতন্ত্র জবাবদিহিতার ধার ধারে না, আমাদের রাজনৈতিক শাসকেরাও একই রকমের, তারা যা ইচ্ছা তাই করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। একাত্তরে এটা অকল্পনীয় ছিল যে এই রাষ্ট্রে আবার সামরিক শাসন আসবে। অথচ সেটাই ঘটেছে। একবার নয়, বার বার। পাকিস্তানে যেমন বাংলাদেশেও তেমনি সামরিক বাহিনীকে ক্রমাগত শক্তিশালী করা হয়েছে, ক্যান্টনমেন্টের সুযোগ-সুবিধা সংখ্যা অতি দ্রুতগতিতে বেড়েছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু তারা সন্তুষ্ট থাকেনি, তাদের জন্য যুদ্ধের কোনো ক্ষেত্র ছিল না; এখনো নেই, তাই তারা সুযোগ বুঝে ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারা অলস থাকাটা পছন্দ করে না। ব্রিটিশ আমলে ব্যবস্থাটা এমন ছিল যে লোকে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হওয়ার তুলনায় সরকারি অফিসের পিয়ন হওয়া ঢের বেশি পছন্দ করতো। অত্যন্ত কঠিন মূল্য দিয়ে দুই দুইবার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও সম্মানের সেই কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে এমনটা বলবার কোনো উপায় নেই।
নাগরিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা দানের দায়িত্ব কি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কি পাকিস্তানি নব্য-ঔপনিবেশিক কোনো সরকারই নেয়নি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারেরাও নিচ্ছে না। যে-সকল অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে বাস্তবে তাদের কোনো কার্যকারিতা দেখতে পাই না। বরঞ্চ সত্য থাকে এটাই যে রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি মাত্রায় নিপীড়নকারী হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা আগে শুনিনি, এখন তা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিক। রাজনৈতিক সমস্যাকে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বলার যে অভ্যাস ব্রিটিশ শাসকদের মজ্জাগত ছিল, পাকিস্তানি দুঃশাসনের চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এসে বাংলাদেশের শাসকেরা তা থেকে মুক্তি পায়নি। অভ্যাসটি ব্যবস্থার প্রয়োজনে ও প্রশ্রয়েই তৈরি হয়েছিল। ব্যবস্থাটি নিত্যই নতুনভাবে প্রমাণ দিচ্ছে যে সে বদলায়নি।
আর আছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। ব্যবহারের এই কাজটা ইংরেজরা সরাসরি করেনি, তবে আড়াল থেকে উৎসাহদান তৎপরতায় বিরাম দেয়নি। লোকজনকে ধরে ধরে খ্রিস্টান বানাবার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল না ঠিকই, কিন্তু লোকজন হিন্দু-মুসলমানে ভাগাভাগি হয়ে যাক, এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতাকে ভুলে গিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহে লিপ্ত হোক, দাঙ্গা বাধাক, গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাক, এটা তারা খুবই চেয়েছে। বিভক্ত করো এবং শাসন করো- সাম্রাজ্যবাদী শাসনের এই শেয়ানা কৌশলকে তারা হিন্দু ও মুসলমানদেরকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করা এবং পরস্পরের ঘোরতর শত্রæ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মহোৎসাহে কাজে লাগিয়েছে। এই বিভক্ত করাটা তাদের দিক থেকে খুবই জরুরি ছিল। নইলে জাহাজে চেপে সাতসাগরের ওপার থেকে ভেসে এসে অল্পকিছু মানুষ আয়তনে বিশাল ও জনসংখ্যায় বিপুল এই উপমহাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো কি করে? অতদিন ধরে? ধর্মকে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার শান্ত সীমা থেকে বের করে এনে রাজনৈতিক সংঘর্ষের সৃষ্টিতে ব্যবহার করে তারা সুফলও পেয়েছে বৈকি, নগদানগদি।
তারা চলে গেছে, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার অক্ষুণ্ন রয়েছে। পাকিস্তানের তো প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। তথাকথিত জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বোধ করি অসতর্কভাবেই একবার ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ কায়েম করার কথা বলে ফেলেছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর ওই রকমের কোনো আওয়াজ তোলেননি। তার স্বপ্নরাষ্ট্রের শাসকেরা ধর্মের পতাকাকে উচ্চে তুলে ধরে বিভিন্ন জাতিসত্তার ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর অমানবিক জুলুম চালিয়েছে। ওদিকে ভারতীয় ইউনিয়ন সাংবিধানিকভাবেই ঘোষণা দিয়েছিল যে ‘নতুন’ রাষ্ট্রটি হবে ধর্মনিরপেক্ষ, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার আসল তাৎপর্য যে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতা ওই রাষ্ট্র সেটাকে মান্য করেনি। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা বুঝেছে, যার ফলে ধর্মচর্চাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করার সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে, এবং রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক যেহেতু হিন্দু, তাই হিন্দু ধর্মের চর্চা প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল কেবল যে শক্তিশালী হয়েছে তা-ই নয়, সময়ে-অসময়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতাকে দখল করে নিতে পর্যন্ত সক্ষম হয়েছে। নির্মম সত্য এটা যে, পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কথিত ভারতীয় ইউনিয়ন গণতন্ত্রের জন্য একেবারে প্রথম পদক্ষেপ যে ধর্মনিরপেক্ষতা সেটাই নিতে পারেনি।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়েই; শুরুতে সে-অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রæতি যে পাওয়া যায়নি এমনও নয়; কিন্তু খুব বেশি দিন লাগেনি

ধ্বনিটির পক্ষে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়তে, দশক পুরো হবার আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা পরিত্যক্ত হয়েছে, তারপরে এক সময়ে, কী আশ্চর্য, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি কয়েকটি দলে বিভক্ত, কিন্তু কোনো দলই এখন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না। বিদেশিরা কেউ কেউ বলে থাকে যে এটি হলো একটি মধ্যপন্থি মুসলিম রাষ্ট্র। স্থানীয় শাসকেরা কেউই প্রতিবাদ করে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শাসক শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে কে কতটা ধার্মিক সেটা প্রমাণ করার জন্য একটা প্রতিযোগিতা লেগেই থাকে। মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েই চলে।
ধর্মীয় বিভাজনকে ইংরেজ শাসকেরা ব্যবহার করেছে বেশ দক্ষতার সঙ্গে। যেমন তারা প্রথম যে আদমশুমারি করে তাতে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিন্যাস ও তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান তুলে ধরেছে। যাতে করে হিন্দু ও মুসলমান নিজেদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা করে দেখতে শেখে। অথবা ধরা যাক প্রাইমারি স্কুলে হাজিরা বইয়ের কথা। পাঠশালার জায়গায় প্রাইমারি স্কুল স্থাপন ইংরেজদের অবদান। পাঠশালায় হাজিরা রাখা হতো না, যার ইচ্ছা আসতো, যখন ইচ্ছা আসতে; নব্য-প্রতিষ্ঠিত প্রাইমারি স্কুলে উপস্থিতির ব্যাপারে শৃঙ্খলা এলো এবং হাজিরা খাতায় লেখা নামের সূত্র ধরে ধরা পড়লো শিক্ষার্থীদের ভেতর কে হিন্দু কে মুসলমান। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ বটে, কিন্তু তাৎপর্যের দিক থেকে মোটেই নিরীহ নয়। ওদিকে একজন বড় আমলা, উইলিয়াম হান্টার, মুসলমানদের দুর্দশার ছবি তুলে ধরে একটি বই লিখে ‘চিন্তাশীল’ মুসলমানদেরকে বুঝাতে চাইলেন যে এক সময়ে শাসক সম্প্রদায়ের অংশ হলেও বর্তমানে তারা প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে খুবই পিছিয়ে পড়েছে। সাধারণ দুর্দশার চাইতে সাম্প্রদায়িক দুর্দশাকেই সামনে আনার চেষ্টা হলো। এটা যে অসাধু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
ইংরেজ ইতিহাসবিদেরা তাদের শাসনপ্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাসকে হিন্দু ও মুসলিম যুগে ভাগ করে ইতিহাসের এক পঠনধারা চালু করে দিলেন। হিন্দুদের বোঝাতে চাইলেন যে দেশটা আদিতে তাদেরই ছিল; বাইরে থেকে এসে মুসলমানেরা সেটা দখল করেছিল; কাজেই হিন্দু ও মুসলমান কখনো এক হতে পারে না। ওই একই ইতিহাসবিদেরা কিন্তু ব্রিটিশ যুগকে খ্রিস্টান যুগ বললেন না, ব্রিটিশ যুগ বললেন। পরে বলা শুরু হলো আধুনিক যুগ। ভাবটা এই রকমের যে ব্রিটিশ যুগ আর আধুনিক যুগ এক ও অভিন্ন; ব্রিটিশ এসে ভারতবর্ষকে আধুনিক করেছে। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস যে ১৭৫৭ থেকে থেকে শুরু হয়েছে এ ধরনের অবমাননাকর ধারণার প্রবর্তন করা হয়েছে, এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে যে ওই ধারণা প্রস্থান করেছে এমনটা মোটেই নয়। মডার্ন পিরিয়ড ও ব্রিটিশ পিরিয়ড এখনো আগের মতোই সমার্থক হয়ে রয়েছে। এর হাত থেকে অব্যাহতি না পাওয়াটা বুঝিয়ে দেয় যে চিন্তার কাঠামোটি কি ভাবে গঠিত হয়ে গেছে। ইংরেজ-আগমনে বাংলায় রেনেসাঁ ঘটেছিল বলে যে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার পেছনেও কিন্তু একই তৎপরতা দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজ শাসনে উপকৃত ভারতীয় শ্রেণিই ধারণাটিকে পোক্ত করেছে। তাদের চিন্তার পেছনে ইউরোপীয় রেনেসাঁর ছায়া রয়েছে; ইংরেজদেরকে উদ্ধারকারী হিসেবে দেখবার আগ্রহ ও অভ্যাসের দরুন তারা খেয়াল করেননি যে পরাধীনতার বন্ধন ও রেনেসাঁর মুক্তি এক সঙ্গে যায় না, যেতে পারে না।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের জন্য রাজনৈতিক সমস্যার ভিত্তিভূমি ছিল দুটি। একটি পরাধীনতা, অপরটি শ্রেণিবৈষম্য। ব্রিটিশ শাসকেরা চেয়েছিল অতি ভয়াবহ এই দুই বাস্তবতাকে অস্পষ্ট করে রাখতে। তারা দেখেছে পরাধীনতা ও শ্রেণিবৈষম্যকে আড়াল করার ব্যাপারে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগানোটা সহজ। সেটাই তারা করেছে। ইংরেজদের টনক নড়েছিল ১৮৫৭-এর সিপাহী অভ্যুত্থানের সময়, যখন তারা দেখতে পেলো যে হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে গেছে, এবং অস্ত্রহাতে ইংরেজদেরকে ভারতছাড়া করতে চাচ্ছে। তখন থেকে তারা সাম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে বিশেষভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদেরই মদদে-গড়া কংগ্রেস ও লীগের প্রতিদ্ব›িদ্বতায় ইন্ধন জোগানো, এবং পৃথক নির্বাচন, সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ, ভারত ছাড়ার পরিকল্পনা, সবকিছুর ভেতর দিয়েই চেষ্টা করা হয়েছে দুই সম্প্রদায় যাতে কিছুতেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু উপমহাদেশটিকে তার জাতি-বাস্তবতার ভিত্তিতে অনেক ক’টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ না দিয়ে, দিয়ে গেছে দুই খণ্ডে বিভক্ত হবার দানবীয় অধিকার। প্রত্যাশিত ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ রণধ্বনিটি হারিয়ে গেল ‘বন্দে মাতরম’ ও ‘আল্লাহু আকবর’ রণধ্বনির নিচে, সেই সঙ্গে দিকে দিকে আর্তনাদ উঠলো বিপন্ন মানুষের।
সাম্প্রদায়িকতার সেই উত্তরাধিকার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারত থেকে এখনো দূর হয়নি। পাকিস্তান থেকে তো দূর হবার প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশেও রয়ে গেছে। এমন কি একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা অভিযানে প্রাণভয়ে যে মানুষেরা ভারতে গিয়ে শরণার্থী হয়েছিল তারাও যে তাদের ধর্মীয় ও শ্রেণি পরিচয়ের বিভাজন থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল তা নয়। কতজন হিন্দু এলো কত জন মুসলমান, সে-হিসাব ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে করতে হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবেও মুসলমান মহিলাদেরকে নিতে ভয়ঙ্করভাবে আপত্তি শরণার্থীরাই করেছে। যারা অবস্থাপন্ন তারা শরণার্থী শিবিরে যায়নি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিংবা পূর্বপরিচয়ের সূত্র কাজে লাগিয়ে থাকবার জায়গা করে নিয়েছে। টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে যারা গিয়েছিল তুলনামূলকভাবে তারা হয় তো খারাপ অবস্থায় ছিল না। তবে যতই জয় বাংলা ও বিত্তবান হোক না কেন মুসলমান পরিচয়ে কলকাতা শহরে বাসা ভাড়া পাওয়াটা যুদ্ধের সময়েও খুব সহজ ছিল না। মুজিব বাহিনীর স্বনামধন্য চার সংগঠক কলকাতাতে হিন্দু নাম ধারণ করেই উপস্থিত হয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারগুলো বিবিধ হতে পারে কিন্তু অনিবার্য বৈকি।
একাত্তরে ভারত সরকারকেও উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছিল। কেবল যে এক কোটি শরণার্থীর বোঝা বহন করতে হয়েছে বলে তা নয়, শরণার্থীদের ভেতর শতকরা ৮০ জনই যে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সে-কারণেও। পূর্ববঙ্গে হিন্দুনিধন চলছে, সেখানে হিন্দুরা আর ফিরতে পারবে না, থাকতেও পারবে না, এই ধারণা ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বোধকে উসকানি দেবে, এটা অস্বাভাবিক ছিল না। উসকানি দিচ্ছিলও। কোথাও কোথাও দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ওদিকে আবার ভারতে তখন ৭ কোটি মুসলমানের বসবাস, তাদের অধিকাংশের কাছেই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়াটা পছন্দের ঠেকেনি। উত্তেজনাটা এদের মধ্যেও ছিল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে সদস্যরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে তাদের সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার বিধি চালু হয়েছে। আগে ছিল শত্রæ সম্পত্তি, এখন হলো পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ওইটুকুই যা তফাৎ। নামেরই। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিন্দু সম্পত্তি দখলের চেষ্টা যে কমেছে তা বলা যাবে না। একাত্তরের পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতে হয়েছে, বাংলাদেশেও হয়েছে। ভারতে বিপুল উত্থান ঘটেছে বিজেপির; বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কংগ্রেসের বিরোধিতাটা ছিল উগ্র, কমিউনিস্ট পার্টি এ ব্যাপারে নরম ছিল, তারা মৃদু সমর্থন পর্যন্ত জানিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল কংগ্রেস নিষিদ্ধ হয়নি, তাদের নেতারা একজনও গ্রেপ্তার হননি; নিষিদ্ধ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি, তাদের নেতারা হয় আত্মগোপনে গেছেন, নয়তো গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ কেউ চলে গেছেন দেশ ছেড়ে, কয়েকজন নিহত হয়েছেন জেলের ভেতরেই, অনশনরত অবস্থায়। ভারতেও একই ঘটনা; সেখানেও অতিপরিচিত শত্রæ মুসলিম লীগ কখনোই নিষিদ্ধ হয়নি, মাঝে মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি, জেল খেটেছেন পার্টির নেতারা।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের অভ্যাসটা পাকিস্তান আমলে কেটে যাবার কোনো কারণ ছিল না, কেটে যায়ওনি, উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, সেখানে দাঙ্গা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র কমিউনিস্টদেরকেই নিকৃষ্টতম শত্রæজ্ঞানে সম্মানিত করা অব্যাহত রেখেছে। তাদেরকে নাস্তিক বলে চিহ্নিত করে সরল ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে শয়তানের অনুচর হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়েছে। একেবারে যে ব্যর্থ হয়েছে তাও নয়।
ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ছিল এককেন্দ্রিক এবং দূরের প্রভুদের দ্বারা শাসিত। স্থানীয় শাসকেরা ছিল সরকারি আমলা। আদত প্রভুরা থাকতো বিলেতে। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্র এককেন্দ্রিকই রইলো। পূর্ববঙ্গের বেলায় স্থানীয় শাসকেরা ছিল আমলা গোমস্তা, প্রভুরা থাকতো করাচিতে, নয়তো রাওয়ালপিন্ডিতে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রটি আগের দুটির তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু একই রকমের এককেন্দ্রিক। কেবল এককেন্দ্রিক নয়, ক্ষমতার চাবিকাঠি এই রাষ্ট্রেও রয়ে গেছে একব্যক্তির হাতে; কথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনি প্রধানমন্ত্রী, সামরিক আধা-সামরিক ব্যবস্থায় তিনি রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রের দৃশ্যমান শাসকেরা স্থানীয়, কিন্তু তাদের অদৃশ্য মুরব্বিরা থাকে বিদেশে, বিশেষভাবে ওয়াশিংটন ও দিল্লিতে। স্থানীয় শাসকেরা বিদেশি মুরব্বিদের রাগ-অনুরাগের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ব্রিটিশ শাসকদের রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে কংগ্রেস ও লীগ ছিল প্রধান প্রতিপক্ষ, কিন্তু তাদের চাইতেও বিপজ্জনক ছিল কমিউনিস্টরা। সংক্ষেপে বলতে গেলে কংগ্রেস-লীগ ছিল শাসকদের প্রতিদ্ব›দ্বী, আর কমিউনিস্টরা ছিল শাসকদের শত্রæ। ওদিকে বিবদমান কংগ্রেস ও লীগ উভয়ের চোখেই কমিউনিস্টরা ছিল জাত শত্রæ। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, দেশপ্রেমিক কংগ্রেস এবং লীগ, পুঁজিবাদী এই তিন পক্ষই একমত ছিল এই জরুরি প্রশ্নে যে আর যাই করা হোক না কেন সমাজকাঠামোতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যাবে না, পরিবর্তন বরঞ্চ ঠেকাতে হবে। অপরদিকে কমিউনিস্টরা তো ছিল সমাজবিপ্লবের স্বঘোষিত কর্মীবাহিনী। দু’পক্ষের শত্রæতাটা তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্র বদলেছে, প্রথমে হয়েছে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ হয়েছে, কিন্তু সমাজবিপ্লববিরোধিতার রাজনীতি মোটেই ক্ষান্ত হয়নি। রাষ্ট্রীয় কর্তারা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে কেবল যে বহন করে চলেছেন তাই নয় নিজেদের প্রয়োজনে তাকে আরো শক্তিশালী ও ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছেন।
স্মরণীয় যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অত দ্রুত শেষ হতো না যদি না কুশীলবদের মনে এমন শঙ্কা থাকতো যে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে চরমপন্থিরা (অর্থাৎ কমিউনিস্টরা) মূল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নতুন একটি ভিয়েতনামেরই জন্ম দিয়ে ফেলবে। যুদ্ধ শুরুর আগেই শেখ মুজিবুর রহমান পুঁজিবাদী বিশ্বকে এই মর্মে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তারা যেন বুঝতে ভুল না করে যে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে তিনিই শেষ রক্ষাপ্রাচীর। তাঁর পতন ঘটলে বিপদ আছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব যে সেটা জানতো না তা নয়, কিন্তু তাদের ধারণা হয়েছিল যে, বামভাবাপন্ন তরুণরা মুজিবকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে যে, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। সে জন্য শেষ মুহূর্তে তাঁর প্রতি সমর্থন তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
আপসপন্থিদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ যখন কোনোমতে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্রের জন্য তখন শত্রæ কারা? শত্রæ হবার কথা হানাদারদের চিহ্নিত দোসর আলবদর রাজাকারেরাই। কিন্তু তারা শত্রæ বলে বিবেচিত হলো না, বরঞ্চ কিছুটা ধীরে ধীরে হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়ে গেল। শত্রæ হয়ে দাঁড়ালো সমাজবিপ্লবে বিশ্বাসীরা (অর্থাৎ কমিউনিস্টরা)। তবে এরা তখন দুই ভাগে বিভক্ত, নরমপন্থি ও চরমপন্থি। নরমপন্থিরা ভারতে গেছে, তারা যুদ্ধ তৎপরতায় শামিল হতে চেয়েছে, কিন্তু ভারত সরকার কমিউনিস্টদেরকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি, এমনকি তাদেরকেও নয় যারা নরমপন্থি। যুদ্ধ থেকে তাদেরকে দূরে রাখার ব্যাপারে তাই ভারত সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল। ওদিকে আওয়ামী জাতীয়তাবাদীরা নরম-গরম নির্বিশেষে সকল সমাজতন্ত্রীদেরকেই সব সময়ে অবিশ্বাস করে এসেছে। কারণ নরমপন্থিদের পেছনেও তো মুরব্বি ছিল রাশিয়া, আর উগ্র হোক চাই নরম হোক সকল জাতীয়তাবাদীরই শেষ ভরসা তো রাশিয়া নয়, আমেরিকাই।
ভারত সরকার ও আওয়ামী লীগ, বামবিরোধী এই দুই পক্ষের যৌথ নজরদারিত্বের কারণে গায়ে বামপন্থি গন্ধ আছে এমন তরুণেরা মুক্তিবাহিনীতে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে, কেউ কেউ পালিয়ে বেঁচেছে, অন্যরা পরিচয় গোপন করে হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ নিয়েছে, অথবা হতাশায় আক্রান্ত অবস্থায় দেশে ফিরে এসেছে। আপসবিমুখ বামপন্থি দল উপদলগুলো ভারতে যায়নি, তারা দেশের ভেতর থেকেই লড়াই করেছে। কিন্তু তাদেরকে লড়তে হয়েছে দুই ফ্রন্টে। একদিকে ছিল হানাদার সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারেরা, অপরদিকে ছিল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে-আসা মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা, যাদের চোখে পাকিস্তানি ঘাতকদের চেয়েও বড় শত্রæ ছিল বাঙালি বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধারা। আপসবিরোধী বামপন্থিদের লড়াইটা তাই ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক, তবু তারা লড়েছে, এবং প্রাণ দিয়েছে। এখানে স্মরণীয় যে ঢাকা শহরে যে তরুণেরা গেরিলা তৎপরতায় যোগ দিয়েছে, এবং অন্যত্র একই ধরনের কাজ করেছে, তারা কেউই ছাত্রলীগের সদস্য ছিল না, প্রায় সবাই ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক; এবং সত্তর-একাত্তরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পরস্পরের মিত্র নয়, বিরোধী বটে।
বামপন্থিদেরকে শত্রæ হিসেবে দেখার ঐতিহ্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিন্দুমাত্র ছেদ ঘটেনি, বরঞ্চ সেটি ফুলে-ফেঁপে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। ফলে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী তো নিরাপদে দেশে ফিরে গেলই তাদের স্থানীয় দোসরেরাও জাতীয়তাবাদীদের রক্ষণাবেক্ষণে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলো। বিপদ যা ঘটবার ঘটলো বামপন্থিদের। তারা ধরা পড়লো, মারা পড়লো ও পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো। এমনকি নরমপন্থি সিপিবি মুজাফফর ন্যাপও বিপদে পড়লো। তারা দেখতে পেলো যে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থানকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে, এবং সামাজিক বিপ্লবের লক্ষ্য ভুলে তাদেরকে বরঞ্চ মিলে যেতে হচ্ছে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে। লোকে বললো, এরা লেজুড় বটে। আর যারা স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়াতে চাইলো সেই বামপন্থিরা পরিণত হলো নবগঠিত রক্ষী বাহিনীর স্থির লক্ষ্যে। রক্ষী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল মুজিব বাহিনীর তরুণেরাই। আওয়ামী লীগের ভেতরেও বাম-ডানের টানাপড়েনটা বৃদ্ধি পেল। বামপন্থাপ্রবণ তাজউদ্দীন আহমদ পরিত্যক্ত হলেন, বামবিরোধী খন্দকার মোশতাক আহমদ রয়ে গেলেন। কেবল রয়ে গেলেন না, সেনাবাহিনীর কয়েকজন মার্কিনপন্থি সদস্যের দ্বারা সংঘটিত ১৫ আগস্টের সেই অতিশয় মর্মান্তিক ঘটনাতে সহযোগী হিসেবে যোগও দিলেন। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারটি অসংশোধনীয় রূপেই দক্ষিণপন্থি; ওই সম্পদের ক্ষয় ঘটেনি, উল্টো বিকাশ ঘটেছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে।
এখনকার শাসকেরা দেশে থাকলেও আচরণ করে বিদেশিদের মতো। সন্তানসন্ততি এবং আহরিত ও লুণ্ঠিত সম্পদ বিদেশে রাখতেই পছন্দ করে, ঘরবাড়িও বিদেশে তৈরি করছে, ক্রমাগত বর্ধিত হারে। জাতি সমস্যার সমাধান ঔপনিবেশিক আমলে ঘটেনি, আর ঘটেনি বলেই দেশভাগ ঘটেছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তাই বলে বাংলাদেশকে যে একটি জাতি রাষ্ট্র হতে হবে এমন কোনো কথা ছিল না, এর হবার কথা ছিল বরঞ্চ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ যুগে এক জাতির জন্য এক রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়; একটি রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকবে; দেখতে হবে সেখানে সকল জাতিসত্তা গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো পাচ্ছে কি না। কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন জাতীয়তাবাদী শাসকেরা আর যাই হোক গণতান্ত্রিক হতে মোটেই সম্মত নয়, যে জন্য তারা এ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্যই বাঙালি হয়ে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক হবে বলে সাংবিধানিক ফরমান জারি করে বসলো। ফলে অবাঙালি জাতিসত্তাগুলো সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেল না; তাদের জন্য নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার নিশ্চয়তা রইলো না।
কোনো কোনো দিকে এ রাষ্ট্র ব্রিটিশের ও পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রের চেয়েও নিকৃষ্ট মানের। এ রাষ্ট্র তার নিজের আইন নিজেই মানে না; বেআইনি কাজ করে, নির্বিচারে সন্ত্রাস চালায়, হত্যাকাণ্ড ঘটায়। অধিকাংশ মানুষকে অধিকাংশ সময় ধরে অনিরাপদ অবস্থায় রেখে দেয়। টেলিফোনে আড়িপাতে, অপছন্দের ব্যক্তিদেরকে নিখোঁজ করে দেয়। মেয়েরা তাদের নিজেদের চেষ্টায় এগোয়, কিন্তু নিরাপত্তার অভাবের দরুন বোরখা ও হিজাবের আচ্ছাদন গ্রহণে বাধ্য হয়। ভবনধসে, লঞ্চডুবিতে, সড়ক দুর্ঘটনায় অহরহ মানুষ মারা পড়ে, তারা সংখ্যা হিসাবে অল্প কিছুক্ষণ উল্লেখিত হয়, তারপর বুদ্বুদের মতো অতিদ্রুত ডুবে যায় বিস্মৃতির অতলে। রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয় না। স্কুলে ধর্মশিক্ষা আগের কোনো আমলেই বাধ্যতামূলক ছিল না, স্বাধীন বাংলাদেশের আমলে হয়েছে। ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক যুগের মতোই এ রাষ্ট্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং জনগণও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়