ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

এপারে-ওপারে : বাংলা ভাষা কোন পারে?

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২১ ফেব্রুয়ারি মানেই সেই অতীতে ফিরে গিয়ে ১৯৫২ সাল খুঁজে দেখা। ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সেই, রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেক বাংলার দামাল ছেলের কথা স্মরণ করা। সেই সঙ্গে চলে আসে শহীদ মিনার, এপারে-ওপারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চার কথা।
নিজ জন্মভূমিতে বাস করে যখন কেউ নিজ মাতৃভাষার পরিবর্তে বিদেশি ভাষায় পড়াশুনা করে এবং কথা বলতে গিয়ে বাংলা ভাষার সুর হারিয়ে ফেলে, তখন বিদেশে জন্ম নেয়া কিংবা দীর্ঘদিন বসবাস করা কেউ যদি বাংলা ভাষার ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে, তখন সেটা দোষের কিছু নয়।
অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, বাংলাদেশে আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষার আন্দোলন বা বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অনেকটাই অনভিজ্ঞ। নতুন প্রজন্ম টম ক্রুজ, জন সিনা, ফুসাজিরো ইয়ামাউচির নাম খুব ভালো করেই জানে, কিন্তু রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অরো অনেক বাংলার দামাল ছেলের কথা অনেকেই জানে না। তারা চেয়ার চিনে, কেদারা চিনে না। তাদের ভাইব্রেটর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা আছে, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তারা ভ্যালেন্টাইনস, কিস ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে সম্পর্কে অবগত, কিন্তু বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, যোদ্ধা, ভাষা দিবস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ।
কিন্তু কেন?
কারণ আমরা অভিভাবক হিসেবে আমাদের সন্তানদের নিজ দেশ ও দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, উৎপত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দিতে ব্যর্থ। পরিবর্তে আমাদের অনেকেই সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে দিয়ে গর্ববোধ করেন। অর্থ ব্যয়ে সন্তানদের ইংলিশে দক্ষতা বৃদ্ধি করেন যেন দেশের বাইরে গিয়ে তারা আরো উন্নত পদে কোনো চাকরি করতে পারে।
তাতেও কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পড়াশুনা ও উপযুক্ত শ্রমের যা মূল্য, তাতে করে শুধু এক ভাষা এবং এক দেশে আটকে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মানুষ যেখানে মূল্যায়ন হয়, সেখানেই ছুটে। জীবন যাপনের মান উন্নত করতে এই যুগে ইংলিশ ভাষার দরকার আছে।
একটি শিশু ইংলিশ, হিন্দি বা স্প্যানিশ যে কোনো ভাষাকেই তার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, এটি সমস্যা নয়। সমস্যাটি হলো যদি তাদের প্রাথমিক মাতৃভাষার ওপর সাবলীলতা না থাকে।
আমাদের বাংলা ভাষায় সাবলীলতা না থাকার বড় সমস্যাটি হলো, আমাদের দেশে এখনো আমাদের শিক্ষার একটি মানসম্পন্ন বাংলাভাষী পাঠ্যক্রম পাস করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন লোক বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে। তাই সাবলীলতা অর্জন করা যায় না। নিজ মাতৃভাষার ওপর সাবলীলতা রেখেই আমাদের শেষ পর্যন্ত হিন্দি, স্প্যানিশ, ল্যাটিন, বা ইংরেজি যাই হোক না কেন, তা গ্রহণ করতে হবে।
আমেরিকাতে সরকারি কোনো বাংলা স্কুল নেই। এ দেশের ভাষা ইংরেজি এবং দ্বিতীয় ভাষা স্প্যানিশ। তবে কিছু কিছু রাজ্যে কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন এবং সদস্যদের উদ্যোগে বাংলাদেশি শিশুদের বাংলা শেখানোর লক্ষ্যে ‘বাংলা স্কুল’ কার্যক্রম চালু করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অনেকে ঘরে বসেও সন্তানদের বাংলা বর্ণমালার বই কিনে পড়তে ও লিখতে শিখাচ্ছেন।
বাংলা ভাষার চর্চার কথা বলতে গেলে, এখানকার বাঙালি বাবা-মায়েদের স্যালুট দিতেই হয়। আমাদের অনেক বাবা-মায়েরাই প্রবাসে কঠোর পরিশ্রম করেন। বিশেষ করে, নিউইয়র্ক আমেরিকাতে জীবন যাপন খুব ব্যয়বহুল।
সময়ের কাটায় মূল্য দিতে হয় এখানে। সবাই যে বসে থেকে অফিস আদালতের চাকরি করেন, তা নয়। তারপরও অনেক বাঙালিরা সেই কষ্টে উপার্জিত অর্থে সন্তানদের বিভিন্ন বাংলা শিল্প-সংগীত, যেমন বাংলা গানের স্কুল, বাংলা নাচের স্কুলগুলোতে ভর্তি করান, সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র, পোশাক সবই কিনে নেন। বাঙালি কমিউনিটিতে প্রায়ই বিভিন্ন শিল্প-সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানগুলো হয় এবং দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষগুলো ঠিকই উপস্থিত হন সেসব অনুষ্ঠানে। ঘরের কাজ, চাকরি, সন্তানের স্কুল সামলানো তারপর ছুটির এক-দুইটা দিন সন্তানের নিয়ে নিজ ভাষা-সংস্কৃতি ধরে রাখার যে আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের বাঙালি পরিবারগুলোর, তা বর্ণনাতীত।
একটা বিষয় আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না যে, আমাদের ভাষা শহীদরা কিন্তু এখনো পর্যন্ত দেশ ও জাতির কাছে তেমন করে মূল্যায়িত হননি। শহীদ মিনার সংগ্রামের প্রতীক, সৃষ্টির প্রতীক, মানুষের আর্থ-সামাজিক সাম্যের প্রতীক। শহীদ মিনার জাতির মাতৃভাষার প্রতীক। দেখা যায় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে সবাই ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে পায়ের জুতা খুলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বাকি দিনগুলোতে দেখা যায় অনেকেই জুতা পায়ে শহীদ মিনারে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, প্রেমিক প্রেমিকারা জুটি বেঁধে আড্ডায় মেতে উঠছেন। এগুলো চোখে পড়ার বিষয়।
অনেকেই বলে থাকেন, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষা বর্তমানে বাংলা ভাষাকে হত্যা করছে। কোনো ভাষা অন্য ভাষাকে হত্যা করতে পারে না, এটা করে মানুষ। আজ বাংলা ভাষা যদি তার তাৎপর্য হারাতে বসে, তবে তার একমাত্র দায়ভার বাঙালির। বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি মাতৃভাষার পরিবর্তে হিন্দি বা ইংরেজি ভাষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়, তবে এটি স্পষ্টতই এর তাৎপর্য হারাবে।
বিশ্বের বহু দেশের ফিল্মগুলো এখন বিভিন্ন ভাষায় ডাব করা হচ্ছে যাতে স্থানীয় লোকেরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এই চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করতে পারে। কিন্তু এই ডাবিং বাংলায় করা যায় না, কারণ কিছু বাঙালি মানুষ এটা চায় না। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের কথা বাদই দিলাম, এমনকি তারা চায় না যে কোনো জনপ্রিয় হিন্দি/তামিল/তেলেগু সিনেমা বাংলায় ডাবিং হোক। কিন্তু সেই তারাই আবার নেটফ্লিক্সে পয়সা দিয়ে হিন্দি, তামিল/তেলেগুর ফিল্মগুলো দেখছেন। আর এভাবে তারা বাংলা ভাষার গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছেন।
আজকাল হিন্দি ভাষাটা ও আমাদের অনেকের ভিতরেই বেশ একটা শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে। ফেসবুকে অনেকেই হিন্দিতে স্টেটাস দিতে পছন্দ করেন। বিয়ে বাড়িতে সাধারণত হিন্দি গানের প্রচলনটা অনেক আগে থেকেই। এখনকার নতুন প্রজন্ম ‘পদ্মানদীর মাঝি’ টাইপ ছবি পছন্দ করেন না। জিসম, রাম লীলা, কামাসুত্র টাইপ হিন্দি ছবিতেই রোমাঞ্চ আর থ্রিলিং খুঁজে পায় তারা।
আর তাদেরই বা দোষ কী? পরিবারে যা দেখবে, যা দেখাবে সন্তান তাই অনুসরণ করবে। সন্ধ্যা হলেই অনেক মায়েরা বসে যান স্টার প্লাস, জি টিভি, জি সিনেমা, বি ফর ইউ চেনেলগুলো খুলে। তাদের পাশে বসে ছোট ছোট ছেলেমেয়েও শিখছে নিত্য নতুন হিন্দি ভাষা। বাংলা নাটকগুলোতেও আজকাল দেখা যায়, শাশুড়িকে ডাকছে শাসুমা, বোনকে ডাকছে দি। হিন্দি যেন এখন অনেকটা ড্রাগ এডিকশনের মতোই বইছে আমাদের শিরা উপশিরায়। এই যে নিজের ভাষার প্রতি এত অনীহা, এর দায়ভার কার?
তাছাড়া আমাদের এফএম চেনাস এবং আর’যে সম্পর্কে সবাই অবগত। এফএম চেনেলগুলোতে যেভাবে বাংলা আর ইংলিশ মিশিয়ে একটা মিশ্র বিকৃত শব্দ উপস্তাপন করা হয়, তা সত্যিই দুঃখজনক। তাদের এক লাইনের বাক্যে ৬/৭টা ইংলিশ শব্দ থাকতেই হবে। বাংলা শব্দগুলোকে তারা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, শুনে মনে হয় যেন তারা জন্মগতভাবে ব্রিটিশ নাগরিকত্বের অধিকারী কিংবা বাংলা শব্দটা তাদের কাছে খুব অপরিচিত।
বাংলা ভাষায় শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে আমাদের কিশোর-তরুণদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। তারা কম সময়ে সব কিছু অর্জন করে ফেলতে চায়। ধৈর্য ধরে গন্তব্যে পৌঁছানোর বদলে তারা খুঁজে শর্টকাট রাস্তা। আজকের কিশোর-তরুণরা বাবাকে বলছে ড্যাড, ভাই বা বন্ধুকে বলছে ব্রো। শব্দের অর্থ না বুঝে বাক্য ব্যবহারে কারো প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে বলছে, ‘তুমি বড্ড প্যারা দেও আমাকে।’ অথচ একাধিক বাক্যের রচিত গদ্যের অংশ হলো প্যারা। ক্ষুব্ধ অনুভূতির সঙ্গে এই শব্দের কোনো সংযোগ নেই।
শুধু তাই নয়, কিশোর-তরুণরা এখন ‘শুভ সকাল/শুভ রাত্রি’ বলতে ভুলে গেছে। পরিবর্তে দুই অক্ষরে ‘এগ/এঘ’ ব্যবহারের হিড়িক বেশি।
সেই হিসেবে প্রবাসী বা আমেরিকায় জন্ম নেয়া, বসবাস করা আমাদের সন্তানরা অনেক ভালো বাংলা বলার চেষ্টা করে।
তাদের প্রাইমারি ভাষা ইংলিশ। ইংলিশে তাদের স্কুল-কলেজের পড়াশুনা শেষ করতে হয়। সেই সঙ্গে তারা পড়াশুনার পাশাপাশি এই যে বাংলা ভাষা এবং বিভিন্ন শিল্প সংস্কৃতিগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে, সেটা অনেক কিছু। হতে পারে অনেক বাচ্চারাই ভাঙা শব্দ এবং ধীরগতিতে বাংলা ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে; তারা বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে না।
তবে যদি কেউ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা এড়িয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আমরা তাদের জোর দিতে পারি না। বুঝতে হবে যে, বাংলা আমাদের প্রাথমিক ভাষা হলেও এ দেশে জন্ম নেয়া বা ছোট থেকে বেড়ে উঠা আমাদের সন্তানদের প্রাথমিক ভাষা নয়। তাদের ভাষা ইংলিশ। কাজেই তারা সে ভাষাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
মূলকথা হলো, বাংলা ভাষা আমাদের বাঙালির প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য রক্তক্ষরণ কম হয়নি। তাই আমাদের নিজ ভাষার শব্দ ও বাক্য ব্যবহারের প্রতি আন্তরিক ও সাবলীল হতে হবে। তবে বাংলা ভাষা ছাড়া আমরা অন্য কোনো ভাষার চর্চা করতে পারব না, বিষয়টা তা নয়। আমরা প্রয়োজনে দ্বিতীয়, তৃতীয় যে কোনো ভাষার চর্চা করতে পারি, তবে নিজ মাতৃভাষায় সাবলীলতা বজায় রেখেই আমাদের সেটা করতে হবে। অনুরূপ, প্রবাসীদের ঘরের সন্তানদের প্রাথমিক ভাষা ভিন্ন, বাংলা নয়। অর্থাৎ বাংলা তাদের দ্বিতীয় ভাষা। কাজেই তারাও নিজ প্রাথমিক ভাষাকেই গুরুত্ব বেশি দিবে, সেটাও মানতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়