ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

একুশের ৭০ বছরে অপ্রাপ্তির বেদনাই প্রধান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজি ফেব্রুয়ারি মাসটি আমাদের জন্য ভাষার মাস, প্রতিবাদের মাস, আন্দোলনের মাস, বিশেষ করে ১৯৫২ সালে হিসেবে। সেই থেকে গত ৭০ বছর ধরে আমরা বাংলাদেশের মানুষ সেই ঐতিহ্য পালন করে আসছি। পালন করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলাদেশি মানুষ, বিশেষ করে ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ দিনটি, যা আবার বৈশ্বিক পরিসরে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর মর্যাদায়’ ভূষিত ইউনেস্কোর কল্যাণে।
বাংলাদেশের বিদেশ নীতি-কূটনীতি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’টি সম্পর্কে কিছুটা উদাসীন হলেও আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার বিলুপ্ত প্রায় ভাষাগুলোর সচেতন মানুষ এ দিনটিকে কেন্দ্র করে তাদের ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে হয়তো বা উদ্দীপ্ত হতেও পারে। কথাটা এশিয়ার কোনো কোনো ভাষা সম্পর্কেও খাটে।
এখানেই ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের দিকটি পরিস্ফুট। এর গুরুত্বের কারণ, এই দিন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে অন্তত ছয়জনের মৃত্যু- তারা শহীদ হিসেবে সম্মানিত।
তৎকালীন (১৯৫২) শাসক শ্রেণির এই অর্বাচীন পদক্ষেপ যে আগুন জ¦ালিয়ে দেয়, তা দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে যায়, মূলত শিক্ষাঙ্গনগুলোকে কেন্দ্র করে। দেশের ছাত্র-যুবারা ক্ষুব্ধ আন্দোলনে মেতে ওঠে- ‘স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। গোটা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে আন্দোলন- মিছিল, স্লোগান- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।’
শেষোক্ত স্লোগানটির তাৎপর্য সবিশেষ- জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার- উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা ও উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন।

আমরা জানি, এগুলো একটি জাতি রাষ্ট্রের সূচক- মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা-জাতীয় ভাষা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই জাতি রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়ে থাকে। নেপথ্যে থাকে জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক আদর্শ।
একুশের ভাষা আন্দোলনে সচেতনভাবে না হলেও এই জাতীয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তথা দাবিগুলো দিনের পর দিন মিছিলে উচ্চারিত হয়েছে ছাত্রছাত্রী ও যুবাদের কণ্ঠে। বিষ্ময়কর যে ছাত্র-জনতার মিছিলে শহরে শহরে ছোট বড় কলকারখানার শ্রমিকরা ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিয়েছে, প্রতিবাদী স্লোগান তুলেছে কণ্ঠে।
একুশের বড় ব্যতিক্রমী তাৎপর্য হলো- এই আন্দোলন গ্রামাঞ্চলের শিক্ষায়তন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। নবম-দশম শ্রেণির স্কুলছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আন্দোলন সংঘটিত করেছে। পরিণামে স্কুল থেকে বহিষ্কার- তাদের ভবিষ্যৎ জীবন তথা উচ্চশিক্ষার কেরিয়ার নষ্ট।
এমনই ছিল শাসকদের কঠোর দমননীতি এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের অবিবেচনা প্রসূত ভূমিকা। আন্দোলন যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’, ‘সুনামগঞ্জ থেকে মেহেরপুর’, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহে’র পার্বত্য এলাকা তেমনি নেতৃস্থানীয় স্কুল ছাত্রদের শিক্ষা জীবনের বিপর্যয় অনুরূপ বিস্তীর্ণ এলাকায়- যেমন পাবনার চাটমোহর থেকে মেহেরপুর।

দুই.
এ আন্দোলনের সুবাদে ঢাকা শহরে পরপর দুইদিন পুলিশের গুলিবর্ষণে (দ্বিতীয় দিনে ইপিআর জওয়ানদেরও গুলিবর্ষণে) কমপক্ষে ১২ জনেরও মৃত্যুর মতো বর্বর ঘটনা দেশব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাতে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়- আন্দোলন গণআন্দোলনের চরিত্র অর্জন করে।
আন্দোলন হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মিছিলে নতুন সেøাগান- ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক।’ আর শহীদ স্মৃতি অমর করে রাখতে ঢাকায় মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণের রক্তমাথা স্থানে হোটেলের রাজনীতিমনস্ক ছাত্রদের একরাত্রির শ্রমে গড়ে তোলা হয় ১০ ফুট উঁচু, ৬ ফুট চওড়া একটি শহীদ মিনার (২৩ ফেব্রুয়ারি)।
পরদিন থেকে শহীদ মিনারে শোকার্ত নরনারী, শিশু-কিশোরদের ঢল। সেই সঙ্গে বয়স্ক- ঢাকাই জনতা। আতঙ্কিত নূরুল আমিন সরকার। কারণ, দর্শনার্থী সবার কণ্ঠে সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা উপচে পড়ছে। তাই ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে সশস্ত্র পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে শহীদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে ইটের শেষ টুকরাটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে যায়।

কিন্তু শহীদ মিনার মরেনি। শহীদ মিনারের ইতিহাস ভাঙাগড়ার এক স্থায়ী ইতিহাস। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে নড়াইল মহকুমা শহর, সম্ভবত অন্যত্রও ২১ ফেব্রুয়ারিতে ইট-কাদায় ছোট শহীদ মিনার গড়া হয়, যা পুলিশ সেদিনই ভেঙে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার মৃত্যু ছাত্র-জনতার মনে যে আবেগ সৃষ্টি করে, তারই উদ্দীপনায় শহীদ স্মৃতি অমর করতে দেশময় ছোটবড় শহীদ মিনার নির্মাণ, প্রধানত শিক্ষায়তন প্রাঙ্গণে। শহীদ দিবসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক অনুষঙ্গ শহীদ মিনার।
শহীদ দিবস যেমন জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিচারে এক মাইলফলক, তেমনি এর অনুরূপ প্রতীক শহীদ মিনার, যা স্বৈরাচারী শাসনের আক্রমণের মুখেও স্থায়িত্ব পেয়ে গেছে। ঢাকায় পূর্বোক্ত শহীদ মিনারের স্থানে তৈরি হয়েছে স্থায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, যা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতার কেন্দ্রস্থল। আমার বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক মহল এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করে থাকবে।

তিন.
এমন যে একটি রক্তঝরা সফল আন্দোলন, যা জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজতলা তৈরি করে শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনার মাধ্যমে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, নাম যার বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে একটি নতুন পতাকা ও নতুন জাতীয় সংগীত, সেই নব্য মানচিত্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও একুশের শেষোক্ত স্লোগান (দাবি)- জাতীয় জীবনের সর্র্বস্তরে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা প্রচলন সম্বন্ধে আমরা উদাসীন।
অথচ একুশে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার তো কোনো কমতি নেই। আছে বইমেলা, আছে মাসভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, সংগীতানুষ্ঠান ইত্যাদি। রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এবং একটি গণতন্ত্রী সংবিধান সত্ত্বেও জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞাটি পূরণ করা হয়নি। একুশের ৭০ বছরে এটি একটি বড় অপ্রাপ্তি। অপ্রাপ্তি আরো একাধিক বিষয়ে।
যেমন গুরুত্বপূর্ণ একুশের ডালপালাসহ বহু খণ্ডে একটি ইতিহাস সংকলিত হয়নি, তেমনি হয়নি দেশব্যাপী নির্মিত শহীদ মিনারের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। সময় থাকতে তৈরি ভাষাসংগ্রামীদের একটি সঠিক, পূর্ণাঙ্গ তালিকা। এখন সে চেষ্টা হবে অর্থহীন। কারণ ভাষাসংগ্রামীদের অধিকাংশই প্রয়াত। প্রয়াত অপ্রাপ্তির মর্মবেদনা বুকে নিয়ে। একই কথা খাটে জীবিত ভাষাসংগ্রামীদের সম্পর্কে। একুশে চেতনা পরিষদের সম্মেলনগুলোতে তাদের আলোচনায় সে মর্মবেদনার ইতিহাস ধরা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়