কিশোরের মৃত্যু : আজমেরী গেøারির দুই চালক কারাগারে

আগের সংবাদ

সিনহা হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত : আদালতে রায় ঘোষণা

পরের সংবাদ

গিভ এন্ড টেক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৩১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কোনো সম্পর্কের মিষ্টতা ধরে রাখার জন্য আপনাকে আত্মত্যাগ করে যেতে হবে। আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার সর্বস্ব দিয়ে অন্য কারো মন জয় করে রাখতে পারবেন সেই সম্পর্কের মিষ্টতা ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই বজায় থাকবে।
আমার দেখা সবচেয়ে সুখি দম্পতির কথাই বলি। তাদের ভালোবাসায় ভরা ছোট্ট একটা বাবুইপাখির সুখি সংসারে উঁকি দিলেই বোঝা যেত তারা মেইড ফর ইচ আদার। মেয়েটির নাম ছিল স্নিগ্ধা, স্বামী দ্বীপকে নিয়ে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকত। দ্বীপ একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করত শুনেছিলাম। কথায় কথায় একদিন জানতে পারি স্নিগ্ধাও চাকরি করত বিয়ের আগে, তবে বিয়ের পরই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে দ্বীপের কথায়।
কলেজের প্রভাষক পদের একটা সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম! স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম- এত ভালো একটা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলে?
উত্তরে স্নিগ্ধা বলেছিল- চাকরি করা মেয়ে দ্বীপের পছন্দ নয়। সারাদিন ছেলেদের মাঝে থাকবে, কখন কোথায় ভাবভঙ্গির অদল-বদল হয়ে যাবে… তার থেকে ভালো, বউ মানুষ ঘর সংসার সামলাবে।
প্রত্যুত্তরে আমি বলেছিলাম- কেন তোমার বরের ক্ষেত্রে ভাবভঙ্গির অদল-বদল হওয়ার ঝুঁকি নেই বুঝি? নাকি তোমার ওপর তার ভরসা নেই?
স্নিগ্ধা মুচকি হেসে বলেছিল- বড্ড ভালোবাসে তো আমায়…
কেন যেন সেদিন স্নিগ্ধার কথায় মনে হয়েছিল, তাদের সম্পর্কটা কেমন একটা গিভ এন্ড টেকের মাঝে সীমাবদ্ধ। যেখানে স্নিগ্ধার আত্মত্যাগে সম্পর্কটা টিকে আছে। আরো মনে হয়েছিল, যেদিন স্নিগ্ধা এটা বুঝতে পারবে সেদিন হিতে বিপরীত হতে পারে!
মাসখানেক পরই দ্বীপ অন্য জেলায় বদলি হয়ে যাওয়ায় স্নিগ্ধার সঙ্গে আর কথা হয়নি আমার।

বছর পাঁচেক পর আবারো আজ স্নিগ্ধার সঙ্গে দেখা। ফর্সা সুন্দরী সেই স্মার্ট মেয়েটা কেমন মলিন চেহারায় একখানা কম দামি আটপৌরে শাড়ি পরে বছর তিনেকের বাচ্চার হাত ধরে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল। মনের মধ্যে বেশ ইতস্তত নিয়েই স্নিগ্ধা বলে ডাকলাম।
পেছন ফিরে একটা অনিচ্ছার মলিন হাসি দিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করল- কেমন আছো?
বললাম- আমি আছি বেশ… তোমরা কেমন আছো সেটা বল? মেয়ে বুঝি এটা?
স্নিগ্ধা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল- আমি আর আমার মেয়ে খুব ভালো আছি।
– তুমি আর মেয়ে মানে? ভাইয়ার কী খবর?
স্নিগ্ধা আমার দিকে আবারো একটু মুচকি হেসে বলল- ইয়ার্কি করছো? আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে এক বছর হলো!
স্নিগ্ধার কথা শুনে থমকে গিয়েছি বটে! ওদের মতো একটা হাসিখুশি দম্পতির আবার বিচ্ছেদ হওয়াও সম্ভব নাকি?
আজো আমি অবাক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে তোমাদের? এটা কীভাবে সম্ভব? যে মানুষটা তোমাকে হারানোর ভয়ে চাকরি করতে দিত না, সেই মানুষটা এখন তোমায় ছেড়ে আছে?
স্নিগ্ধা বলল- হ্যাঁ, যে মানুষটার জন্য আমি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম; সেই মানুষটার কাছেই সেই আত্মত্যাগগুলো উল্টো মানে বহন করে এখন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট কি জানো? গিভ এন্ড টেক। তুমি যতটুকু দেবে ততটুকুই ফেরত পাবে। আমারও হয়েছে তাই। জীবনের সবকিছু ছেড়ে শুধু একজন মানুষের ভালোবাসা পেতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম প্রকৃত ভালোবাসার সংজ্ঞা। ভুলে গিয়েছিলাম আমার চারপাশের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে। যখন বুঝতে পেরেছি নিজেকে বিসর্জন দিয়ে, স্বামী নামক বস্তুটাকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজের শখ-আহ্লাদ সবকিছুই ভুলতে বসেছি; অথচ আমার আত্মত্যাগের পান থেকে চুন খসলেই আমার সুখে ভরা সংসারে হানা দিচ্ছে এক অন্যরূপ। তখন আমি বুঝতে পেরেছি আমি কোনো ভুল মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করে চলেছি।
আজ এটা কর না, কাল ওটা করবে না, এখানে যাবে না, আমার জন্য শুধু না না না। যেন আমি কোনো মানুষ নই, চালিত যন্ত্র। যেন আমার নিজস্ব জীবন বলে কিছুই নেই! এত কিছুর পরও আমিও চেষ্টা করেছিলাম মানুষটার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে। কিন্তু দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছিল যে, তার জন্য আত্মত্যাগ করাটা আমার ধর্ম আর আমার ভুল খুঁজে বের করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করাটা তার ধর্ম…
যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি কোনো ভুল মানুষের সঙ্গে আছি, আমাকে বোঝার মতো বা আমাকে বিশ্বাস করার জন্য যে উন্নত মানসিকতার প্রয়োজন সেটা তার নেই, সেদিন থেকে আমি একটু নিজের মতো করে বাঁচতে চেষ্টা করেছি। বন্দিখানা থেকে বেরিয়ে আবারো আমার জীবনের স্বাদ নিতে খোলা হাওয়ায় এক ফালি নিঃশ্বাস নিতে শুরু করি। তখনই সেই ছোট্ট বাবুই পাখির সংসারের সব মিষ্টতা পরিণত হয় তিক্ততায়, এ যেন কারো স্বাধীনতা হরনের তীব্র প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আমি শুধু সেই তিক্ততা থেকে বেরিয়ে এসেছি, ভালোবাসার নামে আমার স্বাধীনতা হরনের প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিয়েছি, জীবনের গিভ এন্ড টেক অধ্যায় থেকে দূরে চলে এসেছি। ঠিক করিনি বলো?
এই বলে স্নিগ্ধা আবারো হনহন করে হাঁটতে শুরু করল…
সেই পাঁচ বছর আগের স্নিগ্ধা আর এখনকার স্নিগ্ধার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কারণ একটাই। একজন মানুষের ভালোবাসার বিনিময়ে করা আত্মত্যাগগুলো যখন অবহেলা-অনাদরে মূল্যহীন হয়ে পড়ে তখন সেই মানুষটাই হয়ে ওঠে একজন বিপরীতমুখী সংগ্রামী স্বাধীনচেতা মানুষ। যেমনটা হয়েছে স্নিগ্ধার সঙ্গে। একজন ব্যক্তিত্বহীন, ছোট মানসিকতার মানুষের সঙ্গে সারাজীবন অ্যাডজাস্টমেন্ট করার নামে অশান্তি সহ্য করার চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো, তাতে করে অন্তত জীবনের শান্তি আর স্বাধীনতাটুকু ক্ষুণ্ন হয় না।
আর এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমিও ভুল করনি স্নিগ্ধা…
আনান্নিয়া আন্নি
শিক্ষার্থী, কবি নজরুল সরকারি
কলেজ, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়