লাইসেন্স ছাড়াই ৭ বছর ট্রাক চালায় জসিম

আগের সংবাদ

ফাইভ-জিতে অনাগ্রহ কেন : তরঙ্গ নিলামের শর্ত ও নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি > ‘বুঝে-শুনে আগে বাড়তে চায় বেসরকারি অপারেটররা

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ইন্দিরার কর্মকৌশল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে সিআইএর গোপনীয় মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছে : ক্ষমতা ক্রমাগত দিল্লিতে ইন্দিরাকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। তার বিরোধীরা পরাস্ত, তার দলের আঞ্চলিক নেতারা যারা নিজস্ব অধিক্ষেত্রে অনেক ক্ষমতাশালী ছিলেন তারাও ক্ষমতা হারিয়েছেন। প্রতিদিনই মিসেস গান্ধীর আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। বর্তমানের নীতিমালা এবং ভবিষ্যতে উন্নয়নের কাঠামো তিনি যেভাবে প্রণয়ন করতে চাচ্ছেন তা চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ নেই। অধিকতর ক্ষমতার জন্য তার ক্ষুধা দৃশ্যত অতৃপ্ত রয়ে যাচ্ছে।
মিসেস গান্ধী ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর পুনর্নির্মাণের কাজটি এককভাবে করছেন এমন নয়, তিনি রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রযুক্তি-কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন উপদেষ্টাদের একটি মিশেল তৈরি করে নিয়েছেন। তার কর্মকৌশল শৈলী সরাসরি নয় তিনি বিকল্পের মধ্যে দোল খান, তবে তার শত্রæ-মিত্র সবাই স্বীকার করেন তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে জানেন। ভারতের উন্নয়নের জন্য এই নেতৃত্ব আবশ্যক।
১৯৬৬-এর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার পর ইন্দিরা গান্ধী তার লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছেন- নিজের ক্ষমতা সংহত করা। কংগ্রেসের সিন্ডিকেট, স্থানীয় পর্যায়ের কিছু রাজনৈতিক ব্যারন যারা পরস্পরের প্রতিদ্ব›দ্বী ও পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ আপাতদৃষ্টিতে নমনীয় ইন্দিরা তাদেরই পছন্দ ছিলেন।
মিসেস গান্ধী রাজনীতিকে কোনো বিপ্লবী প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন না, তিনি একে অভ্যুদয়মুখী প্রক্রিয়া মনে করেন। তার উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় ব্যাংক জাতীয়করণ, মহারাজাদের সুযোগ-সুবিধা ও অর্থের সংকোচন ও ভূমি সংস্কার। বাংলাদেশের সংগ্রামে অভ্যুদয়ে হস্তক্ষেপ সবই তার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী তার পক্ষ ও প্রতিপক্ষ উভয়কেই মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে যতটা ক্ষমতা প্রয়োগ করবার, তা প্রয়োগ করেন।
একাত্তরের যুদ্ধ ও ইন্দিরার কর্মকৌশল নিয়ে লিখেছেন এয়ার ভাইস মার্শাল কপিল কাক (অব.) :
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানে সংকটের যে বিস্ফোরণ তা রাজনৈতিক নয়, আদর্শগতও নয়। জাতিগত ‘ফল্ট লাইনে’ যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে তার সমাধানে পাকিস্তানের অক্ষমতা বা অনিচ্ছাতে সংকটের মূলটি প্রোথিত। বাঙালি জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের লোকসংখ্যার ষাট ভাগ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচন তাদের একটি দুর্লভ সুযোগ এনে দিল। শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের বৈধ দাবিদার হলেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর চাওয়া ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের না হলেও অন্তত পশ্চিম পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে ক্ষমতা নেবেন। তাতে পাকিস্তানের যা ক্ষতি হওয়ার হোক। এখান থেকেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর দেশটি সবচেয়ে মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি হলো।

ভারতীয় কর্মকৈশল
ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংকট, সেনা নির্যাতন এবং শরণার্থীর স্রোত পর্যবেক্ষণ করছিল। একজন বিদেশি পর্যবেক্ষক বললেন, ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদকে মার্চের শেষে সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শ ছিল- ভারত পূর্ব বাংলার আশু সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। বাঙালিদের সামরিক সাহায্য করতে হলে তাদের আরো কিছু অপেক্ষায় থাকতে হবে। গ্রীষ্মের শুরুর দিকে পাকিস্তান যখন বুঝতে পারে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নেয়নি তখন আওয়ামী লীগের বৈধ রাজনৈতিক দাবি না মানার প্রশ্নে আরো অনমনীয় হয়ে উঠে অভ্যন্তরীণ সামরিক সহিংসতা বেধে যেতে পারে।
জুনের প্রথম সপ্তাহে রানীক্ষেতের বক্তৃতা এবং শোকসভার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক বার্তা শুনিয়ে দেন। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথাশিগগির সম্ভাব্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে সমস্যার ‘অন্য ধরনের সমাধান বিবেচনা করতে বাধ্য হবে’। প্রকৃতপক্ষে শরণার্থীদের জন্য সহানুভূতি পৃথিবীর সর্বত্রই প্রকাশিত হয়।
আই এন দীক্ষিত লিখেছেন, ‘পূর্ব বাংলার সংকট মোকাবিলার জন্য সরকার দ্বিমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথমত, পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানায় যাতে পাকিস্তান ১৯৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেট মেনে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করে। দ্বিতীয় উদ্যোগটি যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান সমর্থনের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অধিকন্তু পাকিস্তানের পক্ষে চীনের ওকালতি এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন নতুন আঁতাত ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৭১-এর নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী ছয় দেশ সফরের সময় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত চায় শরণার্থীরা গ্রহণযোগ্য শর্তে অবিলম্বে নিজ দেশে ফিরে যাক। তিনি চান পূর্ব বাংলার মানুষ এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টি হোক, পাকিস্তানের বর্তমান কাঠামোর আওতায় সমঝোতা হবে নাকি পাকিস্তান কাঠামোর বাইরে হবে শেষদিকে তিনি এটাও বেঁধে দেননি। ওদিকে ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার বিকল্প পথগুলো দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছিল। সৌভাগ্যক্রমে বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ায় ভারতের চূড়ান্ত কার্যক্রম কী হবে সে বিষয়ে জনমত গঠনের সময়ও পাওয়া যায়।
সংকটের গভীরতা ও শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অনিশ্চয়তা ভারতকে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। ভারতীয় লোকসভায় এবং একাধিক রাজ্যসভায়, মুক্তিবাহিনীকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা করার, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এবং পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্যও কূটনীতিকদের জায়গা দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
ভারতে সামনে তখন দুটি বিকল্প। সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানকে সামরিকভাবে সাহায্য করে পূর্ব বাংলার বিদ্রোহ দমন করা অথবা সরাসরি বাংলাদেশকে সাহায্য করা যাতে স্বাধীন দেশ হিসেবে এর অভ্যুদয় ঘটতে পারে।
মে-জুন মাসে যখন বোঝা গেল, ভারত সংকটের সামরিক সমাধানের দিকে যাচ্ছে না, তাজউদ্দীনের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার চাপ এলে মিসেস গান্ধী তখন দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, যতক্ষণ না বাংলাদেশিরা তাদের দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে, পৃথিবীকে দেখাতে পারছে যে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণ তাদের সঙ্গে আছে- ভারত সে পথে এগোবে না। ভারতের হস্তক্ষেপ কেবল এই ধারণা দেবে যে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙে দুই টুকরো করে বাংলাদেশে পুতুল সরকার বসাতে চাচ্ছে- এ কথা ইন্দিরা গান্ধীই বলেন। তিনি আশ্বস্ত করেন, ‘যখন সময় আসবে আমরা সাড়া দেব’। ভারতের ভেতরে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী গণমাধ্যমে এই ধারণা প্রচার করতে শুরু করে যে পাকিস্তানকে দুই খণ্ড করলে সেখানে ভারতের কোনো জাতীয় স্বার্থ নেই বরং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করলে দুর্বল অংশের ‘অর্থনৈতিক ও সামরিক দায়’ থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান বরং আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, পাকিস্তানের শক্তিশালী হয়ে ওঠা ভারতের জন্য বড় হুমকি।
একদল মনে করেন, পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষকে স্বাধীন করতে সহায়তা করলে সঙ্গত কারণেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংগ্রামী ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে উসকে দেয়া হবে। কাজেই পাকিস্তানকে কেবল কূটনৈতিক চাপের মধ্যে রাখাই সমীচীন হবে। কে সুব্রামানিয়াম অবশ্য স্পষ্ট করেই বলেন, ‘প্রভাবিত করার কূটনীতি যখন ব্যর্থ হয়, স্বীকার করতেই হবে শক্তির হুমকি ও শক্তির প্রয়োগ তখন জরুরি হয়ে পড়ে।’ ২৫ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের সাড়া পর্যবেক্ষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে ভারত একইসঙ্গে কূটনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইন্দিরা গান্ধী ও তার মুখ্য উপদেষ্টারা একমত হন যে ভারতের জাতীয় স্বার্থ যেখানে হুমকির মুখে সেখানে যুদ্ধের আশ্রয় নেয়া দরকার হতে পারে।
কে সুব্রামানিয়ামের যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য হয় যে, এক কোটি শরণার্থী লালন-পালনের যে ব্যয়, যুদ্ধের ব্যয় তার চেয়ে কম। ভারত এই হিসাবটি সনাতন অর্থনীতির লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ দিয়ে করেনি, সমকালীন পৃথিবীর অনেক যুদ্ধের ইতিহাস ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কাহিনীও সামনে নিয়ে এসেছে।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১-এর যুদ্ধের আগে, যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের পর বারবার বলেছেন, পাকিস্তানের বাংলাদেশি ভূখণ্ড দখলে রাখার কোনো পরিকল্পনা ভারতের নেই।

ইন্দিরার কর্মকৌশল
১৯৭১-এ সাফল্যের প্রশংসা প্রাপ্য ইন্দিরা গান্ধীরই। তিনিই ‘মাস্টার স্ট্রাটেজিস্ট’। তিনি তার সশস্ত্র বাহিনীর ওপর বিশ্বাস রেখেছেন এবং তাদের লড়াই করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট, পরিকল্পনায় ছিল পেশাদারিত্ব, তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ছিল অনবদ্য।
তিন বাহিনীর কাজে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে অবদান রেখেছে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় উত্তর আফ্রিকার সশস্ত্র বাহিনী যে গতিতে এগিয়েছে তারপর এই প্রথম সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে কোনো সেনাবাহিনী এগিয়ে গেছে। ১৯৭১-এর যুদ্ধে পশ্চিমে ভারতের লড়াইটা ছিল প্রতিরক্ষামূলক আর পূর্বে চালানো হয়েছে সৃজনশীল কৌশলগত আক্রমণ। ভারতীয় বিমানবাহিনী দুদিনেই পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ দখল করে নিল। আর এতেই পাঁচ ডিভিশন শক্তিশালী ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাঘাঁটি ও ক্যান্টনমেন্ট পাশ কাটিয়ে ফেরি-সেতু নিরাপদে পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। কক্সবাজারে হলো সফল অ্যাম্ফিবিয়ান আক্রমণ, টাঙ্গাইলে প্যারাট্রুপার, ১২টি ছোট এমআই ৪ হেলিকপ্টার পার করে দিল এক ব্রিগেড সৈন্য, ২ কিলোমিটার প্রশস্ত মেঘনা নদী। রকেট আক্রমণ হলো গভর্নর হাউসে, গভর্নর পদত্যাগ করলেন। আত্মসমর্পণ করল ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য।
যেহেতু দৃষ্টি ছিল পূর্ব রণাঙ্গনে দুপক্ষ অপেক্ষা ও আক্রমণের খেলা খেলছিল। পাঞ্জাব, সাকারগড়, আখনুর আর নয়াচরে ভারতের সফল্য। লঙ্গওয়ালাও কারগিল চলে এর ভারতীয় দখলে। সিমলা চুক্তির কারণে দখল করা জায়গা ছেড়ে দিতে হলো। দখল করা কাশ্মিরের অংশ ছেড়ে দেয়ার জন্য সিমলাতে কোনো চাপ দেয়া হয়নি। দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত হতো।
একাত্তরের সাফল্যের মুকুট ইন্দিরার। তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, তিনবাহিনী প্রধান জেনারের স্যাম মনেকশ, এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ লাল, এডমিরাল এস এম নন্দা, প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল, পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল, গোয়েন্দা প্রধান আর এন কাউ, পলিসি প্ল্যানিং প্রধান ডিপি ধর আর বিশ্বস্ত মুখ্য সচিব পিএন হাকসার।
একাত্তরে ইন্দিরার নেতৃত্বে ভারতের যে সাফল্য, যুদ্ধের ইতিহাসে তা স্মরণীয়।
যুক্তরাষ্ট্র যখন বঙ্গোপসাগরে নৌবহর পাঠায়, ভারতীয় হিসাব বলে দেয় নৌবহর পৌঁছার আগেই ঢাকার পতন ঘটবে। ইন্দিরা গান্ধী এবং তার উপদেষ্টা বুঝে নিলেন, মার্কিন এই নৌ পদক্ষেপ কেবল পশ্চিম পাকিস্তান, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দেশগুলোকে সন্তুষ্ট করার জন্য।
তবে বঙ্গোপসাগরে প্রথমে ৭ম নৌবহরের আগমন পরবর্তী সময়ে ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার এটাই ছিল দ্বিতীয় ট্রিগার। প্রথমটি সেখানকার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। ১৯৭০-এর ভয়ংকর জলোচ্ছ¡াস পরবর্তী সরকারের দুর্বল সাড়া ইসলামাবাদের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবোধকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দুর্বৃত্তায়নের মাঝখানে পাকিস্তান আরো একটি দুষ্কর্ম করে ফেলে। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১ জম্মু ও কাশ্মির থেকে বিদ্রোহীদের হাইজাক করা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের ফকার ফ্রেন্ডশিপ উড়োজাহাজটি উড়িয়ে দেয়। এরপরই ভারত একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব সামরিক ও বেসামরিক উড়োজাহাজের যাতায়াত নিষিদ্ধ করে দেয়। এতে পাকিস্তানের ওপর মারাত্মক আঘাত আসে- এই সিদ্ধান্তের কারণেই অক্টোবর-নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্য ও রসদের সমারোহ ঘটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, ভারতীয় নিষেধজ্ঞার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য আর অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাতে ২ হাজার ৫০০ মাইল ঘুরে যেতে হয়- এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার।
ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানে নিক্সন প্রশাসন কর্তৃক অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার এবং প্রকাশ্যে পাকিস্তান সরকারকে সমালোচনার অনীহার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা ও আমেরিকার জনগণের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, কিন্তু ভারতীয় জনগণের মতে, সম্পর্ক হ্রাস পাওয়ার একটি কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও পাকিস্তানের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা।’
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারত জানিয়েছে আজাদ কাশ্মিরের দাবি প্রত্যাহার করতে তারা রাজি নয়। তবে তা উদ্ধারের জন্য এখন বল প্রয়োগের অধিকার প্রয়োগ করবে না। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের যুদ্ধের যে আর্থিক ব্যাখ্যা দেয়া হয় প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দীর্ঘমেয়াদি লালন-পালনের যে ব্যয় তার চেয়ে বরং যুদ্ধে নেমে পাকিস্তানকে দুই খণ্ড করে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো অধিকতর অর্থবহ; কার্যত আর্থিক সাশ্রয় আরো অনেক বেশি। একাত্তরের ডিসেম্বরের পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশ ঘেরা সে সীমান্ত সেখানে সমরসজ্জায় সজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন রাখার প্রয়োজন আর নেই। ভারতের জন্য পাকিস্তান শুরু থেকেই বৈরীরাষ্ট্র। বাংলাদেশ শুরু থেকে বন্ধুরাষ্ট্র।
পাকিস্তানের জন্য আমেরিকার অস্ত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন অস্ত্রের পরিমাণ কত আমার জানা নেই, কিন্তু আমেরিকা আগে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করেছে। আর এসব কেবল আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, কমিউনিজম বা অন্য যা কিছু তারা বলেছে, কোনোটার বিরুদ্ধেই নয়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আমাদের সঙ্গে বোঝাপড়া বরং অনেক বেশি। সানডে টাইমসের নিকোলাস ক্যারোল ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন।
ক্যারল জিগ্যেস করলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে আপনার ঘোষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আপনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রসীমা বৃদ্ধির কোনো অভিলাষ নেই। তাহলে কবে নাগাদ শেষ ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের কাজটি সম্পন্ন হবে? মিসেস গান্ধী বললেন, এ পর্যায়ে বলা কষ্টকর। বিষয়টি প্রধানত বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করি তা শিগগিরই ঘটবে। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের জন্য তার নেতা শেখ মুজিবুরের বিশেষ প্রয়োজন। ‘মুজিবকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে।’

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়