তথ্যমন্ত্রী : টিআইয়ের রিপোর্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে

আগের সংবাদ

নীরব মহামারি অসংক্রামক রোগ

পরের সংবাদ

শহীদ জায়া : বেগম মুশতারী শফী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী (১৯৩৮-২০২১) ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, সমাজ সংগঠক, নারীনেত্রী, সাহিত্যিক ও উদ্যোক্তা, ছিলেন একাধারে নারীনেত্রী এবং উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি। মুশতারী শফী মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে ছিলেন। ’৬০-এর দশকে তিনি চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সম্পাদনায় বান্ধবী নামে একটি পত্রিকাও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তার চট্টগ্রামের বাসভবনেই হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম স›দ্বীপসহ প্রগতিশীল নেতা এবং শিল্প-সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বগণের কর্মকাণ্ড ছিল এই বাসাকে ঘিরে। এ কারণেই ৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তিনি হারান তার স্বামী ডা. শফীকে। কিন্তু দমে যাননি এই মহীয়সী নারী। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ। ২০২০ সালে অর্জন করেন ‘রোকেয়া পদক’। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির সংগঠক ও নেত্রী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
তার সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্রটি বেশ তাৎপর্যবহ। টোকিওতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন কালে ১৯৯৯ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে প্রখ্যাত লেখিকা বেগম মুশতারী শফীর অনবদ্য রচনা ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইটি আমার পড়ার সুযোগ হয়। বইটিতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে নিবিড়ভাবে ফিরে পেলাম যেন। মুক্তিযুদ্ধ আমার স্মৃতিতে আবেগ ও আলোড়ন সৃষ্টি করে। এমন বর্ণনা দিয়েছেন যা সত্যই গদ্য মহাকাব্য হয়েছে। বইটিতে বেগম মুশতারী শফীর একান্ত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে (রূঢ় বাস্তবের মোকাবিলা করে দেখা) মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো এমন নিখুঁত ও হৃদয়স্পর্শী বর্ণনায় উঠে এসেছে যে, তা পাঠ শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামতে ইচ্ছে হয় না। বইটি শেষ করার পর মনে হলো যেন একটি উচ্চ মার্গের তথ্য চিত্র দেখে উঠলাম। শুরু হলো তার সঙ্গে পত্রালাপ। আমার বড় মেয়ে তানিয়া যারিফা মজিদ ও আমি বইটির কিয়দংশ ইংরেজিতে অনুবাদ তাকে পাঠালে তিনি বেশ উৎসাহ বোধ করেন এবং আমাদের অনুবাদের অনুরোধ অনুমতিও দেন। ১৭.১২.১৯৯৯ তারিখে তিনি আমাকে লেখেন-
‘আপনার ইংরেজি অনুবাদকৃত আমার বইটির অংশবিশেষ (তাকাশী প্রসঙ্গ) পাঠ করে আমার ভালো লেগেছে, আমি চমৎকৃত হয়েছি। যদিও আমার ইংরেজি জ্ঞান খুবই সীমিত। কিন্তু অন্য যারাই পড়েছেন, তারাও বলেছেন, অত্যন্ত সুন্দর বলেছেন। আপনার রচনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আবেগ, সেটি অনুবাদেও এসেছে। তাই আমার অনুরোধ পুরো বইটি যত সময় লাগুক আপনি অনুবাদ করুন।’
যাই হোক নানান কারণে আমরা শেষ করতে পারার আগেই প্রকাশনা সংস্থা মওলা ব্রাদার্স বইটির এ এস মণ্ডলকৃত ইংরেজি অনুবাদ ‘উধুং ড়ভ গু ইষববফরহম ঐবধৎঃ’ প্রকাশ করে।
মুশতারী শফী লিখেছেন তাকাশি ওয়াদা নামে এক জাপানির সঙ্গে তার পরিচয়ের কথা। তার সঙ্গে দেখা হয় ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন ইস্টার্ন কেমিক্যালের ফেক্টরিতে। বাওয়ানিদের ওই ফ্যাক্টরিতে মি. ওয়াদার নেতৃত্বে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল তখন কাজ করছিল। তার সম্পাদিত ‘বান্ধবী’ পত্রিকার জন্য রিপোর্ট তৈরি করতে মুশতারী শফী ইস্টার্ন কেমিক্যালে গেলে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে সুবাদে এক সময় তাকাশি ওয়াদা বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির অনুরক্ত ভক্ত হয়ে ওঠেন। মুশতারী শফী তাকাশিকে বাংলা বলা ও নিজের নাম লেখা শিখিয়ে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ওয়াদা জাপানে ফিরে যান এবং তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল স্বামী প্রখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডা. মো. শফি এবং ভাই খন্দকার এহসানউল হক আনসারি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর অত্যন্ত সংগোপনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুশতারী শফী চট্টগ্রাম ছাড়েন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্ট স্বীকার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা পৌঁছান। সেখানে কিছুদিন আশ্রয় শিবিরে কাটানোর পর কলকাতায় যান ছেলেমেয়েদের নিয়ে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে কাটতে থাকে তার দিনগুলো। মুশতারী শফী লিখেছেন, আজ দুপুরে আমার বন্ধু তাকাশি ওয়াদার চিঠি পেলাম সঙ্গে ২০টি ইয়েন। একদিন আমার ব্যাগ ঝাড়তে গিয়ে তাকাশি ওয়াদার ঠিকানা পেয়ে যাই। ঠিকানা পেয়েই তাকাশিকে চিঠি লিখেছিলাম বাংলাদেশের সমস্ত ঘটনা জানিয়ে, সঙ্গে আমার জীবনের দুর্ঘটনার কথাও লিখেছিলাম।… ও আজ লিখেছে, ‘মুশতারী, তোমার চিঠি আমাকে ভীষণরকম ব্যথিত ও মর্মাহত করেছে। বাংলাদেশের বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধ করছে, এ কথা আমরা জেনেছি। কিন্তু এত যে নির্মম নৃশংসতা চলছে ওখানে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে এ তো জানা ছিল না, আর দেশের জন্য তুমিও কিনা সেই নৃশংসতার স্বীকার হলে? ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। কী বলে যে তোমাকে সান্ত¡না দেব, ভাষা নেই, ঈশ্বর তোমাকে শান্তি দিক। তোমরা যে ন্যায়ের অধিকারে সংগ্রাম করছ আমাদের দেশের সরকার ও আমাদের জনগণ তোমাদের এই সংগ্রামের সপক্ষে রয়েছে। তোমার এই হৃদয়ের স্পর্শের চিঠিখানা আমাদের দেশের একটি ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে দিয়েছি। আর তোমার এই দুর্দিনে বন্ধু হিসেবে সামান্য কিছু ইয়েন পাঠালাম। আশা করি গ্রহণ করবে। জানি না, ভারতীয় মুদ্রায় তুমি কত পাবে। তবে যাই পাও আমাকে জানাতে ভুল না। সহসাই তোমাদের বিজয় কেতন উড়–ক। শুভ কামনায় -তাকাশি ওয়াদা ২০.১১.১৯৭১’
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার তাকাশি ওয়াদা বেগম মুশতারী শফীর ভারতের শরণার্থী শিবিরের দিনগুলোতে তাকে যে সান্ত¡না সাহস আর অভয়বাণী পৌঁয়েছিলেন তা তো স্বাধীনতা আর মুক্তির সংগ্রামের প্রতি জাপানের জনগণের ও সরকারের আন্তরিক সমর্থনের প্রতীকী প্রকাশ। আমাদের দুর্দিনে তাদের এই পাশে দাঁড়ানোর হিম্মত, বদান্যতা ও ভালোবাসার প্রতি আমাদের স্বকৃতজ্ঞ সালাম জানানোর জন্যই মুশতারী শফীর বই পড়ার পর তাকাশি ওয়াদাকে আবিষ্কারের উদ্যোগ নিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম জাপানি জনগণের দূতাবাসের সংরক্ষিত তালিকায় তার কোনো হদিস পেলাম না। মুশতারী শফীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম দেড় দশকের মতো হলো তাকাশি-মুশতারী শফীর মধ্যে যোগাযোগ নেই। আগে অন্তত নববর্ষে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতেন তাকাশি ওয়াদা। মনটা ছ্যাঁত করে উঠল- জাপানিরা নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময়ে অত্যন্ত পাঞ্চুয়াল। তা হলে তাকাশি কি বেঁচে নেই? বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার এই সরব সমর্থকের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আমার একান্ত ইচ্ছা। মুশতারী শফীর কাছ থেকে ওয়াদার পুরনো ঠিকানাটাই জেনে নিলাম এবং সেই মতো যে কোম্পানিতে তিনি চাকরি করতেন সেই কোম্পানিটির সঙ্গেই যোগাযোগ করলাম। তারা জানালেন বছর বিশেক আগে তাকাশি অবসর নিয়ে কোম্পানি ছেড়েছেন। অনুরোধ রাখলাম তারা তার বর্তমান অবস্থানের আভাস দিতে পারেন কিনা। পাঁচ দিন পর কোম্পানিটির ব্যবস্থাপক মি. সুজুুকি দিলেন একটি ফোন নম্বর, সম্ভবত এটি তাকাশির বাসার ফোন। অফিস আদালত থেকে জাপানিদের বাসায় সচরাচর ফোন করার কোনো রেওয়াজ নেই। আমার দোভাষি সহকর্মী ইসামু শিরাইকে বললাম তার পক্ষ থেকে যথারীতি ও সৌজন্য সহকারে তাকাশির বাসায় ফোন করতে। ফোন ধরে ছিলেন তাকাশির স্ত্রী। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তার স্বামীর কেন খোঁজ করা হচ্ছে- ভদ্রমহিলা বিব্রত ও কিছুটা বিরক্তও হলেন। শিরাই সাহেব সব বুঝিয়ে বলার পর তাকাশির বর্তমান কর্মস্থলের ফোন নম্বর পাওয়া গেল। এবার আমিই তাকে ফোন করলাম। তাকাশি ধরলেন। আমার পরিচয় দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার চট্টগ্রামের কথা, মুশতারী শফীর কথা মনে আছে কিনা। এ যেন এক অভূতপূর্ব স্মৃৃতি মন্থনের অভিষেক। তাকাশি চমৎকার বাংলাতেই বললেন, ‘বেশ মনে আছে’। আমি তার কথা কীভাবে জানলাম পাল্টা প্রশ্ন এলো তার তরফ থেকে। তখন মুশতারী শফীর বইয়ের কথা বললাম। তাকাশির কাছ থেকে জানলাম তিনি কোম্পানি থেকে রিটায়ার্ড করার পর বর্তমানে একটি অনুবাদ সংস্থায় প্রশিক্ষক হিসেবে আছেন। তাকে বললাম আপনাকে চাক্ষুস দেখতে চাই। আমার স্ত্রী পরের শুক্রবার ঢাকায় যাবেন। তার আগেই, শর্ট নোটিসে, তাকে সস্ত্রীক দাওয়াত দিলাম আমার বাসায় নৈশভোজে।
তাকাশি ওয়াদা সস্ত্রীক এলেন সে সন্ধ্যায়। জাপানিরা সাধারণত স্ত্রীকে নিয়ে আসেন না দাওয়াতে। এটি ছিল ঘরোয়া অনুষ্ঠান এবং তাকাশির প্রতি নিবেদিত। তাকাশি হাতে করে এনেছেন মুশতারী শফী সম্পাদিত মাসিক ‘বান্ধবী’র ৪টি সংখ্যা ১৯৬৮-৬৯ সালের। সে সময়ে চট্টগ্রাম (এখনকার বিবেচনায় নিতান্ত মফস্বল বলা যায়) থেকে এমন উচ্চাঙ্গের পত্রিকা (মহিলা লেখক, মহিলা সম্পাদক, মহিলা মূদ্রাক্ষরিক, কম্পিজিটর সবই মহিলা) বের হতো দেখে বিস্মিত হতে হয়। ওই পত্রিকাগুলোর একটিতে ইস্টার্ন কেমিক্যালসের ওপর ‘বান্ধবী’র সচিত্র প্রতিবেদন রয়েছে যেখানে উল্লেখ আছে তাকাশি ওয়াদার কথা। ওয়াদা সে অংশটি পড়তে পারেন আজো। কোনো যোগাযোগ না থাকলেও গত ৩০ বছরে তিনি ভোলেননি বাংলা। ইতোমধ্যে কয়েকবার চেষ্টা করলাম ফোনে চট্টগ্রামে মুশতারী শফীর সঙ্গে তাদের আলাপ করিয়ে দেয়ার চমক সৃষ্টি করতে। কিন্তু তা আর হলো না, মুশতারী শফীর ফোনটা সেদিন খারাপ ছিল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়